Posts

বাংলার সংস্কৃতির জাগরণে ডিরোজিও ও নব্য ব্যঙ্গদের অবদান কি ছিল ৷ নব্য বঙ্গ আন্দোলন ব্যর্থ হয়েছিল কেন ?

বাংলার সংস্কৃতির জাগরণে ডিরোজিও ও নব্য ব্যঙ্গদের অবদান কি ছিল ৷ নব্য বঙ্গ আন্দোলন ব্যর্থ হয়েছিল কেন ?

 বাংলার সংস্কৃতির জাগরণে ডিরোজিও ও নব্য ব্যঙ্গদের অবদান কি ছিল ৷ নব্য বঙ্গ আন্দোলন ব্যর্থ হয়েছিল কেন ?


বাংলার সংস্কৃতির জাগরণে ডিরোজিও ও নব্য ব্যঙ্গদের অবদান কি ছিল ৷ নব্য বঙ্গ আন্দোলন ব্যর্থ হয়েছিল কেন ?

নবিংশ শতাব্দীর বাংলা ছিল বহু অংশে স্থগিত, অশিক্ষা ও কুসংস্কারে জর্জরিত, ধর্মকেন্দ্রিক সমাজ ব্যবস্থার দ্বারা পরিচালিত ৷ বাংলার সমাজ হয়ে উঠেছিল যুক্তিহীন চেতনাহীন ঘোর তামাশাচ্ছন্ন আর এই কুহেলিকা ময় সমাজব্যবস্থার বুক চিরে আলোর রোশনায় হয়ে উদ্ভাসিত হন 'বাংলার নবজাগরণের অন্যতম অগ্রদূত হেনরি লুই ডিভিয়ান ডিরোজিও [১৮০৯-১৮৩১] ৷' তদানীন্তন জ্ঞান চর্চার অন্যতম পীঠস্থান হিন্দু কলেজের জনপ্রিয় শিক্ষক ডিরোজিও অচিরেই হয়ে ওঠেন যুক্তিবাদের পথপ্রদর্শক ও পানপুরুষ ৷ তার প্রেরণার উৎস ছিল ফরাসি বিপ্লব ৷ জাতীয়তাবাদী এই আন্দোলনের আদর্শে উদ্বৃত্ত হয়ে ডিরোজিও আধুনিক ও প্রগতিশীল ধ্যান ধারণার পরিপোষন শুরু করেন ৷ টমাস পেইন,হিউম প্রমুখ যুক্তিবাদী দর্শন তাকে গভীরভাবে অনুপ্রাণিত করে ৷ অল্প দিনের মধ্যেই তিনি কবি,সু লেখক,দার্শনিক চিন্তাবিদ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন ৷

কলকাতার এসপ্ল্যানেড অঞ্চলে হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিয়োর মর্মর মূর্তি
আপনি চাইলে এগুলো পড়তে পারেন

১৮২৬ খ্রিস্টাব্দে [ মন্মান্তরে ১৮২৭ খিঃ] তিনি মাত্র 17 বছর বয়সে হিন্দু কলেজের সাহিত্য ও ইতিহাসের অধ্যাপক হিসাবে যোগদান করেন ৷ কলকাতার ধর্মতলা একাডেমিতে পড়ার সময় তিনি তার স্কটিশ শিক্ষক ডেবিড ড্রামেন্ডের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন এবং সেখান থেকেই তার মধ্যে এক চরমপন্থী যুক্তিবাদী দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে উঠেছিল ৷ প্যারীচাঁদ মিত্র লিখেছেন,"ডিরোজিও তার ছাত্রদের যাবতীয় পাপ মুক্ত করে সব দিকে গুণান্বিত করে তোলার জন্য তাদের নানা ধরনের নতুন চিন্তার খোরাক জোগাতেন ৷" হিউমের সন্দেহবাদী দর্শনের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি ঈশ্বরের অস্তিত্বকে অস্বীকার করেছিলেন তার আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে বাংলার একদল তরুণ ছাত্রগোষ্ঠী পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে প্রচলিত হিন্দু ধর্মের সামাজিক রীতি-নীতি আচার-আচরণকে অবাস্তব মনে করে এবং এর বিরুদ্ধে পরিবর্তনকামী আন্দোলন গড়ে তোলে ৷ এই আন্দোলনকারী ছাত্রগোষ্ঠী বাংলা তথা ভারত ইতিহাসে ডিরোজিওপন্থী বা নব্য বঙ্গ গোষ্ঠী নামে পরিচিত ৷

ডিরোজিও ও তার অনুগামীরা উপযোগবাদী দর্শনের প্রভাব থেকে সনাতন হিন্দু ধর্মের প্রথা ও রীতিনীতি গুলিকে তীব্র ভাষায় আক্রমণ করেছিল ৷ ১৮২৮ থেকে ২৯ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ তিনি একাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন নামে একটি ডিরেক্টিং সোসাইটি গড়ে তোলেন ৷ যেখানে বিভিন্ন বিষয় যেমন সাহিত্য,দর্শন,ইতিহাস নিয়ে তর্কবিতর্ক হতো ৷ প্রিয় ছাত্রদের মধ্যে ছিলেন কৃষ্ণমোহন ব্যানার্জি,রসিক কৃষ্ণ মল্লিক,রাধানাথ শিকদার, রামতনু লাহিড়ী, দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়,  পেরিচাঁদ মিত্র, শিবচন্দ্র দেব প্রমুখ ৷ এদের বাণী ছিল, "হিন্দু ধর্ম নিপতি যাক কুসংস্কার নিপাত যাক" ব্রাহ্মণদের উত্তেজিত করার জন্য এরা চিৎকার করে ঘোষণা করতেন আমরা গরু খায় গো, আমরা গরু খায় । কেউ কেউ প্রকাশ্যে পৈতে ছেড়ে পদদলিত করতেন এই অতিঊচ্ছাস হিন্দুদের মনে যুগপৎ ক্ষোভ ও আতঙ্কের সঞ্চার করেন ৷

হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিয়োর সমাধি

 ডিরোজিও কর্তৃক প্রচারিত তীক্ষ্ণ যুক্তিবাদ রাধাকান্ত দেব ও রামমোহন রায় পরিচালিত আপাত বিরোধী গোষ্ঠীর কেই ক্ষুদ্ধ করেছিল ৷ রাধাকান্ত দেবের চাপে হিন্দু কলেজের পরিচালনা সমিতি ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দে ২৫শে এপ্রিল ডিরোজিওকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করেন এবং অল্প কিছুদিনের মধ্যে ডিসেম্বর মাসে মাত্র ২২ বছর বয়সে তিনি মারা যান ৷ কিন্তু তার মৃত্যুর পরেও তার অনুগামীরা নব্য ব্যঙ্গ আন্দোলন চালিয়ে যান ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দে নব্য বঙ্গ গোষ্ঠী ইংরেজিতে Enguirer এবং বাংলায় জ্ঞাননাথেশন নামে দুটি পত্রিকা বের করেছিলেন ৷ Enguirer পত্রিকায় লেখা হয়," ছৈচৈ এবং বিভ্রান্তি ছাড়া কোন মানুষের সংস্কার সাধন সম্ভব নয় ৷" কৃষ্ণমোহন ব্যানার্জি তার The Persecuted" নাটকের অন্যতম চরিত্র বানিয়ালাল এর মুখ দিয়ে বলিয়াছিলেন -- সংস্কার এবং উদারপন্থা এক ছাদের নিচে সহবাসস্থান করতে পারেন না ৷ ১৮৩০ সালে প্রার্থেনান এছাড়াও ডিরোজিও হেসফেরাস ও ক্যালকালটা লিটারী গ্যাজুয়েট নামে দুটি পত্রিকার সম্পাদনা করতেন বলে জানা যায় ৷ তবে তার মৃত্যুর পর নব্য বেঙ্গল কিছুদিনের জন্য কলকাতা শহরে হেঁটে বা ধুয়ে তুলেছিলেন কিন্তু পরে তা খ্রীয়মাণ হয়ে যায় ৷

২০০৯ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত ডিরোজিয়োর নামে স্মারক ডাকটিকিট

ডিরোজিওর মৃত্যুর পর নেতৃত্বের সংকট ও সুবিন্যস্ত কর্মসূচির অভাব নববেঙ্গদের কোলঠাসা করে তোলে ৷ আলেকজান্ডার ড্রাফ বলেছেন ১৮৩২ থেকে অল্প বয়সী ছেলেদের মধ্যে নাস্তিকতার প্রভাব কমাতে শুরু করেছে ৷ হিন্দু সমাজের তৎকালীন কর্তা ব্যক্তিরা ও তাদের ওপর সামাজিক বহিষ্কার আরোন করেছিলেন ফলে দেখা যায় ১৮৩৩ সালের এপ্রিল মাসের মধ্যে মহেশচন্দ্র ঘোষ কৃষ্ণমোহন ব্যানার্জি প্রমুখো খ্রিস্ট ধর্মে দীক্ষিত হন ৷ দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায় 1860 এর দশকে একজন অনুগত হিন্দুর ন্যায় অযোধ্যায় বসবাস করতে থাকেন ৷ রাধানাথ শিকদার এভারেস্ট উচ্চতা মেপে বিখ্যাত হন এবং ব্রিটিশদের অধীনে চাকরি নেয় ৷ প্রকৃতপক্ষে ধর্ম ব্যাপারটি ডিরোজিয়ানদের কাছে কম তাই একটি সংবেদনশীল বিষয় হয়ে উঠেছিলেন ৷ 1838 সালে গড়ে ওঠা সোসাইটি ফর অ্যাকৃইজিশন অফ জেনারেল নলেজ নামে প্রতিষ্ঠানে নিয়ম করা হয় ধর্ম বিষয়ে কোনো আলোচনা করা যাবে না ।

নব্য ব্যঙ্গদের ব্যর্থতার দিকটি তুলে ধর ধরতে গিয়ে কৃষ্টদাস পাল সংক্ষেপে বলেছিলেন,"বড় বড় কথা বলা এবং বাস্তবে কিছু না করা ৷" তবে বিনয় ঘোষ বলেছেন একটা সময় পর্যন্ত তারা হিন্দু সমাজের কু প্রথার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিলেন এবং সে ক্ষেত্রে তাদের সততা ও নিষ্ঠান্ন অভাব ছিল না ৷" কিন্তু পরবর্তীকালে তাদের অনেকের মধ্যেই প্রাচীন পন্থা ও হিন্দুত্ববাদীর প্রভাব পরিলক্ষিত হয়েছিল ৷ দৃষ্টিভঙ্গির ভিন্নতা তাদের উদ্দেশ্যকে সফল হতে দেয়নি  ৷ ডিরোজিও জনপ্রিয়তা প্রসঙ্গে শিবনাথ শাস্ত্রী তার "রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গ সমাজ" গ্রন্থে লিখে ছিলেন চুম্বক যেমন লোহাকে আকর্ষণ করে তেমনি তিনিও অপরাপর শ্রেণীর বাল্য দিগকে আকর্ষণ করিলেন ৷ এরূপ অদ্ভুত আকর্ষণ শিক্ষক ছাত্রেরূপ সম্মান কেহ কখনো দেখায় নি ৷ ঐতিহাসিক সুমিত সরকার তার গ্রন্থে বলেছেন তাদের মূল দুর্বলতা ছিল তারা পাশ্চাত্য ভাব দর্শনের প্রভাবে আধুনিক বুর্জোয়া উদারনীতিবাদের দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ত করতে চেয়েছিলেন কিন্তু একটা উপনিবেশিক রাষ্ট্র কাঠামো তা যে সম্ভব নয় । এই সত্য তারা উপলব্ধি করতে পারেননি উপরিয়ত ত্রুটি সত্ত্বেও বাংলা তথা ভারতীয় চেতনার উন্মেষে এবং রক্ষণশীল গোঁড়া হিন্দু সমাজে যে সংস্কার প্রয়োজন এই বিষয়ে তারা আবশ্যিকতা বুঝিয়ে দেন ৷

About the author

Irisha Tania
"আমি সেই মেয়ে, যে শব্দে বাঁচে। কলম আমার অস্ত্র, আর কাগজ আমার স্বপ্নের আকাশ। প্রতিটি অনুভব, প্রতিটি চিন্তা আমি সাজিয়ে রাখি অক্ষরের গাঁথুনিতে। কখনো গল্পে, কখনো কবিতায়, আবার কখনো নিঃশব্দের ভেতরে। আমি লিখি, কারণ লেখার মাঝে আমি নিজেকে খুঁজে পাই। …

Post a Comment

🌟 Attention, Valued Community Members! 🌟