মধ্যযুগের ইতিহাস রচনার সাহিত্যিক উপাদান কতখানি গুরুত্বপূর্ণ
প্রাচীন ভারতের ইতিহাসের অর্থাৎ হিন্দুর রাজাদের রাজত্বকালে প্রাচীন ভারত বর্ষ সম্পর্কে জানার জন্য গ্রীক ইতিহাসবিদ হেরোডোডাস,থুকিডিডিস ও ইতালির লিভি, ট্যাসিটাসের ন্যায় ইতিহাসের প্রমান্য তথ্য ভারতবর্ষে পাওয়া যায় না । কিন্তু ভারতবর্ষের ইতিহাসে মধ্যযুগ, সুলতানি যুগ সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করার জন্য একাধিক লিখিত উপাদান আমাদের উক্ত সময়কাল সম্পর্কে জানতে সাহায্য করে ৷ যদিও সমস্ত লিখিত গ্রন্থ গুলি হয়তো আধুনিক ইতিহাস চর্চার আলোকে ঐতিহাসিক গ্রন্থ হিসেবে মর্যাদা দাবি করতে পারে না ৷
মধ্যযুগের ইতিহাসের প্রেক্ষাপট অর্থাৎ আরব দেশ সিন্ধু বিজয় সম্পর্কে জ্ঞান লাভের জন্য সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ প্রমান্য তথ্য হলো "চার্চ নামা" এছাড়াও সিন্ধুদের সম্পর্কে জানার ওপর গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ হল মীর মোহাম্মদ মাসুম রচিত 'তারিখ-ই-মাসুমি' এছাড়াও গজনীর সুলতান মাহমুদ কর্তৃক ভারত আক্রমণ ও সময়কালীন রাজনৈতিক সংঘাত সম্পর্কে ইতিহাস জানার ক্ষেত্রে মহম্মদ উতবী রচিত "কিতাব উল ইয়ামিনী" অন্য একটি অন্যতম ঐতিহাসিক উপাদান ৷ এছাড়াও আবু সৈয়দ রচিত "জৈন-উল-আকবর" গ্রন্থটিও খুবই কার্যকরী তথ্য সরবরাহ করে ৷ শুধু তাই নয় হোসেন আলী বারি রচিত "তারিক-ই-মুসুরি" অপর একটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ এই গ্রন্থে ১১৯২ থেকে ১২২৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়কালের ধারাবাহিকভাবে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে ৷
মধ্যযুগের ইতিহাস জ্ঞান লাভে ১২৬০ খ্রিস্টাব্দ রচিত মিনাজ-উস-সিরাজের "তহকক ই নাসিরি" এক অতি গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যিক উপাদান ৷ এই গ্রন্থে ১২৬০ থেকে ১২৬৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ইতিহাসের ধারা বর্ণিত রয়েছে ৷ সুলতানি যুগের প্রখ্যাত লেখক ছিলেন আমির খসরু, তার ঐতিহাসিক উপাদানের সমৃদ্ধ সুবিখ্যাত গ্রন্থ "খাজাইন-উল-ফতুহ" এতে সুলতান আলাউদ্দিন খলজী রাজত্বকালের বিস্তীর্ণ বিবরণ রয়েছে । শুধু তাই নয় আমির খসরুর রচিত "আশিকা" মসনভী এবং "তুঘলক নামা" গ্রন্থ দুটি তদন্তিনাথ ইতিহাসকে তিনি সুচারুভাবে চিন্তিত করেছেন ৷
সুলতানি যুগের ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক জিয়াউদ্দিন বরণী ছিলেন এক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব ৷ তার গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ "ফুতুহ জাহান্দারি" দাস বংশ থেকে তুঘলক বংশের রাজত্বকালের এক প্রমান্য গ্রন্থ ৷ এছাড়াও বরণী এই রচিত "তারিখ-ই-ফিরোজশাহী" মহম্মদ ইসামি রচিত"ফুতুহ-ই-সলাতিন" এবং ফিরোজ শাহ তুঘলকের আত্মজীবনীমূলক রচনা "ফুতুহ- ই-ফিরোজশাহী" হলো মধ্যযুগ সম্পর্কে জানার অন্যতম প্রধান গ্রন্থ ৷ এছাড়া আব্দুল্লার রচিত "তারিক-ই-দাউদি", আল বিরুনী রচিত "কিতাব-উল -হিন্দ" এবং ইবন বতুতার "কিতাব-উল-রেহেলা" ইত্যাদি গ্রন্থ মধ্যযুগের ইতিহাস রচনার অন্যতম সাহিত্যিক উপাদান ৷
পারসিক পর্যটক আব্দুর রাজ্জাক ১৪৪২ থেকে ৪৩ খ্রিস্টাব্দে কালিকটের জামরিনের রাজসভায় আগমন করেন ৷ তিনি বিজয়নগর পরিভ্রমণ করেন এবং বিজয়নগর রাজ্যের শাসন,সমাজ ও রাজনীতি ও অর্থনীতির অবস্থার এক বিশদ বিবরণ লিখেছেন ৷ যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ৷ তিনি লিখেছেন বিজয়নগরের উচ্চ-নিচ নির্বিশেষে সকল প্রজায় মূল্যবান রত্ন খচিত অলংকার পরিধান করতো ৷
এছাড়াও কয়েকজন ইউরোপীয় পর্যটক এর সুলতানি যুগের ভারতবর্ষে আসেন ৷ তারাও তাদের বিবরণে লিপিবদ্ধ করেছে ইতালীয় পর্যটক মার্কসপলো তার ভ্রমণ বিতান্ত দক্ষিণ ভারতের অর্থনৈতিক অবস্থার মূল্যবান তথ্য লিপিবদ্ধ করেন ৷ এছাড়াও আলবুকাকের লেখা ইতিহাসের উপাদান হিসেবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ৷ এদের বিবরণ আমূল্য এই জন্যই যে সমকালীন দক্ষিণ ভারতের রাজনৈতিক অর্থনৈতিক ও সংস্কৃতিক জগতের পরিপূর্ণ তথ্য পাওয়া যায় ৷ মহুয়ান নামের জৈনক চিন দেশীয় পর্যটক বাংলাদেশে এসেছিলেন ৷ তার বর্ণনা থেকে সমকালীন বাংলাদেশের ঐশ্বর্য ও প্রাকৃতিক সম্পদের উপাচুর্যের কথা জানা যায় ।
উপরীয়ক্ত আলোচনা শেষে বলা যায়, দিল্লির সুলতানি যুগের ইতিহাস রচনার ঐতিহাসিকদের লিখিত গ্রন্থ ও বিদেশি পর্যটকদের বিবরণ ইতিহাসের সাহিত্যিক উপাদান হিসেবে স্বীকৃত ৷ সাহিত্যিক উপাদানের সূত্র থেকেই দিল্লির সুলতানি আমলে ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে আমাদের সাহায্য করে ৷ এ কথা আমাদের স্বীকার করতেই হবে মুসলমান ঐতিহাসিক আমাদের সামনে একমাত্র আলোকবর্ত্তিকা ৷ তারাই ছিলেন সেদিন মধ্যযুগীয় ভারতীয় ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে অগ্রদূত ৷