খানুয়ার যুদ্ধ (১৫২৭ খ্রিস্টাব্দ) সম্পর্কে আলোচনা কর অথবা, খানুয়ার যুদ্ধের গুরুত্ব,তাৎপর্য, প্রেক্ষাপট ও ফলাফল আলোচনা কর ৷
খানুয়ার যুদ্ধ বলতে কী বোঝো এবং এই যুদ্ধের ফলাফল আলোচনা কর
খানুয়ার যুদ্ধের গুরুত্ব বা তাৎপর্য ছিল সুদূর প্রসারী| ঐতিহাসিক ঈশ্বরী প্রসাদ এর ভাষায়,"The battle of Khanwa is one of the decisive battle of Indian History" ৷ প্রকৃতপক্ষে খানুয়ার যুদ্ধকে ভারতের ইতিহাসে অন্যতম চূড়ান্ত সীমা মীমাংসক যুদ্ধ বলা যেতে পারে ৷ ফলাফলের দিক থেকে বিচার করলে, খানুয়ার যুদ্ধের তাৎপর্য পানিপথের যুদ্ধ অপেক্ষা অধিক গুরুত্বপূর্ণ।
অধ্যাপক এস রায়ের মতে, পানিপথের যুদ্ধ জয় লাভ করে বাবর দুর্বল লোদী রাজ বংশের অবসান ঘটিয়ে দিল্লি অধিকার করেন মাত্র ৷ মেবারের রাজপুত নেতা রানা সংগ্রাম সিং বাবরকে ভারত আক্রমণে পর্যাপ্ত সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি প্রদান করলেও তিনি তা রক্ষা করেন নি । রানা সংগ্রাম সিংহের মূল উদ্দেশ্য ছিল বাবর তাঁর পূর্বপুরুষ তৈমুর লঙের ন্যায় ভারতবর্ষ লুণ্ঠন করে নিজ দেশে ফিরে যাবেন । তখন রানা সংগ্রাম সিংহ ইব্রাহিম লোদীকে পরাজিত করে দিল্লি সালতানাতের ধ্বংসস্তুপের উপর হিন্দু রাজ্য প্রতিষ্ঠা করবেন ।
কিন্তু ১৫২৬ খ্রিস্টাব্দে বাবর ঐতিহাসিক পানিপথের প্রথম যুদ্ধে লোদী বংশের অবসান ঘটিয়ে ভারতীয় উপমহাদেশে মুঘল বংশের গোড়াপত্তন করলে রাজপুত শক্তি মেবারের রানা সংগ্রাম সিংহের নেতৃত্বে বাবরের বিরোধিতা শুরু করে । রানা সংগ্রাম সিংহ বিলসার সিলহদা, ধুনগড়ের উদয়সিংহ, মারবাড়ের ভীমসিংহ, চান্দেরীর মেহেদী রাও প্রমুখ অসংখ্য রাজপুত সর্দার এবং হাসান খান মেওয়াটির সাহায্যে একটি শক্তিশালী সামরিক জোট গঠন করেন । সম্মিলিত সামরিক জোটে রানা সংগ্রাম সিংহের নেতৃত্বে ১২০ জন রাজপুত সর্দার, ৮০ হাজার অশ্বারোহী ৫ শত হস্তী বাহিনী এবং বিপুল সংখ্যক স্বেচ্ছাসেবক বাবরের বিরুদ্ধে যুদ্ধপ্রস্তুতি গ্রহণ করে । বিপুল সংখ্যক সৈন্যের বিরুদ্ধে বাবর মাত্র অল্প সংখ্যক সৈন্য নিয়ে স্বয়ং সেনাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন । রানা সংগ্রাম সিংহের নেতৃত্বে রাজপুতদের সমন্বয়ে গঠিত এই বিশাল বাহিনীর ভয়ে ভীতসন্ত্রস্ত্র ক্ষুদ্র বাহিনীকে বাবর ফ্রান্সের সম্রাট নেপোলিয়ন বোনাপার্টের (১৭৬৯-১৮২১ খ্রি.) ন্যায় এক অনলবর্ষী ও তেজোদীপ্ত ভাষণ দ্বারা অগ্নিমন্ত্রে উদ্বুদ্ধ করেন । ১৫২৭ খ্রিস্টাব্দের ১৬ই মার্চ আগ্রার অনতিদূরে ফতেহপুর সিক্রির নিকট খানুয়ার যুদ্ধ সংঘটিত হয় । এক বিরাট সৈন্যবাহিনী নিয়ে বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করা সত্ত্বেও যুদ্ধ কৌশলের অপকর্ষতার ফলে রানা সংগ্রাম সিংহের নেতৃত্বাধীন সম্মিলিত বাহিনী শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয় । মুঘল শক্তিকে প্রতিহত করার মত আর কোন শক্তি থাকে না ।
খানুয়ার যুদ্ধের ফলাফল
ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে যে সকল যুদ্ধ ভাগ্য-নিয়ন্ত্রণকারী যুদ্ধ নামে পরিচিত সেগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল খানুয়ার যুদ্ধ । ১৫২৬ খ্রিস্টাব্দের ঐতিহাসিক পানিপথের যুদ্ধের পর ১৫২৭ খ্রিস্টাব্দের খানুয়ার যুদ্ধ অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ । কেননা পানিপথের প্রথম যুদ্ধে দিল্লির লোদী বংশের সর্বশেষ নামমাত্র সুলতান ইব্রাহিম লোদী পরাজিত হয়েছিলেন । কিন্তু খানুয়ার যুদ্ধের ফলে ভারতে শক্তিশালী ঐক্যবদ্ধ রাজপুত শক্তির শোচনীয় পরাজয় ঘটে । এই যুদ্ধে পরাজয়ের ফলে রানা সংগ্রাম সিংহের হিন্দু রাজ্য প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন চিরতরে বিনষ্ট হয়ে যায় এবং রাজপুত শক্তির প্রাধান্য ক্ষুণ্ণ হয় ।
খানুয়ার যুদ্ধকে বাবরের শেষ আত্মরক্ষার যুদ্ধ বলা যায়, কারণ কারণ এই যুদ্ধের ফলে বাবরের দিল্লির সিংহাসন চ্যাতির আর কোনো সংশয় থাকল না । খানুয়ার যুদ্ধে জয়লাভের ফলে বাবরের প্রাধান্য ও ভারতবর্ষে মুঘল সাম্রাজ্যের ভিত্তি সুদৃঢ়ভাবে স্থাপিত হয়েছিল । বাবর এই যুদ্ধে জয়লাভের পর তাঁর ক্ষমতার মূল কেন্দ্রবিন্দু কাবুল থেকে দিল্লিতে স্থানান্তর করেন । খানুয়ার যুদ্ধে রাজপুত শক্তির পুনরুজ্জীবনের আশা স্থায়ীভাবে বিলুপ্ত করে বিজয়ের নিদর্শনস্বরূপ জহির উদ্দিন মুহম্মদ বাবর 'গাজী' উপাধি ধারণ করেন । খানুয়ার যুদ্ধের পর বাবর যেসব যুদ্ধ করেছিল, সেগুলি ছিল সম্রাজ্য সম্প্রসারনের যুদ্ধ । তারপরে বাবরকে আর আত্মরক্ষার যুদ্ধ করতে হয়নি ৷
তথ্যসূত্র
1. সতীশ চন্দ্র, "মধ্যযুগে ভারত"
2. অনিরুদ্ধ রায়, "মুঘল সাম্রাজ্যের উত্থান-পতনের ইতিহাস"
3. Chandra Satish, "A History of Medieval India".