শাসক ও সংস্কারক হিসাবে ফিরোজ শাহ তুঘলকের অবদান আলোচনা কর
%20(1)%20(1).jpg)
১৩৯১ খ্রিস্টাব্দে ২০ মার্চ তুঘলক বংশী অপুত্রক সুলতান মহাম্মদ বিন তুঘলকের মৃত্যুর পর তার ফূল্য দাশপুত্র ফিরোজ শাহ তার অনিচ্ছা সত্ত্বেও দিল্লি সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন এবং নিদারুণভাবে দিল্লির শাসক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন, এই পদটি তিনি 37 বছর ধরে অধিষ্ঠিত ছিলেন এবং এই ৩৭ বছর ধরে তিনি একাধিক জনহিত কর কর্মে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন ৷ তার কারণেই তিনি ইতিহাসের অন্যতম আলোচিত ব্যক্তিত্ব হিসেবে পরিচিত ৷ যে সকল গ্রন্থ থেকে আমরা তার এই একাধিক জনহিতকর কর্ম সম্পর্কে জানতে পারি তার মধ্যে অন্যতম হলো জিয়াউদ্দিন বারুনীর তারিখি ফিরোজশাহী সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলকের প্রণীত "কুতুব-ই-ফিরোজশাহী" ৷
আপনি চাইলে এগুলো পড়তে পারেন
সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলক তার বিবিধ পরিকল্পনার জন্য ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন । তার গৃহীত একাধিক পরিকল্পনার মধ্যে অন্যতম হলো জনসাধারণের আর্থিক উন্নয়নের জন্য পরিকল্পনার দিকে তিনি কৃষির উন্নয়নের জন্য একাধিক পুরাতন খাল সংস্কার করেন তেমনি নতুন খাল ও কর্ষন করেন । শতদ্রু থেকে ঘার্ঘরা পর্যন্ত 76 মাইল, যমুনা থেকে হিসার ১৫০ মাইল দীর্ঘ দুটি খাল খনন করা হলে আশেপাশের বেশিরভাগ এলাকাই চাষযোগ্য হয়ে ওঠে । তিনি রাজধানী এলাকায় প্রায় 1,200টি বাগান স্থাপন করেছেন, যাতে খাদ্যশস্যের স্থিতিশীল সরবরাহ নিশ্চিত করা যায় এবং স্থানীয়দের জীবনযাত্রার মান উন্নত করা যায় ।
ফিরোজ শাহ তুঘলকের সময় কর ব্যবস্থায় বড় ধরনের পরিবর্তন দেখা যায় । জন সাধারণের সুবিধার জন্য তিনি প্রায় পঁচিশটি বিভিন্ন ধরনের করের বাদ দিয়েছিলেন এবং তাদের পরিবর্তে শরিয়াত দ্বারা অনুমোদিত মাত্র চারটি প্রকার কর চালু রাখেন ৷ যথা- জিজিয়া (অমুসলিম দের উপর আরোপিত একটি বিশেষ কর), যাকাত (একটি 2.5 শতাংশ মুসলমানদের সম্পদের অংশ), এবং খারজ (শস্যের এক-দশমাংশ) খামশ (লুন্ঠিত দ্রব্যের একের পাঁচ অংশ) । মহা নির্মাতা হিসাবে ফিরোজ শাহ তুঘলকের অবদান অনস্বীকার্য । তিনি প্রায় 50টি বাঁধ, 40টি মসজিদ, 30টি কলেজ, 20টি প্রাসাদ, 100টি সরাইখানা, 100টি হাসপাতাল এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণভাবে, তার শাসনামলে 200টি নতুন শহর নির্মাণ করা হয়েছিল, যা একদিকে রাষ্ট্রের ব্যতিক্রমী গুণমানে অবদান রেখেছিল । তেমনি দীর্ঘমেয়াদী কাজ ব্যক্তিদের প্রাপ্ত বিবাহের সংখ্যার সাথে সম্পর্কযুক্ত । ঐতিহাসিক আফিফ এই সময়ের অর্থনৈতিক অগ্রগতি এবং সমৃদ্ধি বর্ণনা করেছেন এভাবে: প্রজাদের গৃহ ষষ্ঠ সম্পদে প্রত্যেক রমণীর স্বর্ণ ও রুপো অলংকারে ভূষিত থাকতেন।"
ফিরোজ শাহ তুঘলক প্রজাহিদ শোনার অন্যতম নিদর্শন ছিলেন "দারুন-ইন-সিফা" বা দরিদ্র মানুষের জন্য বিনামূল্যে চিকিৎসা প্রদান করেছিলেন । দেওয়ান-ই-খয়রাত, বা প্রয়োজনে কন্যার পরিবারের মধ্যে বিবাহের জন্য নির্দিষ্ট আর্থিক সহায়তা । জ্ঞানী গুণী ব্যক্তিদের সম্মানিত করার জন্য তার বিশেষ দপ্তর ছিলেন দিওয়ান-ই-ইস্তিহাক নামে পরিচিত । ব্যক্তিগতভাবে, ফিরোজ শাহ তুঘলক একজন বিদ্বান রাজা ছিলেন । সুরসহ তুঘলক ব্যক্তিগত ভাবে ছিলেন একজন জ্ঞানের অনুরাগী শাসক তিনি ভারতে প্রায় ৩০০ টি অমূল্য সংস্কৃত গ্রন্থকে সংরক্ষণ করেন ৷ তিনি অনুবাদের জন্য বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করেন ফলত সংস্কৃত সাহিত্যচর্চা ভারতের সীমা অতিক্রম করে ফলতো ভারতবর্ষের এক নতুন ধারায় সংস্কৃতি পরিমণ্ডল গড়ে ওঠে ৷ তিনি ছিলেন একজন সংবেদনশীল কমল হৃদয়ের মানুষ আর সেই কারণে তিনি আইন ও বিচারব্যবস্থারও বিপুল সংস্কার সাধন করেন ৷
বিভিন্ন উপায়ে, ফিরোজ শাহ তুঘলক সুলতানি যুগে প্রচলিত আইনী ব্যবস্থার অনমনীয়তা বজায় রেখেছিলেন। শাস্তির পুরানো ধরন, যেমন প্রকাশ্যে বেত্রাঘাত, অঙ্গচ্ছেদ, চর্ম উৎকটন ইত্যাদি ফিরোজ শাহ তুঘলক কর্তৃক নিষিদ্ধ ছিল । মানবাধিকারকে তিনি খুবই গুরুত্ব দেন । তিনি জনগণের অধিকারের পক্ষে ছিলেন । ইতিহাসবিদ এ.এল শ্রীবাস্তব বলেছেন, "ফিরোজ নিজেকে তার রাষ্ট্রের আস্থাভাজন এবং জনগণের কল্যাণের জন্য দায়ী হিসাবে দেখেন।" আসলে ফিরোজ শাহের হস্তে দিল্লির রাজতন্ত্র একটি "কল্যাণমূলক রাজতন্ত্র" পরিণত হয় ৷
ঐতিহাসিক হেনরি ইলিয়াড ফিরোজ শাহের একাধিক জনহিত কর কর্মসূচির দিকে লক্ষ্য করে তাকে সুলতানি যুগের আকবর হিসাবে অভিহিত করেছেন । যাইহোক, ভিনসেন্ট স্মিথ এবং ঈশ্বরী প্রসাদ, ডি শর্মা সহ অন্যরা একমত নন যে ফিরোজ শাহ তুঘলক সুলতানি আমলের আকবর ছিলেন । ঐতিহাসিক আফিফ সুলতানকে আদর্শবাদী শাসক হিসেবে বর্ণনা করেছেন । উপরন্তু, সুলতান সমগ্র রাজত্ব কাল ধরে প্রজা কল্যাণ অর্থ হয় জীবনপাত করেন ৷ ভিন্সেন্ট স্মিথ ফিরোজ শাহ তুঘলককে সুলতানি যুগের আকবর বলার পক্ষপাতী ছিলেন না তার কারণ হিসেবেই তিনি দেখান যে," দ্বীন-ই-ইলাহী ইবাদতখানার ইত্যাদির মধ্য দিয়ে আকবর বিশ্ব দরবারে ভারতে ধর্মনিরপেক্ষতাকে সম্মানিত করেছিলেন কিন্তু ফিরোজ শাহ তুঘলক ধর্মের ক্ষেত্রে সেই মহান সুলতার পরিচয় রাখতে পারেননি।" তাই তাকে সুলতানি যুগের আকবর বলা যায় না ৷