কুষাণ যুগের শিল্পকলার অগ্রগতি সম্পর্কে যা জানো তা লেখ।
কুষাণ সভ্যতার উৎকর্ষ বৃদ্ধিতে শিল্পের অবদান অনস্বীকার্য। শিল্পের মাধ্যমে যে-কোনো দেশ বা যুগের প্রকৃত প্রতিচ্ছবি প্রতিফলিত হয়। ঐতিহাসিক ড. নীহাররঞ্জন রায় তাঁর 'বাঙালির ইতিহাস' গ্রন্থে লিখেছেন, "ভাষা সাহিত্য জ্ঞান-বিজ্ঞান শিক্ষা-দীক্ষায় যে সংস্কৃতি প্রতিফলিত তাহার পশ্চাতে সচেতন বৃদ্ধির লীলা সক্রিয় থাকিলেও তাহা প্রত্যক্ষভাবে দেখা যায় না। সংস্কৃতির সেই প্রকাশ ধরা পড়ে চারুকলায়।” শিল্প বা চারুকলার দুটি দিক। যথা-স্থাপত্য ও ভাস্কর্য। স্থাপত্য শিল্পের পর্যায়ে পড়ে স্তূপ, বিহার ও মন্দির। ভাস্কর্যশিল্পের পর্যায়ে পড়ে গান্ধার, মথুরা, অমরাবতী ও সারনাথ। এদের মধ্যে গান্ধার শিল্পই সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য।
কুষাণ আমলে বেশ কিছু স্তূপ বা চৈত্যের সন্ধান পাওয়া যায়। এর মধ্যে সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য হল-প্রথম কণিদ্ধের আমলে নির্মিত পুরুষপুর যা পেশোয়ারের বিখ্যাত স্তূপটি। চিনা পর্যটক ফা-হিয়েন এই বহুতলবিশিষ্ট স্তূপটির বিবরণ দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন-পাঁচটি স্তরে এই স্তূপটির ভিত্তি তৈরি হয়েছিল। স্তূপটির মূল কাঠামো ছিল তেরোতলবিশিষ্ট। ফা-হিয়েন লিখেছেন, "ঐতিহ্য অনুযায়ী এটি ছিল জম্বুদ্বীপের মধ্যে সর্বোচ্চ স্তূপ।" কুষাণযুগে স্থাপত্য শিল্পে বিহারগুলিরও কিছু অবদান ছিল। সাধারণভাবে বিহারগুলি নির্মিত হত বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের বাসস্থানের জন্য। কণিষ্ক ও বুবিষ্কের সমরে তাঁদের নামে বৌদ্ধবিহার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এগুলির মধ্যে কণিষ্কপুরের মহাবিহার প্রসিদ্ধ ছিল।
মন্দির স্থাপত্য শিল্পের কিছু পরিচয় মেলে কুষাণযুগে। এই সাম্রাজ্যের পশ্চিমাংশে উত্তর আফগানিস্তানের সুখকোটালের কাছে উৎখনন থেকে মন্দির স্থাপত্য বিষয়ে নতুন কিছু ধারণা লাভ করা যায়। এই মন্দিরটি অগ্নিদেবতার উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করা হয়েছিল। মথুরার নিকটবর্তী মাঠে প্রাপ্ত শিলালেখ থেকে মন্দিরের পূজার্চনার বিষয়টি পরিলক্ষিত হয়। এর থেকে বোঝা যায় যে, কুষাণ রাজবংশের দেবালয়ে ব্রাহ্মণ্য দেবতারা পূজিত হতেন। এছাড়া মুদ্রা থেকেও কুষাণ শাসকদের ধর্মীয় সহিষুতার নীতি সমর্থিত হয় ৷
![]() |
শিলালিপিটি মধ্যম ব্রাহ্মী লিপিতে রয়েছে : মহারাজা রাজাধিরাজ দেবপুত্র কণিশক "মহান রাজা, রাজাদের রাজা, ঈশ্বরের পুত্র, কনিষ্ক"। মথুরা শিল্প , মথুরা যাদুঘর ![]() ![]() ![]() ![]() ![]() ![]() ![]() ![]() ![]() ![]() ![]() ![]() ![]() ![]() ![]() ![]() |
কুষাণ আমলে ভাস্কর্যশিল্পের মধ্যে গান্ধার শিল্প সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য। ভারতের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের গান্ধার অঞ্চল অর্থাৎ পেশোয়ার, নগরহর, বামিয়ান, বেগ্রাম, সোয়াট উপত্যকা, তক্ষশিলাকে কেন্দ্র করে গান্ধার শিল্পরীতি গড়ে ওঠে। গ্রিক, রোমান, শক, পল্লব, কুষাণ প্রভৃতি বিদেশি সংস্কৃতির সঙ্গে শিল্পক্ষেত্রে ভারতীয় সংস্কৃতির সমন্বয়ের ফলে গড়ে ওঠে গান্ধার শিল্প। কুষাণদের শাসনকালে বিশেষ করে কণিষ্কের শাসনকালে এর চরম বিকাশ ঘটে। ড. নীহাররঞ্জন রায়-এর মতে, খ্রিস্টীয় প্রথম শতক হল এর সূচনাকাল এবং খ্রিস্টীয় তৃতীয়-চতুর্থ অর্থাৎ, পরবর্তী ৪০০ বছর ধরে এই শিল্পরীতি তার অস্তিত্ব বজায় রাখে।
গান্ধার শিল্পের বিষয়বস্তু সম্পূর্ণভাবে ধর্মীয় ও ভারতীয়। বুদ্ধদেবকে উপজীব্য করে এই শিল্প গড়ে ওঠে। শক ও কুষাণরা ভারতে এসে মহাযান ধর্মমত গ্রহণ করেন। মহাযান ধর্মমতে বুদ্ধের মূর্তিপুজোর নিয়ম ছিল। গান্ধার শিল্পীরাই প্রথম বুদ্ধ ও বোধিসত্ত্বের প্রস্তর মূর্তি নির্মাণ করে। এইসব মূর্তিগুলিতে গ্রিক ও রোমান প্রভাব স্পষ্ট। এইসব মূর্তিতে বুদ্ধের গায়ে ভারী পোশাক এবং বহুক্ষেত্রেই তিনি গুরু এবং পাগড়ি সম্বলিত। এই মূর্তির সঙ্গে ভারতীয় ধ্যান-ধারণার মিল খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়। পার্শি ব্রাউন-এর মতে, গান্ধার শিল্পের প্রকরণ ছিল গ্রিক। কিন্তু বিষয়বস্তু ছিল ভারতীয়। তিনি একে "গ্রিক বৌদ্ধশিল্প বলে অভিহিত করেছেন। ড. কুমারস্বামী একে ভারতীয় বিষয়বস্তুতে প্রযুক্ত গ্রিক শিল্পরীতির দেশীয় প্রকাশ বলে বর্ণনা করেছেন। ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার বলেন, গান্ধার শিল্প ভারতের অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে পারেনি।
![]() |
" বালা বোধিসত্ত্ব " বাণ এবং চাতরা ছাতা সহ, "ভাই ( ভিক্ষু ) বালা" দ্বারা "কনিষ্কের 3 সালে" (আনুমানিক 130 খ্রিস্টাব্দ) উত্সর্গীকৃত । ডান হাতটি নমস্কারের ভঙ্গিতে উঠানো যেত। সারনাথ জাদুকর । |
প্রাচীন ভারতীয় শিল্পের ইতিহাসে মথুরানগরী এক গুরুত্বপূর্ণ স্থানের অধিকারী। কেবলমাত্র মথুরা নয়, সন্নিহিত সারনাথ, শ্রাবন্তী ও কৌশাম্বী অঞ্চলেও এই শিল্পরীতির এদর্শন মিলেছে। এই শিল্প ছিল গান্ধার শিল্পের সমসাময়িক। খ্রিস্টীয় প্রথম শতকে প্রাণতের আমল থেকেই মথুরার শিল্পীদের দক্ষতার পরিচয় পাওয়া যায়। মথুরা শিল্প ছিল বিদেশি প্রভাবহীন, ভারতীয় ঐতিহ্যপুষ্ট। মথুরা ও সন্নিহিত অঞ্চলে প্রায় ১৪০টি ভাস্কর্য নিদর্শন পাওয়া গেছে। এইসব মূর্তিগুলি তৈরি হয়েছিল সিক্রি থেকে আনা লাল ছোপযুক্ত বেলেপাথরে।
গাখার শিল্প ছিল উত্তর-পশ্চিম ভারতে আর মথুরা ছিল উত্তর ভারতে। এই দুই নিম্নরীতির বৃত্তের বাইরে দক্ষিণ ভারতের কৃত্বা গোদাবরী নদীর বদ্বীপ বা মধ্যবর্তী অঞ্চলে অমরাবতী, গোলি, নাগার্জুনকোন্ডা প্রভৃতি স্থানে এক নতুন ধরনের শিল্পরীতি গড়ে ওঠে। অমরাবতী ছিল এই শিল্পের কেন্দ্রস্থল। তাই এই শিল্প অমরাবতী শিল্প নামে পরিচিত ছিল। খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকের মধ্যভাগ থেকে খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতকের মধ্যে এই শিল্পরীতির উদ্ভব ও বিকাশ ঘটে। তবে সাতবাহনদের শাসনকালে এই শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটে। গান্ধার ও মথুরার মতো বুদ্ধদেব ও বৃদ্ধমূর্তিই হল এই শিল্পের প্রধান উপজীব্য। অমরাবতীর শিল্প ছিল অনেক পরিশীলিত। ড. নীহাররঞ্জন রায় বলেন- "অমরাবতীর শিল্প জড়জগৎ ও ইন্দ্রিয়পরায়ণতার মধ্যে নিমগ্ন ছিল না-সংযম ছিল এই শিল্পের বৈশিষ্ট্য।"
উপরিউক্ত আলোচনা থেকে বলা যায়, শিল্পকলার ক্ষেত্রে ভারত ইতিহাসে কুষাণযুগ এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। এক্ষেত্রে এ যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ অবদান গান্ধার শিল্প হলেও পাশাপাশি সারনাথ, অমরাবতী, মথুরা প্রভৃতি অঞ্চলে শিল্পের বিকাশ ঘটেছিল। ভারতের অধিকাংশ বুদ্ধমূর্তি গান্ধার শিল্পরীতির সাক্ষ্য বহন করেছে। মথুরার ভাস্কর্য বিশেষ খ্যাতিলাভ করেছিল। তার নারীমূর্তির কল্পনার জন্য। অমরাবতীর ভাস্কর্য বহুলাংশে বৌদ্ধ ধর্ম ও বুদ্ধের জীবনাশ্রয়ী আখ্যানের দ্বারা অনুপ্রাণিত। অমরাবতীর ভাস্কর্যে দ্বিভঙ্গের প্রয়োগ-ভাস্কর্যগুলিকে এক বিচিত্র গতিময়তা দেয়। ভাস্কর্যের রৈখিক ছন্দের প্রতি যতটা আকর্ষণ অমরাবতীর ভাস্কর অনুভব করেছিলেন অনুরূপ আকর্ষণ গান্ধার ও মথুরাশৈলীজাত মূর্তিকল্পনায় নেই।
Image Source:
Wikipedia