কৃষক প্রজাপার্টির উদ্ভব ও বিকাশ সম্পর্কে আলোচনা কর

কৃষক প্রজাপার্টির উদ্ভব ও বিকাশ সম্পর্কে আলোচনা কর

কৃষক প্রজাপার্টির উদ্ভব ও বিকাশ সম্পর্কে আলোচনা কর

কৃষক প্রজাপার্টির উদ্ভব ও বিকাশ সম্পর্কে আলোচনা কর


৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনে সর্বপ্রথম সীমিত আকারে ভারতীয় প্রদেশগুলোতে স্বায়ত্তশাসন প্রবর্তন ও ভোটাধিকার প্রদান করা হয়। বাংলার মুসলমান নেতাদের মধ্যে এ বিষয়ে নতুন উদ্দীপনা লক্ষ করা যায়। বাংলা সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান অঞ্চল হওয়ায় মুসলিম নেতাদের নির্বাচনের মাধ্যমে এ অঞ্চলে রাজনৈতিক প্রাধান্য স্থাপনের সুযোগ সৃষ্টি হয়। তবে বাংলার নেতাদের মধ্যে কৃষকদের নেতৃত্ব দানে এগিয়ে আসেন এ কে ফজলুল হক। তার হাত ধরে বাংলায় কৃষক প্রজা পার্টি রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন রাজনৈতিক দল হিসেবে পথচলা শুরু করে। নতুন এ রাজনৈতিক দলটির মধ্য দিয়ে বাংলায় মধ্যবিত্ত শ্রেণীর নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়।


আপনি চাইলে এগুলো পড়তে পারেন

বাংলার রাজনীতিতে কৃষক প্রজা পার্টি তিন দশক দৃশ্যমান ছিল। তার পরও এ দলটির রাজনৈতিক কোনো ক্রমবিকাশের ইতিহাস ছিল না। অর্থাৎ এ রাজনৈতিক দলটির ইতিহাস রচনা করার তথ্য-উপাত্ত সীমিত। ১৯০৬ সালে পূর্ব বাংলায় মুসলিম লীগের জন্ম। প্রতিষ্ঠাকালীন সময় থেকে এ দলটি অভিজাত মুসলমানদের প্রতিনিধিত্ব করে। কিন্তু পূর্ব বাংলার অধিকাংশ মুসলমানরা ছিল কৃষক শ্রেণীর। অবহেলিত ও নির্যাতিত কৃষকদের জমিদার শ্রেণীর হাত থেকে রক্ষার জন্য এগিয়ে আসেন এ কে ফজলুল হক।


১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে লর্ড কর্নওয়ালিস চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তন করলে কৃষকরা জমির উপর অধিকার হারায় এবং উদ্ভব ঘটে শোষক জমিদার শ্রেণী ৷ জমির মালিকানা পেয়ে জমিদাররা নিজের ইচ্ছামত কৃষকদের কাছ থেকে খাজনা আদায় করতে থাকে ৷ কৃষকদের স্বার্থ রক্ষার লক্ষ্যে ১৮৫৯ ও ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে প্রজাতত্ত্ব আইন প্রণীত হয় ৷ কিন্তু জমির উপর অধিকার কৃষকদের অধিকার অধরা থেকে যায় ৷ ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গীয় প্রসঙ্গে আইনে কিছু কৃষক বিক্ষোভ শর্তে জমির অধিকার পায় ৷ কিন্তু অনেকেই এর বাইরে থেকে যায় ৷ মুসলিম লীগের অন্যতম নেতা ফজলুল হক ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হিসাবে কর্মরত থাকাকালীন কৃষক শ্রেণীর দুর্গা সম্পর্কে অবগতি হন ৷ শেষমেষ প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে তিনি যোগ দেন এবং তার রাজনৈতিক কর্মসূচির অন্যতম লক্ষ্য ছিল কৃষক শ্রেণীর দুর্দশা মোচন । মুসলিম লীগে তার রাজনীতির পথ চলা শুরু হয় ।


ফজলুল হক তার আইনজীবী ও সাংবাদিক বন্ধুদের সাথে আলোচনার ভিত্তিতে কৃষকদের স্বার্থ রক্ষার উদ্দেশ্যে কলকাতায় কিছু সমিতি ও বেঙ্গল প্রজা পার্টি প্রতিষ্ঠা করেন ৷ পরবর্তীকালে 'বেঙ্গল জোরদার ও রায়ত এসোসিয়েশন' গঠন করেন ৷ ফজলুল হক সভাপতি হন ৷ ঢাকা ও মানিকগঞ্জে কৃষক প্রজা সম্মেলন আয়োজন করা হয় এই সকল সম্মেলনে ফজলুল হক কৃষকদের শ্রেণীগতভাবে সংগঠিত করার বার্তা দেন ৷ এর পরবর্তীকালে তিনি 'নিখিল বঙ্গ প্রজা কমিটি গঠন' করেন ৷ দ্রুত এই সংগঠন কৃষকদের আস্থা অর্জন করে এবং ১৯৩০ থেকে ৩৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে বাংলায় বিভিন্ন স্থানে একাধিক কৃষক ও প্রজা সমিতি স্থাপিত হয় ৷ ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে ফজলুল হক প্রজা সমিতির সভাপতি পদে নির্বাচিত হবার পরে বিভিন্ন সমিতিকে যুক্ত করে একটি বৃহত্তর ও শক্তিশালী সংগঠন গড়ার উদ্যোগ নেন ৷ এইভাবে প্রজা সমিতি কৃষক প্রজাপতি নামে একটি ঐক্যবদ্ধ হয়ে একটি বৃহত্তর রাজনৈতিক সংগঠন রূপে আত্মপ্রকাশ করে ৷ এর সভাপতি হন ফজলুল হক এবং সম্পাদক হন শামসুদ্দিন আহমেদ ৷


কৃষক প্রজা পার্টির অধিকাংশই ছিল আইনজীবী ও সম্পন্ন কৃষক পরিবারের সন্তান ৷ সরাসরি কৃষিকাজ ও উৎপাদনের সাথে এরা যুক্ত ছিলেন না ৷ তবে এই সকল শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মুসলমান বাংলায় অবহেলিত কৃষক সমাজকে শোষণমুক্ত করার উদ্যোগী হন ৷ ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে কৃষক প্রজা পার্টি তার রাজনৈতিক লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করে ইস্তেহার প্রকাশ করেন ৷ তারা মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষা, জাতি ধর্ম নির্বিশেষে কৃষক প্রজার সার্থ রক্ষা করা খাজনা মুকুব করা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষা করা, জমিদারী প্রথার বিলোপ, খাজনার হার কমানো ইত্যাদি দলের রাজনৈতিক লক্ষ্য ও কর্মসূচি হিসেবে গৃহীত হয় এবং দাবি তোলে ক্ষমতায় এলে এগুলি বাস্তবে রূপায়ণ করবে ।


কৃষক প্রজা পার্টি নির্বাচনী স্লোগান 'সকলের জন্য ডাল ভাত' ,'লাঙ্গল যার জমি তার' ইত্যাদি , গোটা কৃষক সমাজকে আকৃষ্ট করে ৷ কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের সাংগঠনিক কাঠামোর বিরুদ্ধে কৃষক প্রজা পার্টির লড়াই কিছুটা পৃথক ছিল ৷ কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে কৃষক সমাজের বৃহত্তম অংশ জাতি ধর্ম নির্বিশেষ কৃষক প্রজা পার্টিকে সমর্থন করে ৷ রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে কৃষক পূজা পার্টি তৃতীয় স্থান দখল করে । কংগ্রেস পাই ৫২ টি আসন মুসলিম লীগ ৩৯ টি এবং কৃষক পূজা পার্টি ৩৬ টি আসন পায় । লক্ষণীয় যে কৃষক প্রজা পার্টির বিজয়ী ৩৬ টি আসনের মধ্যে ৩৩ টি এসেছিল পূর্ববঙ্গ থেকে।


১৯৩৭ এর নির্বাচনে বাংলায় কোন দল একক সংখ্যাগরিষ্ঠ না পাওয়ায় জোট সরকার গঠনের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল ৷ আইনসভার বৃহত্তর দলের নেতা হিসাবে বাংলায় গভর্নর শরৎ কুমার বসুকে মন্ত্রিসভা গঠনের আহ্বান জানান ৷ কিন্তু দলীয় সিদ্ধান্ত অনুসারে তিনি প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন ৷ শেষমেষ ফজলুল হক রাজি হন এবং মুসলিম লীগ ও অন্যান্য কয়েকটি দলের সদস্যদের নিয়ে জোট গঠন করেন ৷ ফজলুল হকের প্রথম মন্ত্রিসভায় বাংলায় কৃষক শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষার কয়েকটি বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহণ করেন এই মন্ত্রিসভা ৷ ১৯৪১ সাল পর্যন্ত টিকে ছিল ৷


ফজলুল হক কৃষক প্রজা পার্টির সভাপতি হওয়া সত্বেও ১৯৩৭ এর অক্টোবরে মুসলিম লীগে যোগ দিতে বাধ্য হন । ফলে বাংলায় প্রায় গুরুত্বহীন মুসলিম লীগ কৃষক প্রজা পার্টি কে ভর করে রাজনৈতিক ভিত্তি গড়ে তুলল ৷ মুসলিম লীগের চাপে প্রকৃত কৃষক দরদী রক্ষার নানা প্রতিশ্রুতি বাতিল করতে বাধ্য হন ৷ সম্পদশালী মুসলিম সমাজকে সন্তুষ্ট করার জন্য লীগের চাপে ফজলুল হক কৃষক সমাজকে বঞ্চিত করতে বাধ্য হন ৷ জমিদারি প্রথার বাতিল করা, মন্ত্রীদের বেতন হ্রাস করা, রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তি, বিনা বেতনে শিক্ষা ইত্যাদি বহুনির্বাচিত প্রতিশ্রুতি পালন করার থেকে হক মন্ত্রিসভা সরে আসেন ৷ স্বভাবতই কৃষক প্রজা পার্টির সংগঠনকে দুর্বল করে দেওয়ার চেষ্টা চালান জিন্না ও অন্যান্য মুসলিম নেতৃবৃন্দ ৷ জিন্নাহর পুরোচনায় মন্ত্রিসভায় সদস্যরা জনসমাবেশে হকের নানা সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করেন ৷ ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দ হক মন্ত্রিসভা থেকে লীগ ও তাদের অনুগামী মন্ত্রীরা পদত্যাগ করলে প্রথম ফজলুল হক মন্ত্রিসভা ভেঙ্গে যান ৷


সহকর্মীদের বিশ্বাস ভঙ্গের ঘটনায় ফজলুল হক খুব ভেঙ্গে পড়েন তবে লড়াই থেকে সরে যাননি ৷ ওই সময় তিনি হিন্দু মহাসভার নেতা শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় থেকে মন্ত্রিসভায় যোগ দিতে রাজি করান ৷ তবে বাংলায় গভর্নর জন হার্বাটের লক্ষ্য ছিল ফজলুল হক ও কংগ্রেসিদের বদলে মুসলিম লীগের নেতৃত্বে মন্ত্রীসভা গঠন করা । তবে সংখ্যা গরিষ্ঠ সদস্যের সমর্থন থাকায় ফজলুল হক পুনরায় মন্ত্রিসভা গঠন করতে সক্ষম হন ৷ কিন্তু এর স্থায়িত্ব ছিল মাত্র ১৫ মাস । গভর্নর হার্বাট মুসলিম লীগ ও ইউরোপীয় গোষ্ঠীর চাপে ফজলুল হকের নেতৃতাদিন দ্বিতীয় মন্ত্রিসভা থেকে তাকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয় ৷ বড়লাট লিনলিথগো গভর্নর হার্বাটের এই উদ্দেশ্যকে পছন্দ করেনি শেষ পর্যন্ত বাংলায় নাজিমুদ্দিন মন্ত্রিসভা গঠন করে ৷


প্রাথমিকভাবে কৃষক শ্রেণীকে আকৃষ্ট করার লক্ষ্যে কৃষক প্রজা পার্টির আবির্ভাব হয়ে ঘটেছিল ৷ তবে শুধুমাত্র দরিদ্র ও অবহেলিত কৃষকদের জন্যই ৷ এই দলের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল তা নিয়ে মতভেদ আছে । কেউ কেউ মনে করেন যে কৃষক প্রজা পার্টি তাদের রুপায়ন কর্মসূচি গুলির মাধ্যমিক কেবল ধনী কৃষকদের স্বার্থকে পূরণ করেছে ৷ এডিন কুপারো মনে করেন যে কৃষক প্রজা পার্টির কৃষকদের নিম্নতম অংশকে বিশেষ সাহায্য করতে পারেননি । তবে কৃষক প্রজা পার্টির আমলে বাংলায় কৃষক আন্দোলন বামপন্থী  ভাবধারায় জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেয়েছে । কারণ ফজলুল হক মন্ত্রিসভার অনেকেই বামপন্থীরপ্রতি সহানুভূতি ছিলেন ৷ ফজলুল হকের উদ্যোগেই প্রজাদের আইন জারি করে কৃষকদের স্বার্থ রক্ষার প্রচেষ্টা করা হয়েছিল ৷ কিন্তু শেষ পর্যন্ত ফজলুল হক মুসলিম লীগের রাজনৈতিক প্রভাব মুক্ত থাকতে পারেনি ৷ এরপর থেকেই অর্থাৎ সামরিক শাসনের যাত্রার পর থেকে কৃষক শ্রমিক পার্টির আর কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি।


তোমাকে অনেক ধন্যবাদ কৃষক প্রজাপার্টির উদ্ভব ও বিকাশ সম্পর্কে আলোচনা কর এই নোটটি পড়ার জন্য

About the author

Irisha Tania
"আমি সেই মেয়ে, যে শব্দে বাঁচে। কলম আমার অস্ত্র, আর কাগজ আমার স্বপ্নের আকাশ। প্রতিটি অনুভব, প্রতিটি চিন্তা আমি সাজিয়ে রাখি অক্ষরের গাঁথুনিতে। কখনো গল্পে, কখনো কবিতায়, আবার কখনো নিঃশব্দের ভেতরে। আমি লিখি, কারণ লেখার মাঝে আমি নিজেকে খুঁজে পাই। …

Post a Comment

🌟 Attention, Valued Community Members! 🌟