সাতবাহন সাম্রাজ্যের প্রশাসনিক ব্যবস্থা বিষয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা।
প্রাচীন ভারতের ইতিহাসে সাতবাহন সাম্রাজ্যের ভূমিকা বিশেষ গুরুতপূর্ণ। সঙ্গাটি অশোকের মৃত্যুর পর মৌর্য সামাজা ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ে এবং মৌর্য সাম্রাজ্যের পারনো ন্যা ভারতের ঐক্য সাময়িকভাবে বিনষ্ট হয়। এই অবস্থায় ভারতের অভ্যন্তরে নতুন নতুন স্বাধীন রাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটে। এর মধ্যে অন্যতম ছিল দাক্ষিণাত্যে মহারাষ্ট্র ও অক্সকে কেরা করে গড়ে ওঠা সাতবাহন সাথায়মা। পড়ি ও গৌরবের দিক থেকে এই সাম্রাজ্য যখন সন্ডাজ্যের ভগ্নাংশের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠে। প্রায় তিন শতাব্দীকাল এই রাজবংশ পশ্চিম ও বক্ষিণ ভারতের রাজনৈতিক ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিহিত ছিল। সারবাহন সাহাজ্যের কচুবিধ উল্লেখযোগ্য অবদানের মধ্যে আমাদের প্রশ্নে আলোচিত বিষয় হল সাতবাহন সাম্রাজ্যের প্রশাসনিক ব্যবস্থা।
সিমুক বা শ্রীমুখ কর্তৃক প্রতিষ্ঠির সাতবাহন সান্ডাজ্যে বহু উল্লেখযোগ্য নরপতি শাসন। করেছেন। প্রত্যেকেই তাঁরা উল্লেখযোগ্য কৃতিত্ব স্থাপন করেছেন। এঁদের মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য ও সমধিক পরিচিত গৌতমীপুর সাতকণী। তিনি আনুমানিক ১০৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ১৩০ অব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন। মাতৃ পরিচয়ে পরিচিত হয়ে রাজ্যশাসন ও নানা গৌরবজ্জ্বল ঘটনা এই বংশের কৌলীন্যকে সমৃদ্ধ করে। এই সাম্রাজ্যের প্রশাসনিক ব্যবস্থা বিষয়ে আলোচনা করলে সাতবাহন সাম্রাজ্যের আলোচনার বিষয় আরো সমৃদ্ধ হবে। গৌতমীপুত্র সাতকর্ণী এবং বশিষ্ঠীপুত্র পুলুমারির সরকারি দলিল এবং ব্যক্তিগত নথিপত্র থেকে বৃহৎ সাতবাহন সাহাজ্যের রাষ্ট্রব্যবস্থার কথা জানা যায়। সাতবাহন রাজতন্ত্র ছিল বংশানুক্রমিক। সাতবাহন রাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থা বিষয়ে অধ্যাপক ড. গোপালাচারী সাতবাহন রাষ্ট্রকে 'পুলিশ রাষ্ট্র' আখ্যা দিয়েছেন। তিনি বলেন, 'চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের ধর্মনিরপেক্ষ সামরিক রাষ্ট্রের মতো সাতবাহন রাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থা জটিল ছিল না। এটা ছিল সহজ ও সরল। সাতবাহন রাজারা দৈব অধিকারে বিশ্বাসী ছিলেন না, নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী হলেও তাঁরা শাস্ত্র অনুসারে রাজ্যশাসন করতেন। রাজা ছিলেন প্রশাসনের শীর্ষে। তিনি একাধারে মুখ্য প্রশাসক ও সেনাবাহিনীর অধ্যক্ষ। রাজারা বহুপত্নীক ছিলেন। তাই অনেক সময় রাজকুমারেরা মাতার পরিচয় গ্রহণ করতেন। রাজার জ্যেষ্ঠ পুত্রকে যুবরাজ বলা হত। অন্য, সকল রাজপুত্রকে কুমার বলা হত। রাজার মৃত্যুকালে জ্যেষ্ঠপুত্র নাবালক হলে রাজার ভাই অথবা রানি রাজ্য শাসন করতেন। রাজ্য স্বয়ং যুদ্ধক্ষেত্রে সেনাপতি হিসাবে যুদ্ধ পরিচালনা করতেন।
সাতবাহন সাম্রাজ্য কতগুলি প্রদেশে বিভক্ত ছিল। এই প্রদেশগুলিকে বলা হত জনপদ। প্রদেশগুলি আবার কতগুলি জেলাতে বিভক্ত ছিল। এই বিভাগগুলিকে বলা হত আহার। জেলাগুলি আবার অনেকগুলি গ্রামে বিভক্ত ছিল। গ্রাম পরিচালকদের গ্রামিক বলা হত গ্রামগুলি থেকে রাজস্ব ও সৈন্য সংগ্রহ করা হত। ঐতিহাসিক ড. রায়চৌধুরীর মতে, প্রতি জনপদ অথবা আহারে বেসামরিক এবং সামরিক দুই শ্রেণির শাসক থাকতেন। বেসামরিক শাসককে অমাত্য বলা হত এবং সামরিক শাসককে মহাসেনাপতি, মহারানী, মহাভোজ
এমনকি রাজন বলা হত। ড. গোপালাচারী এই সামরিক শাসকদের পৃথক সামস্ত হিসাংে চিহ্নিত করেছেন এবং তাঁর মতে একই এলাকায় এদের সমান্তরাল অধিকার ছিল না। তিনি মনে করেন যে, অমাত্যপদ বংশানুক্রমিক ছিল না এবং অমাত্যগণকে প্রায়ই স্থানান্তরে বদলি করা হত। প্রজাদের দেয় করের সংখ্যা ছিল কম এবং তা তেমন গুরুভার ছিল না। সাতবাহন সাম্রাজ্যের আয়ের উৎস ছিল রাজকীয় জমি, ভূমি কর, লবণ কর, জরিমানা ইত্যাদি। রাজার প্রত্যক্ষ শাসনাধীন অঞ্চল কতকগুলি আহারে বিভক্ত ছিল। গোবর্ধন, সোপারা, মামাল, সাতবাহনীয় প্রভৃতি কয়েকটি আহারের উল্লেখ পাওয়া যায়। আহারের শাসনভার ছিল অমাত্য পদবির কর্মচারীদের ওপর। তাঁদের ওপর রাজার কঠোর নিয়ন্ত্রণ ছিল। আহারস্থিত কোনও জমি হস্তান্তরের অধিকার তাঁদের ছিল না এবং স্বনামে মুদ্রা চালু করার ক্ষমতাও তাঁদের ছিল না।
প্রশাসনিক কাজে রাজাকে সাহায্য করতেন সামন্ত নৃপতিগণ। সর্বাপেক্ষা ক্ষমতাশালী সামন্তগণ রাজা উপাধি গ্রহণ করতেন এবং নিজের নামে মুদ্রা প্রকাশ করতেন। সামন্তদের পরে ক্ষমতাবান ছিলেন মহারঠী ও মহাভোজগণ। সামরিক এই পদ দুটি ছিল বংশানুক্রমিক। পররর্তীকালে শাসন পরিচালনার মহাসেনাপতি ও মহাতলবর দুই শ্রেণির সামন্তপদ সৃষ্টি করা হত। এরা নিজেদের নামে মুদ্রাও চালু করতেন।
এছাড়াও প্রশাসনিক ক্ষেত্রে আরো কতগুলি পদের কথা জানা যায়। রাজার বিশেষ আস্থাভাজন ও উপদেষ্টাদের একজন ছিলেন রাজমাত্য। বিশেষ বিশেষ কাজের দায়িত্বে ছিলেন মহামাত্র। ভান্ডাগারিকেরা ছিলেন ভান্ডারী, রাজকীয় দলিল দস্তাবেজের দায়িত্ব ছিল লেখকদের। দূতক হলেন বার্তাবাহক, হেরণিক হলেন কোষাধ্যক্ষ। সাতবাহন সমাজে বণিক সংঘ বা গিল্ডগুলির শক্তিশালী উপস্থিতির প্রমাণ পাওয়া যায়।
পরিশেষে বলা যায় যে, সাতবাহন সাম্রাজ্যের সময়কাল দক্ষিণ ভারতের ইতিহাসে অতি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এসময় শুধু যে দক্ষিণ ভারতের এক বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে রাজনৈতিক ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হল তাই নয়, সার্বিক ক্ষেত্রে এক সকল স্তরে এক সৃজনধর্মী কর্মকান্ডের অভিব্যক্তি দেখা দিল যার এক ফলশ্রুতি সাতবাহন প্রশাসনিক ব্যবস্থা।
তোমাকে অনেক ধন্যবাদ সাতবাহন সাম্রাজ্যের প্রশাসনিক ব্যবস্থা বিষয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা। এই নোটটি পড়ার জন্য