মারাঠা রাষ্ট্রসঙ্ঘের পতনের কারণ আলোচনা করো

মারাঠা রাষ্ট্রসঙ্ঘের পতনের কারণ আলোচনা করো

মারাঠা রাষ্ট্রসঙ্ঘের পতনের কারণ আলোচনা করো

মারাঠা রাষ্ট্রসঙ্ঘের পতনের কারণ আলোচনা করো

মুঘল বংশের অবক্ষয়ের ফলে অষ্টাদশ শতকের ভারতবর্ষে যে অনিশ্চিত ও বিভ্রান্তিকর রাজনৈতিক পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছিল, তাতে অনেকের মনে আশা জন্মেছিল যে হয়তো মারাঠারা এই অবস্থার অবসান ঘটিয়ে নতুন ভারত- সাম্রাজ্যের সূচনা ঘটাবে । কিন্তু ঊনবিংশ শতকের দ্বিতীয় দশক শেষ হওয়ার আগেই সে আশা দুরাশায় পরিণত হয় । ভারত- সাম্রাজ্য গঠনের কথা বহুদূর, ভারতের রাজনৈতিক চিত্র থেকেই মারাঠা- জাতির ছবি মিলিয়ে যায় । আশার আলো জ্বালিয়েও মারাঠাদের ব্যর্থতার অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়ার কারণ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে পণ্ডিতেরা নানা তথ্য ও তম্বের অবতারণা করেছেন । স্যার যদুনাথ সরকার, ডি.ভি. পোতদার, আর. ভি. নাদকানী প্রমুখ মারাঠাদের ক্রমবিপর্যয় ও পতনের কারণ হিসেবে তাদের পরিবর্তনবিমুখ মানসিকতা ও ত্রুটিপূর্ণ সামাজিক সংগঠনের উল্লেখ করেছেন । জি. দেশমুখ, এম. রানাডে প্রমুখ মারাঠী ঐতিহাসিক মনে করেন, পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রতি অনীহা এবং প্রাচীন ঐতিহ্যের প্রতি অন্ধ আনুগত্য মারাঠাদের বিপর্যয় ও পতন অনিবার্য করে তুলেছিল । আবার কোন কোন ঐতিহাসিক মারাঠাদের পতনের জন্য মহারাষ্ট্রের প্রাকৃতিক পরিবেশ এবং ভারতবর্ষের ধর্মীয়-জীবন ও তজ্জনিত সংঘাতের কথা উল্লেখ উল্লেখ করেছেন।

আপনি চাইলে এগুলো পড়তে পারেন

প্রথমত, অধিকাংশ ঐতিহাসিকের দৃষ্টিতে মারাঠাদের অবক্ষয় ও পতনের মূল কারণ ছিল তাদের সাংগঠনিক দুর্বলতা । মারাঠা সাম্রাজ্যের উদ্ভব ঘটেছিল শিবাজীর ব্যক্তিগত কর্মদক্ষতা ও যোগ্যতার দ্বারা । এর চরিত্র ছিল স্বৈরতান্ত্রিক । স্বৈরতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার ধর্ম অনুযায়ী নেতার দক্ষতা, যোগ্যতা এবং ব্যক্তিত্বই ছিল সাম্রাজ্যের অখণ্ডতা, বিস্তৃতি ও স্থায়িত্বের প্রধান শর্ত । শিবাজী বা রাজারামের আমলে সমগ্র মারাঠা - জাতির মধ্যে যে উৎসাহ, উদ্দীপনা এবং জাতীয় স্বার্থে আত্মত্যাগের প্রেরণা ছিল, শাহুর আমলে তা আদৌ অবশিষ্ট ছিল না । মুঘলদের বন্দীদশা থেকে শাহুর আকস্মিক মুক্তিলাভ এবং রাজারামের পুত্র দ্বিতীয় শিবাজী ও পত্নী তারাবাঈ-এর সাথে ছত্রপতির পদকে কেন্দ্র করে অন্তর্বিবাদ মারাঠা রাষ্ট্রসংঘের ভাঙন ত্বরান্বিত করেছিল । এই গৃহযুদ্ধের কারণে মারাঠা নেতৃবৃন্দ দু'ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েন এবং এই সুবাদে তাঁদের স্বাধীনতাস্পৃহা এবং ক্ষমতা দুই- ই বেড়ে যায়, যা রাষ্ট্রের সংহতির পক্ষে ছিল বিপজ্জনক । -

দ্বিতীয়ত, এই প্রসঙ্গে গে পেশোয়াতন্ত্রের উত্থানজনিত পরিস্থিতি ত লক্ষণীয় দুর্বলচিত্ত ছত্রপতি শাহু-তারাবাঈ গোষ্ঠীকে দমন করার জন্য পেশোয়া বালাজী বিশ্বনাথের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন । পেশোয়াকে তিনি সংবিধান বহির্ভূত ক্ষমতা প্রদান করে পরোক্ষ রাষ্ট্রের ক্ষতি ডেকে আনেন। কালক্রমে পেশোয়া মারাঠা -রাষ্ট্রসংঘের প্রধান ব্যক্তিতে পরিণত হন এবং এই পদ বংশানুক্রমিক হয়ে দাঁড়ায় । অধিকাংশ মারাঠা – সর্দার নিজেদের পেশোয়ার সমমর্যাদাসম্পন্ন বলেই মনে করতেন । ব্যক্তিগত দক্ষতার জন্য প্রথম তিন জন পেশোয়া এবং প্রথম মাধব রাও মারাঠা – সর্দারদের অনুগত রেখে এক পতাকাতলে সমবেত করতে সক্ষম হলেও পরবর্তী পেশোয়ারা তা পারেননি । তাছাড়া বংশানুক্রমিক অধিকারবলে সর্বোচ্চ প্রশাসনিক পদ আঁকড়ে থাকার ফলে মারাঠা - রাষ্ট্রব্যবস্থা যোগ্যতর ব্যক্তির সেবা থেকে বঞ্চিত হয়েছিল সরদেশাই মারাঠাদের ব্যর্থতা ও পতনের জন্য এই ত্রুটিকে বিশেষভাবে দায়ী বলে মনে করেন।

তৃতীয়ত, মারাঠা রাষ্ট্রের আর একটি সাংগঠনিক দুর্বলতা হল সামন্ত - প্রথার পুনঃপ্রবর্তন । পেশোয়া বালাজী বিশ্বনাথ মারাঠা নেতাদের সন্তুষ্ট করার জন্য তাদের জন্য পৃথক পৃথক স্বাধীন কর্মভূমি নির্দিষ্ট করে দেন। বিনিময়ে এইসব নেতা পেশোয়ার প্রয়োজনে সৈন্য সাহায্য দিতে প্রতিশ্রুত থাকেন । এইভাবে মারাঠা রাষ্ট্রে সামন্ত – প্রথার নবজাগরণ ঘটে । এর ফলে মারাঠা - রাষ্ট্রসংঘে বিচ্ছিন্নতাবোধ মাথা চাড়া দিয়ে উঠে এবং রাষ্ট্রীয় ঐক্য বিনষ্ট হয় । নেতাদের পারস্পরিক রেষারেষি ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা সামগ্রিকভাবে জাতির ক্ষতি করে । পেশোয়া প্রথম মাধব রাও এর মৃত্যুর পরে মহাদজী সিন্ধিয়া এবং নানা ফড়নবীশের মধ্যে প্রতিযোগিতা কিংবা দ্বিতীয় বাজীরাও - এর আমলে হোলকার ও সিন্ধিয়ার বিরোধ এই ব্যবস্থারই ফসল । সিন্ধিয়া, হোলকার, ভোঁসলে, ধাবাড়ে, গাইকোয়াড় কেউই পেশোয়ার কর্তৃত্বকে নিরঙ্কুশ বলে মনে করতেন না । একই রাষ্ট্রে একাধিক ব্যক্তির সমমর্যাদাবোধ ও স্বাতন্ত্র্যবোধ রাষ্ট্রের ঐক্যে ভাঙন এনেছিল ৷

চতুর্থত, যে-কোন রাষ্ট্রের শক্তি ও স্থায়িত্বের অন্যতম শর্ত হল তার আর্থিক স্বয়ম্ভরতা 1 কিন্তু মারাঠা-রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ভিত্তি ছিল দুর্বল এবং ত্রুটিপূর্ণ । প্রকৃতি ছিল মারাঠাদের প্রতি বিরূপ । মহারাষ্ট্রের ভূমি ছিল পাথুরে, পর্বতময় এবং সেই কারণে অনুর্বরা । স্বভাবতই মহারাষ্ট্রে কৃষি-উৎপাদনের সম্ভাবনা ছিল খুব ক্ষীণ এবং অনিশ্চিত । পেশোয়ারা ব্যবসা-বাণিজ্যের উন্নতির দিকেও খুব একটা আগ্রহী ছিলেন না। অবশ্য ব্যবসা- বাণিজ্যের বিকাশের অবকাশও ছিল খুব কম । শিল্পক্ষেত্রেও মারাঠারা ছিল খুবই অনগ্রসর । এইভাবে অর্থাগমের প্রধান তিনটি উৎস কৃষি, বাণিজ্য ও শিল্পে পশ্চাদপদ মারাঠা-জাতি অর্থাগমের পথ হিসেবে 'চৌথ' ও 'সরদেশমুখী' নামক জবরদস্তি আদায় করা অর্থের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিল । প্রতিবেশী রাজ্য থেকে জোর করে মারাঠারা ‘চৌথ’ ও ‘সরদেশমুখী' আদায় করত । কিন্তু এরূপ অনিয়মিত, অনিশ্চিত ও একধরনের লুণ্ঠিত অর্থের উপর নির্ভর করে একটি রাষ্ট্র দীর্ঘদিন টিকে থাকতে পারে না । মারাঠাদের লুন্ঠন প্রবৃত্তি এবং সীমাহীন অত্যাচার সমগ্র জাতির ভাবমূর্তিতে কালিমা লেপন করে । সমস্ত প্রতিবেশী জাতি ও রাজ্য মারাঠাদের প্রতি বিরূপ হয়ে ওঠে এবং অসহযোগিতার নীতি নেয় । ফলে বৃহত্তর বিপদের সময় মারাঠারা সম্পূর্ণ একঘরে হয়ে পড়ে।

তোমাকে অনেক ধন্যবাদ মারাঠা রাষ্ট্রসঙ্ঘের পতনের কারণ আলোচনা করো এই নোটটি পড়ার জন্য

About the author

Irisha Tania
"আমি সেই মেয়ে, যে শব্দে বাঁচে। কলম আমার অস্ত্র, আর কাগজ আমার স্বপ্নের আকাশ। প্রতিটি অনুভব, প্রতিটি চিন্তা আমি সাজিয়ে রাখি অক্ষরের গাঁথুনিতে। কখনো গল্পে, কখনো কবিতায়, আবার কখনো নিঃশব্দের ভেতরে। আমি লিখি, কারণ লেখার মাঝে আমি নিজেকে খুঁজে পাই। …

Post a Comment

🌟 Attention, Valued Community Members! 🌟