কিভাবে শক শাসক রুদ্রদামন ভারতে শক শক্তির পুনরুত্থান ঘটিয়েছিলেন।
চষ্টনের পৌত্র রুদ্রদামন ছিলেন শক-ক্ষত্রপদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ। জুনাগড় লিপি থেকে রুদ্রদামনের কীর্তি-কলাপের কথা জানা যায় । এই রুদ্রদামনের লিপিটি সংস্কৃত গদ্যে রচিত। এটিকে একটি প্রশস্তি বলে গণ্য করা যায় । আনুমানিক ১৫০ খ্রিঃ এটি রচিত হয় । আন্ধাউ লেখ থেকে জানা যায় যে, তিনি পিতামহ চষ্টনের সঙ্গে যুগ্মভাবে কিছুকাল রাজত্ব করেন । ড. জে. এন. বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে, এর দ্বারা বোঝান হচ্ছে যে, রুদ্রদামন যোগ্যতা ও বাহুবলে মহাক্ষত্রণ পদ লাভ করেন।
আপনি চাইলে এগুলো পড়তে পারেন
জুনাগড় লিপিতে রুদ্রদামন যে সকল স্থান জয় করেন তার একটি তালিকা দেওয়া আছে । এই তালিকাটি দেখে পণ্ডিতেরা মনে করেন যে, শক অধিকৃত যে সকল স্থান সাতবাহন সম্রাট গৌতমীপুত্র অধিকার করেছিলেন তার অধিকাংশ স্থান রুদ্রদামন পুনরুদ্ধার করেন । রুদ্রদামন তাঁর পিতামহ চষ্টিনের সহকারী ছিলেন । হয়ত সেই সময় থেকেই তাঁর এই জয়লাভের যুগ আরম্ভ হয়েছিল । রুদ্রদামন জনাগড় লিপিতে বলা হয়েছে যে, তিনি "দক্ষিণাপথপতি সাতকর্নীকে" দুবার পরাজিত করেন । কিন্তু "সম্বন্দ্ব বিবুদ্ধাত্বয়া" বা "অদূর আত্মীয়তার" জন্য তিনি সাতবাহন শক্তিকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করা থেকে বিরত থাকেন ।
রুদ্রদামনের সঙ্গে সাতবাহনদের কিরুপ আত্মীয়তা হয় এবং তাঁর সাতবাহন প্রতিদ্বন্দ্বী কে ছিলেন এ সম্পর্কে পণ্ডিতেরা বিভিন্ন মত দিয়েছেন । র্যাপসনের মতে, রুদ্রদামন যে সকল সম্মান জয় করেন বলে জুনাগড় লিপিতে বলা হয়েছে, সেই স্থানগুলি গৌতমীপুত্র সাতকণীর অধীনে ছিল বলে নাসিক প্রশস্তিতে বলা হয়েছে । সুতরাং এ থেকে প্রমাণ হচ্ছে যে রুদ্রদামন, গৌতমীপুত্রকে পরাস্ত করে এ সকল স্থান অধিকার করেন । গৌতমীপুত্র সম্পূর্ণ পরাজয় এড়াতে রুদ্রদামনের কন্যার সঙ্গে নিজ পুত্র বশিষ্টিপুত্র পুলুমায়ির বিবাহ দেন ৷ র্যাপসন তাঁর মতের সমর্থনে বলেন যে, কান্থেরী লিপিতে বশিষ্টিপুত্র শ্রী সাতকর্ণী তাঁর পত্নীকে মহাক্ষত্রপ রুদ্রের কন্যা বলে উল্লেখ করেছেন। ড. গোপাল আচারির মতে, জুনাগড় লিপিতে যে সাতকর্ণীর নাম পাওয়া যায় তিনি ছিলেন শিবস্কন্দ সাতকণীর বংশধর। ড. ভান্ডারকরের মতে, এই প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন গৌতমীপুর কিন্তু বুদ্রদামনের জামাতা ছিলেন শিবস্কন্দ-সাতকর্ণী । বেশির ভাগ পণ্ডিতের মতে, জুনাগড় লিপিতে যে সাতকর্ণীকে রুদ্রদামনের জামাতা বলা হয় তিনি ছিলেন গৌতমীপুর সাতকর্ণীর অন্য পুত্র এবং বশিষ্টিপুত্র পুলুমায়ির ভ্রাতা।
রুদ্রদামনের রাজ্যসীমার ভিতরে ছিল মালব, অনুপ, সৌরাষ্ট্র, কাথিয়াবাড়, কোক্ষন, মুরা বা মারবাড়, কচ্ছ, সিন্ধু উপত্যকা । শেষোক্ত স্থান সম্ভবত কুষাণদের কাছ থেকে তিনি জয় করেন । রাজপুতানার যৌধেয়গনকে তিনি পরাস্ত করেন । তিনি 'মহাক্ষত্রপ' উপাধি নেন। রুদ্রদামন কেবলমাত্র বিজেতা ছিলেন না। ন্যায়পরায়ণ, সংস্কৃতিমনা ও প্রজাহিতৈষী শাসক হিসাবে তিনি খ্যাতি পান । চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের তৈরি জলসেচের জন্য সুদর্শন হ্রদের বাঁধ বন্যায় ভেঙ্গে গেলে তিনি তার সংস্কার করে প্রজাদের বহু উপকার করেন। এজন্য যা ব্যয় হয় তিনি তা প্রজাদের কাছ থেকে কর হিসাবে না নিয়ে নিজ রাজকোষ থেকে দেন । সকল সম্প্রদায়ের ও শ্রেণির লোকেদের তিনি সমান চোখে দেখতেন।
রুদ্রদামনের ব্যক্তিগত গুণাবলী কম ছিল না। তিনি ছিলেন সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষক । জুনাগড় লিপি তার সাক্ষ্য । তিনি সংস্কৃত ভাষায় কাব্য রচনা করেন । সঙ্গীত, তর্কশাস্ত্র, ব্যাকরণে তাঁর ব্যুৎপত্তি ছিল অগত । তাঁর আমলে শক জাতির ভারতীয়করণ সম্পূর্ণ হয়েছিল । এজন্য তাঁর ব্যক্তিগত উদ্যোগ কম ছিল না। তিনি গর্বিত ভারতীয় রাজবংশগুলি, যথা-সাতবাহন, ইক্ষাকু, লিচ্ছবিদের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করে শক জাতির আত্মমর্যাদাকে প্রতিষ্ঠা করেন । সকল দিক থেকে বিচার করলে প্রাচীন ভারতের শ্রেষ্ঠ রাজাদের তালিকায় রুদ্রদামনের স্থান পেতে পারেন । তাঁর রাজত্বকাল শুরু হয়েছিল সম্ভবত ১৩০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে । তিনি অন্তত ১৫০ খ্রিঃ পর্যন্ত রাজত্ব করেন ।
রুদ্রদামনের পরে শক-ক্ষত্রপদের মধ্যে তেমন কোন উল্লেখযোগ্য নাম পাওয়া যায় নি । যদিও বহু শক-ক্ষত্রপের নাম মুদ্রা ও লিপি থেকে পাওয়া যাই তাঁদের বিশেষ কোন কৃতিত্বের কথা জানা যায় নি । বিশ্বসেন ছিলেন সর্বশেষ কর্দমাক শরু ক্ষত্রপ যিনি ২৯৩-৩০৫ খ্রিঃ রাজত্ব করতেন । এর পর বুরসিংহ ক্ষত্রপের পদে বসেন ৷ তিনি কর্দমার্ক বংশের লোক ছিলেন না ৷ শক-শক্তির পতন ঘটার কারণ ছিল শকদের মধ্যে অন্তদ্বন্ধ, সাসানীয় আক্রমণ। উত্তর-পশ্চিম ভারতে পারস্যের সাসানীয় শক্তির বিস্তার হলে শক শক্তির পতন ঘটে । এছাড়া পশ্চিম ভারতে গুপ্ত সাম্রাজ্যের বিস্তার ও চতুর্থ খ্রিঃ দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত দ্বারা শক-শক্তি থংস হলে শক-ক্ষত্রপদের পতন ঘটে ।