মধ্যযুগের ভারতীয় সমাজ রাষ্ট্রের জীবনে সুফিবাদের প্রভাবগুলি আলোচনা করো। অথবা, সুলতানি যুগে সুফিবাদের বৈশিষ্ট্যগুলি আলোচনা করো।

আপনি চাইলে এগুলো পড়তে পারেন
মধ্যযুগীয় ভারতের সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক ইতিহাসের সুফি আন্দোলনের গুরুত্ব আলোচনা কর

হযরত মুহাম্মদ এর মৃত্যুর পর থেকে ইসলাম ধর্ম নানা কুসংস্কার দেখা দেয় ৷ ইসলাম ধর্মের কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসেবে সুফিবাদী আন্দোলনের সূচনা হয় । খ্রিস্টীয় নবম শতাব্দীতে সুফি আন্দোলনের উন্মেষ ঘটে ৷ তবে সুফিবাদিদের পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটে চতুর্দশ ও পঞ্চদশ শতাব্দীতে ৷সুফিবাদের ভিত্তি হলো 'কোরান' ৷
আপনি চাইলে এগুলো পড়তে পারেন
সুফিবাদের উৎপত্তি সম্পর্কে পণ্ডিতরা কোন ঐক্যমত সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেন নি ৷ ঐতিহাসিক ইউসুফ হোসেন এর ভাষায় ইসলামের বক্ষদেশ থেকেই সুফিবাদের জন্ম ৷" ফিলিপ হিস্ট্রি ভাষায়,"সুফিবাদ হল ইসলামের অতীন্দ্রিয় রূপ ৷" এটি কেবল কতগুলি তথ্যের সমাবেশ নয় সুবিবাদের ভিত্তি হল ধর্ম বিষয় কিছু গভীর ভাবনা ও অনুভূতি ৷ কিছু কিছু গবেষক মনে করেন বৌদ্ধ ধর্ম,হিন্দু বেদান্ত দর্শন ও অন্যান্য ধর্মের সমন্বয়ে সুখীবাদের উৎপত্তি হয়েছে ৷ আবার কিছু গবেষক মনে করেন বৌদ্ধ ও হিন্দু বেদান্ত দর্শন নয় কোরানই সুফিবাদের উৎস ৷
সুফি শব্দটির 'সুফ' বা সাফা থেকে এসেছে সুফ কথার অর্থ হলো মোটা পশমের বস্ত্র পরিধান করে ৷ আর সাফা কথাটির অর্থ হল পবিত্র জীবন । সুফিবাদের মূল বক্তব্য হল ঈশ্বর একটা মানুষ তার সন্তান ৷ মানুষকে ভালোবাসা হলো ঈশ্বরের আশীর্বাদ পাওয়া ৷ জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষ সমান ধর্মীয় রীতিনীতি অপেক্ষা সৎ জীবন যাপনের মাধ্যমে ঈশ্বরকে লাভ করা সম্ভব ৷
সুফিবাদিরা মনে করেন গুরু ছাড়া ঈশ্বরকে লাভ করা সম্ভব নয় ৷ সুফি মতবাদের গুরুকে বলা হয় পীর ৷ পীরের কর্মকেন্দ্র কে বলা হয় দরগা বা খানকা ৷ পীরের নির্দেশ সুফি অনুগামীদের কতগুলি আবশ্যিক পালনীয় কর্তব্য পালন করতে হয় । এই আবশ্যিক পালনীয় কর্তব্য গুলি হল নামাজ, রোজা,হজ, সবর, ফকর,খুফ,তাওয়া, ওয়াবা, তাওয়াস্কুল ৷
আরবদের সিন্ধু বিজয়ের সময় থেকে সুফি ধর্মের পোশাক শুরু হয় ৷ সুফি মতাদর্শ অনুসারে এদেশে সুফিরা দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যে ১৪ টি সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভক্ত ছিল ৷ যার মধ্যে প্রধান দুটি সম্প্রদায় জনপ্রিয় হয়ে ওঠে সেগুলি হল চিশতী ও সুরাবাদী সম্প্রদায় ৷ চিশতি সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন খাজা মইনুদ্দিন চিশতী ৷ তিনি হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মানুষকে সমান চোখে দেখতেন তাই তিনি বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষের কাছে শ্রদ্ধা অর্জন করেছিলেন ৷ ঐতিহাসিক আমির খসরু ও জিয়াউদ্দিন বরণী তার শীর্ষ ছিলেন ৷ সূরাবর্দী সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন শিহাব উদ্দিন শিহাবউদ্দিন সুরাবর্দী ৷ সুরাবর্দীরা কঠোর সংযম ও দরিদ্র জীবন পছন্দ করতেন না ৷ এই সম্প্রদায়ের প্রখ্যাত সন্ত ছিলেন সদর উদ্দিন আরিফ,জালাল উদ্দিন বুখরী প্রমুখ ৷
মধ্যযুগীয় সমাজ ব্যবস্থার রূপায়ণের ক্ষেত্রে সুফিরা একটি সামাজিক শক্তি হিসেবে কাজ করেছিলেন ৷ সুফিবাদের সহজ সরল জীবনযাত্রা চারিত্রিক মাধুর্য ও গভীর নীতিবোধ সাধারণ মানুষকে মুগ্ধ করেছিল । সুফীবাদের সার্বজনীন আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে সামাজিক সাম্য ও সহনশীলতার শিক্ষা নিয়েছিলেন সুফিবাদের সর্বজনীন আদর্শ ও ধর্মীয় উত্তেজনা প্রশমিত করে ৷ হিন্দু মুসলমানের সম্পর্কেও সবারিল করে তুলতে সাহায্য করেছিলেন ৷ সুফিবাদের সাম্য ভাবনা খুব সঙ্গত কারণে আকৃষ্ট করে সমাজের নিম্ন বর্ণের মানুষকে সুফি সাধকগণ হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে ধর্মীয় সহনশীলতা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ইতিবাচক সামাজিক পরিবেশ গড়ে তোলেন ৷
মধ্যযুগের শিক্ষা ও সাহিত্যের উপর সুফি আন্দোলনের প্রভাব ছিল লক্ষণীয় ৷ সুফিরা হিন্দু ও হিন্দি ও উর্দু ভাষার সমন্বয়ে হিন্দি ভাষার কবিতা রচনা করার ফলে তা সাধারণ মানুষের বোধগম্য হয় ৷ ফলে এই সময় হিন্দি ভাষা বৃদ্ধি ঘটেছিল সঙ্গীতেও কেউ ঈশ্বরের আরাধনার অন্যতম মাধ্যম বলে এরা মনে করতেন ৷ তাই ঐতিহাসিকদের ভাষায় বলা যায় যে," সুফিবাদ উভয় সম্প্রদায়ের সামাজিক সাংস্কৃতিক নেতৃত্বে উদার হৃদয় বৃত্তার ও সহনশীলতার বিকাশ ঘটায় ধর্মীয় সাহসিকতার বিকাশ ঘটায় এবং উভয় সম্প্রদায়ের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে সমন্বয়ের ক্ষেত্রে প্রস্তুত করে ৷"
উপরীয়ক্ত আলোচনা থেকে স্পষ্ট যে সুফিবাদ হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে সমন্বয়ে ঘটিয়েছিল ৷ ভারতের জাতীয় সংহতি শান্তি ও মৈত্রীর ক্ষেত্রে সুফিবাদের অবদান স্মরণীয়, তবে প্রচলিত ইসলামীয় ঐতিহ্যকে অস্বীকার করে চলায় সুফিরা তাদের শেষ পর্যন্ত গুরুত্ব হারায় ৷