শেরশাহের কৃতিত্ব সম্পর্কে আলোচনা কর অথবা, শেরশাহের কৃতিত্ব মূল্যায়ন কর
![]() |
![]() |
উচ্চতায় সুর সাম্রাজ্যের মানচিত্র |
শেরশাহ ছিলেন মধ্যযুগে ভারতবর্ষের ইতিহাসের অন্যতম একজন সুদক্ষ প্রশাসক ৷ নরপতির কর্তব্য সম্বন্ধে তিনি পূর্ণ সচেতন ছিলেন ৷ তিনি মনে করতেন বড় হতে গেলে কর্মঠ হওয়া একান্ত প্রয়োজন ৷ শেরশাহের সাম্রাজ্য ছিল জনসাধারণের কল্যাণ করার ইচ্ছার উপর প্রতিষ্ঠিত ৷ তাই আরস্কিন শেরশাহের জনসাধারণের অভিভাবক হিসেবেও দেখেছেন ৷ শের শাহ ছিলেন আলাউদ্দিন খলজী ও মোহাম্মদ বিন তুঘলকের মত ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র শাসনের পক্ষপাতি ।
![]() |
আফগান শিল্পী আব্দুল গফুর ব্রেশনার শের শাহ সুরির কল্পনাকৃত স্কেচ |
কেবলমাত্র সমর বিজয়ী নেতা নয় সাম্রাজ্যের সংগঠক হিসেবে শেরশাহের অন্যান্য কৃতিত্বের দাবিদার ৷ পাঁচ বছরের রাজত্বকালে তিনি রাজ্য জয় ও বিদ্রোহ দমনের সঙ্গে একটি শাসনতান্ত্রিক পরিকাঠামো গড়ে তুলতে সচেষ্ট ছিলেন এবং সফল ও হয়েছিলেন ৷ সমস্ত দিন অক্লান্ত পরিশ্রম করে প্রশাসনের প্রতিটি খুঁটিনাটি বিষয় তার নজরে থাকতো ৷ তাই আরস্কিন মন্তব্য করেছেন," আকবরের পূর্ববর্তী যে কোন শাসকের তুলনায় আইন প্রণেতা ও জনগণের অভিভাবকের প্রেরণা শেরশাহের মধ্যে বেশি ছিল ৷"
![]() |
মুঘল সম্রাট হুমায়ুনের প্রতিকৃতি |
স্বৈরাচারী হলেও তার রাজ শাসনের আদর্শ ছিল প্রজা কল্যাণমূলক ৷ জমির ব্যাপক জরিপ এবং উৎপাদিকা শক্তি অনুযায়ী রাজস্ব নির্ধারণের ব্যবস্থা থেকে যে আকবর ও শিক্ষা নিয়েছিলেন এ কথা অস্বীকার করা যায় না ৷ এইভাবে তার প্রশাসনিক দক্ষতা লক্ষ্য করা যায় মুদ্রা সংস্কারের মধ্যেও , তার মধ্যে সংস্কারের প্রশংসা করে ইম্পেরিয়াল গেজেটিয়ার স্বীকার করেছেন যে," ভারতের ব্রিটিশ শাসনের সময় ও শেরশাহের মুদ্রা নীতির প্রভাব অম্লান ছিল ৷" পথঘাট নির্মাণ ও সম্প্রসারণ,সরাইখানা স্থাপন ব্যবসা- বাণিজ্যের প্রসার , সুদক্ষ পুলিশি ব্যবস্থা প্রবর্তন , জায়গির ব্যবস্থা সংকোচন, জ্ঞানীগুণীদের পৃষ্ঠপোষকতা প্রভৃতি প্রতিটি কাজের মধ্য দিয়ে তার প্রতিভার প্রকাশ পেয়েছেন ৷
![]() |
শের শাহ সূরির প্রতিকৃতি এবং একটি সিংহ তাকে প্রণাম করছে/আত্মসমর্পণ করছে। |
শেরশাহের ধর্মীয় উদারতা সম্পর্কে কিছুটা সন্দেহের অবকাশ আছে বলে অনেকের ধারণা মনে করে ৷ হিন্দুদের প্রতি শেরশাহ উদারতা প্রচার করতেন বিচার ও নিয়োগের ক্ষেত্রে হিন্দু মুসলমানদের মধ্যে পার্থক্য করা হতো না ৷ ঘৃণা মিশ্রিত অত্যাচারের পরিবর্তে শ্রদ্ধাপূর্ণ স্বীকৃতি প্রধান ছিল তার হিন্দু নীতির বৈশিষ্ট্য ৷ কিন্তু শ্রী. রামশর্মা মনে করেন," শেরশাহ এর মধ্যে ধর্মীয় আনুগত্য ছিল কারণ তিনি হিন্দুদের ওপর যে জিজিয়া কর তুলে দেন নি কিংবা তিনি ইসলামের জিহাদ ঘোষণা করেছিলেন এই সকল দৃষ্টান্ত থেকে বলা যায় শেরশাহের চরিত্রে কিছুটা সংকীর্ণতা রয়েছে ৷ কিন্তু এ কথা সত্য ধর্মীয় গ্রামের দ্বারা তিনি রাজনীতি নির্ধারণ করেননি ৷ তিনি যথার্থ বুঝেছিলেন ভারতবর্ষের ধর্ম সমন্বয় একান্ত প্রয়োজন ৷
![]() |
উত্তর ভারতের আফগান সম্রাট শের শাহ সুরির প্রতিকৃতি (1538-1545) |
শেরশাহকে মহান মুঘল সম্রাট আকবরের সাথে তুলনা করার একটা প্রবণতা ইতিহাসে লক্ষ্য করা যায় ৷ ড. কানুনগো তার "Shershah" শীর্ষক গ্রন্থে বলেছেন আকবরের চেয়েও অগ্রণী সাংগঠনিক প্রতিভা ও জাতীয় রাষ্ট্রের শ্রদ্ধা ছিলেন কিন্তু আকবরের উদারতা খুঁজে পাওয়া যায় না ।" তাই বলা চলে শের শাহ ছিলেন মধ্যযুগীয় সুলতানদের শ্রেষ্ঠ প্রতিনিধি কিন্তু আকবর ছিলেন আধুনিক ধারার প্রথম সৈনিক এবং ভারতের প্রথম জাতীয় শাসক ৷
![]() |
1538-1545 খ্রিস্টাব্দে শের শাহ সুরি কর্তৃক প্রকাশিত রুপিয়া ছিল প্রথম রুপি। |
কিছু ত্রুটি সত্বেও শেরশাহকে অন্যতম শ্রেষ্ঠ সুলতান বলেও কুন্ঠিত হবার কোনো কারণ নেই ৷ মধ্যযুগীয় সামাজিক ও ধর্মীয় বাধ্য বাধাকতার মধ্যে তিনি যে উদার ও উদারতা ও নৈপুণ্য দেখিয়েছিলেন তা প্রশংসা যোগ্য ৷ অধ্যাপক যে এন চৌধুরীর ভাষায় বলা চলে জনগণের প্রতি তার ভালোবাসা ও সহানুভূতি কৃষকদের স্বার্থ সম্পর্কে সতর্ক দৃষ্টি উদার দৃষ্টিভঙ্গি নিরপেক্ষ বিচার চেতনা অক্লান্ত পরিশ্রম কর্তব্যের নিষ্ঠা এবং সর্বোপরি গঠনমূলক প্রবৃদ্ধির নানা দিক বিবেচনা করে তাকে পূর্বসূরীদের থেকে অনেক উপরে এবং আকবরের ঠিক পরের স্থান দেওয়া উচিত।