আকবরের মনসবদারি ব্যবস্থা আলোচনা করো।

আকবরের মনসবদারি ব্যবস্থা আলোচনা করো।
মনসবদারী ব্যবস্থার প্রচলন
মুঘল সম্রাট আকবর তার শাসনকালে যে সকল শাসনতান্ত্রিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য এবং গুরুত্বপূর্ণ নাম হল 'মনসবদার'।
ডক্টর সতীশ চন্দ্র মনে করেন যে আকবর এই ব্যবস্থাকে একটি সঠিক নিয়মে বেঁধে তাতে কতগুলি বৈশিষ্ট্য যুক্ত করেন ৷ আকবর বিশাল ভারত-সাম্রাজ্য গঠনের পর রাজকীয় সেবার (Imperial service) ঐতিহ্য গঠনের যে ব্যাপক কর্মসূচী নেন, তারই ফলশ্রুতি হিসেবে এদেশে ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে মনসবদারী ব্যবস্থার প্রচলন ঘটে । মনসব কথাটির অর্থ হলো পদমর্যতা বা Rank ৷ এই পদমর্যাদার অধিকারী ব্যক্তিরায় মনসবদার নামে পরিচিত ৷ অবশ্য কেউ কেউ মনে করেন, আলাউদ্দিন খলজী কিংবা শের শাহের আমলেও কিছুটা স্বতন্ত্র ধারায় এই প্রথার প্রচলন দেখাগিয়ে ছিল ।
সিংহাসনে আরোহণের পরবর্তী আঠারো বছর আকবর পূর্বপ্রচলিত মুঘল সামরিক-ব্যবস্থা বহাল রেখেছিলেন । শিরিন মুসভির মতে, এই সময়ে রাজকর্মচারীদের নির্দিষ্টভাবে কোন সামরিক দায়িত্ব পালন করতে হত না । 'জায়গির' হিসেবে জমি ভোগদখলের পরিবর্তে আমিররা সেনাবাহিনী পোষণ করতেন এবং সম্রাটের প্রয়োজনে সেনা দিয়ে তাঁকে সাহায্য প্রদান করতেন । শুভ উদ্যোগ নিয়ে মনসবদারির প্রথার সূচনা হলেও এই প্রথা অনেকাংশই ত্রুটিপূর্ণ এবং সীমাবদ্ধতা লক্ষ্য করেন ।
প্রথমত, এই ব্যবস্থায় সম্রাট সেনাশক্তির জন্য সম্পূর্ণভাবে আমিরদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন।
দ্বিতীয়ত, আমীররা বিশাল জায়গির জমি এবং সামরিক বাহিনীর অধিকারী হওয়ার ফলে তাদের মধ্যে ক্ষমতার দম্ভ ও উচ্চাকাঙ্ক্ষা বৃদ্ধির সম্ভাবনা প্রবল হয়ে উঠে।
তৃতীয়ত, আমীরদের অর্থলোভ এবং মিথ্যাচারের জন্য সামরিক-বাহিনীর কর্মদক্ষতা ক্রমশ হ্রাস পেতে থাকে। এইরূপ বহুবিধ ত্রুটি থেকে সামরিক-বাহিনীকে রক্ষা করার উদ্দশ্যে আকবর একটা 'প্রশাসনিক কাঠামো' গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেন । আব্দুল আজিজের মতে, আকবর মনসবদারী ব্যবস্থা প্রবর্তনের সময় তুর্কো- আফগান যুগে প্রচলিত সামরিক-ব্যবস্থা দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন ।
মনসবদার পদ
মনসুর দাদীর নিয়োগ পদোন্নতি বদলি অপসারণ প্রকৃতি ক্ষেত্রে এই সম্রাটের ইচ্ছায় ছিল শেষ কথা বংশানুক্রমিকভাবে বা উত্তরাধিকার সূত্রে মনসবদারের পদ লাভ করা যেত না। এর জন্য প্রয়োজন ছিল কর্মদক্ষতা বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী মানুষকে মনসবদারের পদ প্রদান করা হতো ৷ সম্রাট এক ব্যক্তিকে প্রথমেই 'পাঁচ হাজারী' বা আরও উঁচু মনসবদারী দিতে পারতেন, তেমনি তিনি কোন কারণ না দেখিয়েই একজন উচ্চ মনসবদারের পদাবনতি ঘটাতে পারতেন । কোন মনসবদার তার প্রাপ্ত পদমর্যাদা অনুযায়ী কর্তব্যপালনে ব্যর্থ হলে তার পদাবনতি ঘটানো হত । তবে বংশানুক্রমিকভাবে প্রাপ্ত জায়গীর হঠাং জায়গীর এবং স্থায়ী জায়গীর তথ্য জায়গির নামে পরিচিত চার বছর পরপর নিয়মিত বদলি করা হতো । সম্রাট ইচ্ছা করলেই যে কোনো সময় মনসবদারদের পদচ্যুত করতে পারতেন ৷
আকবরের আগে পর্যন্ত মুঘল প্রশাসনের সামরিক বেসামরিক সমস্ত উচ্চপদস্থ কর্মচারীকে বেতনের বদলে জায়গীর প্রদান করা হতো । কিন্তু ধীরে ধীরে এই ব্যবস্থাই নানা দুর্নীতির অনুপ্রবেশ ঘটলে নতুন এক প্রথা প্রবর্তনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয় ৷ অপরদিকে যথেষ্ট হারে জায়গীর বিতরণ করায় খালিশা জমির পরিমাণ কমে যায় এই প্রেক্ষাপটে প্রবর্তিত হয় মনসবদারী প্রথা আবুল ফজল তার আইনে আকবরী গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে আকবর মনসবদারদের ৬৬ টি র্যাঙ্ক বা পদমর্যাদা স্তর ধার্য করেন সর্বনিম্ন স্তরে ছিল ১০ জন অস্ত্রহী। এবং সেনা বিশিষ্ট সেনাপতি এবং সর্বোচ্চ স্তরে ১০০০০ অশ্বারোহী সেরা বিশিষ্ট সেনাপতি তবে আবুল ফজলের ধারণায় কাগজে- কলমে 66 টি স্তর দেখানো হলেও প্রকৃত অর্থের মনসবদারীর ব্যবস্থায় ৩৩ টি স্তর ছিল বলে ইতিহাসবিদরা মনে করে থাকেন।
'জাট' ও 'সওয়ার'
একজন মনসবদার 'জাট' ও 'সওয়ার' এই দুটি পদের অধিকারী হতে পারতেন । এজন্য তাঁরা অতিরিক্ত অর্থের দাবিদার হতেন । 'জাট' পদ অনুসারে মনসবদার নির্দিষ্ট সংখ্যক হাতি, ঘোড়া, গোরু ও গো-শকট ইত্যাদি রক্ষণাবেক্ষণ করতেন এবং 'সওয়ার' পদ দ্বারা মনসবদারের অধীনে রক্ষিত ঘোড়াসওয়ার বাহিনীর সংখ্যা নির্দিষ্ট হত । কেউ কেউ মনে করেন, 'জাট' ও 'সওয়ার' পদ দুটি ছিল যথাক্রমে পদাতিক ও অশ্বারোহী বাহিনীর সূচক ।১৫৯৫-৯৬ খ্রিস্টাব্দে 'জাট' ও 'সওয়ার' সংখ্যার অনুপাত অনুযায়ী মনসবদারদের তিনটি শ্রেণীতে ভাগ করা যায় । যে মনসবদারের জাট ও সওয়ার সংখ্যা সমান, তিনি ছিলেন প্রথম শ্রেণীভুক্ত । যেমন, ২ হাজার জাট ও ২ হাজার সওয়ার । এইভাবে জাট সওয়ারের সংখ্যা জাট সংখ্যার অর্ধেক, তিনি ছিলেন দ্বিতীয় শ্রেণীভুক্ত। আর তৃতীয় শ্রেণীতে ছিলেন সেইসব মনসবদার যাদের সওয়ারের সংখ্যা 'জাট' সংখ্যার অর্ধেকেরও কম কিংবা যার অধীনে কোন 'সওয়ার' থাকত না ।
মনসবদার পদের যেহেতু দুটি স্বতন্ত্র দিক ছিল জাট ও সওয়ার পদ, তাই দু'টি পদের জন্য বেতন নির্ধারণের পদ্ধতিও ছিল স্বতন্ত্র । সাধারণভাবে মনসবদারদের দু'ভাবে বেতন দেওয়া হত। কিছু লোক নগদ টাকায় (দাম) বেতন পেতেন । এদের বলা হত 'মনসবদার-ই-নগদী"। এদের সংখ্যা ছিল খুবই নগণ্য। অধিকাংশ মনসবদার বেতন বাবদ জমি বরাদ্দ পেতেন । অবশ্য জমির উপর এঁদের কোন মালিকানা বা কর্তৃত্ব ছিল না । এঁরা কেবল উক্ত বরাদ্দকৃত জমির নির্ধারিত খাজনা ভোগ করতেন । এই খাজনার পরিমাণ স্থির করে দিত সরকারের রাজস্ব বিভাগ। এই নির্ধারিত খাজনাকে বলা হত 'জমা' । যে পরিমাণ খাজনা আদায় করা যেত তাকে বলা হত 'হাসিল' । বহুক্ষেত্রে জমা ও হাসিলের মধ্যে ব্যাপক ফারাক ঘটত এবং সেই কারণে অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় জটিলতারও উদ্ভব হত ।
মনসবদারী ব্যবস্থার ত্রুটি ও দুর্বলতা
মনসবদার-পদে বংশানুক্রমিক অধিকার আদৌ স্বীকৃত ছিল না । একজন মনসবদারের পদচ্যুতির সঙ্গে সঙ্গে উক্ত মনসবদারের দখলীকৃত 'মনসব' সম্রাটের হাতে ন্যস্ত হত । তেমনি একজন মনসবদার কর্মরত অবস্থায় মারা গেলে তাঁর 'মনসব' এবং স্থাবর-অস্থাবর সমস্ত সম্পত্তি সম্রাট বাজেয়াপ্ত করতেন ।
মনসবদারী ত্রুটি ও দুর্বলতাগুলি ছিল ব্যবস্থার কিছুটা সহজাত এবং কিছুটা আরোপিত । এমনকি এই ব্যবস্থার অভ্যন্তরীণ ত্রুটিগুলি সম্রাট আকবরের সময়কালেই প্রতিভাত হয়েছিল । এই প্রথার প্রবর্তনে সম্রাটদের মহৎ উদ্দেশ্য এবং আন্তরিকতা থাকলেও অধিকাংশ মনসবদার ছিলেন অসৎ ও সুযোগসন্ধানী । মনসবদারদের অধিকাংশই তাদের যে সংখ্যক ও যে মানের অশ্ব বা সৈন্য রাখা প্রয়োজন তা রাখতেন না । অনেক সময় ভবঘুরে, ভিখারী ইত্যাদি লোকেদের তাঁরা নিজ নিজ বাহিনীর সদস্য সাজিয়ে আইনকে ফাঁকি দিতেন । এই দুর্নীতি রোধ করার জন্য আকবর 'দাগ' ও 'চেহরা' প্রথা চালু করেন । মনসবদারদের মধ্যে অসাধু মনোবৃত্তি সাম্রাজ্যের পক্ষে ক্ষতিকর হয়েছিল,
প্রথমত, মুঘল সম্রাটেরা সামরিক বা প্রশাসনিক ব্যবস্থার পাশাপাশি কুটনৈতিক ব্যবস্থা হিসেবেও মনসবদারী প্রথাকে প্রয়োগ করে এই ব্যবস্থাকে দুর্বল করে দেন। আকবর থেকে ঔরঙ্গজেব সবাই যখন দেখতেন কোন গোষ্ঠী বা জাতি ঐতিহাসিক কারণে বিশেষ ক্ষমতাশালী হচ্ছে, তখনই তাঁদের 'মনসব' প্রদান করে মুঘল শাসন-পরিবারের অন্তর্ভুক্ত করতে চাইতেন। আকবরের আমলে রাজপুতদের কিংবা ঔরঙ্গজেবের আমলে মারাঠাদের অধিক সংখ্যক মনসব লাভের ঘটনাএই ধারার অন্যতম নিদর্শন।
দ্বিতীয়ত, নবনিযুক্ত মনসবদারদের অনেকেই সরকারীভাবে 'মনসবদার' বলে ঘোষিত হলেও, 'জায়গির' জমি পাওয়ার জন্য দীর্ঘকাল অপেক্ষা করতে হয়। এজন্য সম্রাটের বিশেষ ঘনিষ্ঠ ঘনিষ্ঠ হবার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। দেয়। ফলে শুরু হয় অভিজাতদের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব এবং সম্রাটকে তাঁবেদারে পরিণত করার বিপজ্জনক খেলা।
তৃতীয়ত, আকবর জায়গিরদারি-ব্যবস্থার ত্রুটি সম্পর্কে সচেতন চন ছিলেন। তাই তিনি মনসবদারদের বেতন হিসেবে 'জায়গির' দেবার পরিবর্তে নগদ বেতন-ব্যবস্থার ওপর জোর দেন। কিন্তু পরবর্তীকালে 'জায়গির' দানের প্রথা ব্যাপকতা লাভ করে। জায়গিরদাররা নিজ নিজ অঞ্চলে একধরনের প্রচ্ছন্ন স্বাধীন শাসন গড়ে তোলেন এবং 'রাষ্ট্রের মধ্যে রাষ্ট্র' (Imperium in imperio) প্রতিষ্ঠা করে মুঘল সাম্রাজ্যের অস্তিত্বকেই চ্যালেঞ্জ জানান।
চতুর্থত, সেনাবাহিনীর সাথে সম্রাটের বা প্রধান সেনাপতির সরাসরি সম্পর্ক না থাকার ফলে মুঘল বাহিনীর ওপর সম্রাট বা সেনাপতির কোন কর্তৃত্ব ছিল না। সৈন্যরা তাদের বেতন পেত মনসবদারের কাছ থেকে, তাদের নিযুক্ত, পদোন্নতি বা পদচ্যুতি নির্ভর করত মনসবদারের ইচ্ছার ওপর। স্বভাবতই সৈন্যরা মনসবদারকেই তাদের প্রথম প্রভু বলে মনে করত।
আকবর প্রবর্তিত মনসবদারী প্রথা সম্পূর্ণ নতুনভাবে উপস্থাপিত পুরানো একটি প্রথা আকবরের নিজ দক্ষতা গুলি এই প্রথায় সম্মিলিতভাবে সেনা নায়ক অভিজাত শ্রেণি ও আমলা সম্প্রদায় রাষ্ট্রের সেবায় নিয়োজিত ছিল ৷
তোমাকে অনেক ধন্যবাদ আকবরের মনসবদারি ব্যবস্থা আলোচনা করো। এই নোটটি পড়ার জন্য