মাও-সে-তুং-এর নেতৃত্বে গণ-প্রজাতন্ত্রী চিনের উত্থান কীভাবে ঘটেছিল? সমকালীন রাজনীতিতে এর প্রভাব লেখ || অথবা, কিভাবে কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে চীনে গণপ্রজাতন্ত্রী সরকার প্রতিষ্ঠিত হয় তা আলোচনা কর || অথবা, 1949 খ্রিস্টাব্দে গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের উত্থানের প্রেক্ষাপট আলোচনা কর

১৯২২ খ্রিঃ চিনে মাঞ্জু সরকারের পতন ঘটলে চিনে সান-ইয়াৎ-সেনের নেতৃত্বে প্রজাতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল । তিনি কুয়ো-মিন-তাং নামে একটি দল গঠন করেন । ১৯১৭ সালে রুশ-বিপ্লবের পর চিনে সামাবাদের প্রসার ঘটে ও চিনে কমিউনিস্ট পার্টির উদ্ভব হয় । প্রায় ত্রিশ বছর ধরে মাও-সে-তুং -এর নেতৃত্বে কমিউনিস্ট পার্টির আন্দোলনের ফলে চিনে এক সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সংঘটিত হয় । এর ফলে চিনে গণপ্রজাতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, যার প্রধান পূজারী ছিলেন মাও-সে-তুং । ১৯২১ সালে ১জুলাই পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ের বুদ্ধিজীবীদের প্রচেষ্টায় চিনে কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে ওঠে । লি-তাও-চাও এবং চেন-ভূ- নিউ-এর উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত চিনা কমিউনিস্ট পার্টির তিনটি প্রধান কর্মসূচী ছিল-
ক) চিনে রাষ্ট্রীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা,
খ) চিনা যুদ্ধ-নায়কদের উচ্ছেদ এবং
গ) বিদেশি সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ। এই কমিউনিস্ট পার্টির নেতাদের মধ্যে সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য ছিলেন লি-লি-সান এবং মাও-সে-তুং।
কমিউনিস্ট নেতা চৌ- এন-লাই-এর উদ্যোগে কমিউনিস্ট পার্টির সাথে সান-ইয়াৎ-সেনের কুয়ো-মিন-তাং দলের মধ্যে মৈত্রীর সম্পর্ক স্থাপিত হয় । কমিউনিস্টরা এসময় কুয়ো-মিন-তাৎ দলের সদস্যও হতে পারত। তবে কুয়ো-মিন-তাং দলের দক্ষিণপন্থী সদস্যরা কমিউনিস্টদের বিশ্বাস করত না । সান-ইয়াৎ-সেন উভয়ের মধ্যে ভারসাম্য রেখে চলতেন । ১৯২৫ সালে সান-ইয়াৎ-সেনের মৃত্যুর পর কমিউনিস্ট পাটি ও কুয়ো-মিন-তাং দলের মধ্যে ঐক্য ভেঙে যায়। এ সময় কুয়ো-মিন-তাৎ দলের নেতৃত্ব দেন চিয়াং- কাই-শেক । তিনি ছিলেন ঘোর কমিউনিস্ট বিরোধী । তিনি সাম্যবাদী রাশিয়ার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেন এবং কমিউনিস্টদের সমস্ত উচ্চপদ থেকে বিতাড়িত করেন । এই পরিস্থিতিতে মাও-সে-তুং সাধারণ মানুষের মধ্যে কমিউনিস্ট আদর্শ প্রচার করেন । ফলে অসংখ্য মানুষ কমিউনিস্ট দলের সদস্য হন ।
মাও-সে-তুং এর নেতৃত্বে চিনা কমিউনিস্টরা উত্তর চীনের সিএনসি প্রদেশে একটি প্রায় স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যার রাজধানী ছিলেন কমিউনিস্টদের দমনের জন্য প্রজাতন্ত্রী চীনের রাষ্ট্রপতি সেখানে একদল সেনা পাঠান । ওইসব চিনা সৈন্য কমিউনিস্টদের দমনের পরিবর্তে সমর্থন করতে শুরু করেন এই সংবাদ বিচলিত ভীত হয়ে চিয়াং- কাই-শেক কমিউনিস্টদের দমন করতে সেনা পাঠালে চিনে গৃহযুদ্ধের সূচনা হয় । চিয়াং কাই-শেক প্রায় সাত লক্ষ সেনা পাঠিয়ে কমিউনিস্টদের প্রধান ঘাটি কিয়াংসি প্রদেশ অবরোধ করে কমিউনিস্টদের হুংস করতে উদ্যত হন। এই বিপদ-সছুল পরিস্থিতিতে মাও-সে-তুং-এর নেতৃত্বে প্রায় একলক্ষ কমিউনিস্ট সদস্য ১৯৩৪ মিঃ এক অসীম সাহসিকতাপূর্ন পরিকল্পনা গ্রহণ করে। তারা দীর্ঘ ছয়-হাজার মাইল পথ অতিক্রম করে ও সেনা-বাহিনীর বাধা পেরিয়ে শেন-সি প্রদেশে উপস্থিত হয়। পথে প্রায় আশি হাজার কমিউনিস্টের মৃত্যু হয়। এই সদীয় পদযাত্রা লাং-মার্চ নামে ইতিহাসে স্মরণীয়। এই পদযাত্রায় কমিউনিস্টদের বীরত্ব, সাফল্য ও আত্মত্যাগ সমগ্র চিনে এক বিপুল উদ্দীপনার সৃষ্টি করেছিল।
১৯৩৭ খ্রিঃ জাপান পুনরায় চিন আক্রমণ করে চিনের বহু স্থান দখল করে। এসময় চিয়াৎ-কাই-শেক ও তাঁর কুয়ো-মিন-তাং দল কমিউনিস্টদের সাথে যৌথভাবে জাপানের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে। কমিউনিস্টরা মাও-সে-তুং-এর নেতৃত্বে কৃতিত্বের সাথে যুদ্ধ করেছিল । দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ক্ষত বিখ্যাত জাপান ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে আত্মসমর্পণ করেন এরপর কুমিন্তান ও চীনা কমিউনিস্টদের মধ্যে দ্বন্দ্ব আবার চড়ানো ওঠে কিন্তু নানা কারণে ক্রমিং দলের সামরিক শক্তি তখন ক্রমহাসমার পক্ষান্তরে কমিউনিস্টরা ব্যাপক প্রচারের মাধ্যমে চীনের কৃষক ও শ্রমিক শ্রেণীকে সমর্থক লাভ করেন ৷ এর ফলে কমিউনিস্ট বাহিনী চিনের একের পর এক প্রদেশ দখল করতে থাকে । এদিকে সরকারী বাহিনী পরাজয় স্বীকার করতে বাধ্য হয় ।
১৯৪৯ সালের জানুয়ারিতে কমিউনিস্ট বাহিনী চিনের রাজধানী বেজিং অধিকার করে নেয় । এরপর তারা ইয়াংসি নদী পার হয়ে দক্ষিণ চিনে অগ্রসর হয় ও দক্ষিণ চিনের রাজধানী নানকিং এবং ক্যাশটন বন্দর দখল করে নেয় । বাধা হয়ে চিনা রাষ্ট্রপতি চিয়াং-কাই-শেক চিন থেকে পালিয়ে তাইওয়ানে আশ্রয় নেন । এদিকে চিনের মূল ভূ-খন্ডে মাও-সে-তুং এর নেতৃত্বে ১৯৪৯ সালের অক্টোবরে প্রতিষ্ঠিত হয় গণপ্রজাতন্ত্রী চিন। মাও-সে-তুং হন এর রাষ্ট্রপতি এবং চৌ-এন-লাই হন এর প্রধানমন্ত্রী। এভাবে দীর্ঘ সংগ্রামের পর চিনে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সফল হয়।
সম্বকালীন আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে প্রভাবঃ
মাও সে তুং এর নেতৃত্বে গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের উত্থান বিশ্বের সাম্যবাদী ভিত কে আরো মজবুত করে তোলে ৷ চিয়াং - কাইশেকের শাসনকালে চিনের ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরোক্ষ আধিপত্য ছিল, কিন্তু মাও-সে-তুং -এর গণপ্রজাতন্ত্রী চিনের অভ্যুদয়ে বিশ্বের কমিউনিস্ট শিবিরের পাল্লা ভারী হয়ে যায় । সাম্যবাদী চিনের উত্থান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃতাধীন সাম্রাজ্যবাদী জোটের কাছে বিপর্যয় স্বরূপ ছিল । ঠান্ডা লড়াইয়ের ঘুণে সামাবাদী চিনের উত্থান ও সোভিয়েত রাশিয়ার সাথে তার মৈত্রী ক্ষমতার ভারসাম্যকে পরিবর্তন করে ৷ তা সোভিয়েত রাশিয়ার পক্ষে ও মার্কিন শক্তি জোটের বিপক্ষে স্থাপন করে । এই কারণে সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলির প্রভাব হ্রাস পেতে থাকে ।
চিনে কমিউনিস্ট সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় সোভিয়েত রাশিয়া আনন্দিত হয়েছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায় কমিউনিস্ট চীন প্রতিষ্ঠার পরদিন-ই চিনকে স্বীকৃতি দেওয়ার মাধ্যমে । আবার পশ্চিমী জোটের হস্তক্ষেপ থেকে রক্ষা পেতে চিনেরও সোভিয়েত সাহায্য প্রয়োজন ছিল । ১৯৫০ সালের স্বাক্ষরিত দুই দেশের মৈত্রী চুক্তির মাধ্যমে রাশিয়া চিনকে যুদ্ধ সজ্জা ও শিল্পোন্নয়নের জন্য বিভিন্ন ভাবে সাহায্য করে । ১৯৫৫ সালে রাশিয়া চিনকে আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনে সহযোগী নেতৃত্বের স্থান দেয় ।
কমিউনিস্ট চিনের উদ্ভবের প্রথম থেকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চিনকে স্বীকৃতি দিতে চায়নি। আমেরিকা সাম্যবাদী চিনকে জাতিপুঞ্জের সদসাপদ থেকে বঞ্চিত করে । কোরিয়া যুদ্ধে আমেরিকা চিনকে আক্রমণ করে ও পরমাণু বোমা নিক্ষেপের হুমকি দেয় । এভাবে দু-দেশের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটতে থাকে ।
গণপ্রজাতন্ত্রী চিন একদিকে যেমন বিশ্বের সমাজতান্ত্রিক সালমানের অন্যতম পুরোধা ছিল, তেমনি তৃতীয় বিশ্বের এক গুরুত্বপূর্ণ ও প্রধান শক্তিরণেও মালকে প্রতিষ্ঠিত করেছিল । একই সাথে চিন এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের সাথে সাহার্য্যপূর্ণ সম্পর্কের পাশাপাশি শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নীতি গ্রহণ করে বিশ্বের জোট নিরপেক্ষ ইন্ডোজনকে সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী করে তুলেছিল। 'পঞ্চশীল' নীতি গ্রহণ করে চিন বিশ্বশান্তির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল ।
গণপ্রজাতন্ত্রী চীনে কমিউনিস্ট সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ায়। সমাবাদী মনোভাব ও চিন্তাধারা ইউরোপ ভূ-খন্ড ছেড়ে এশীয় ভূখন্ডে প্রবেশ এবং প্রসার লাভ করে। এর ফলে এশিয়ায় বিশেষত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় রাজনীতির ক্ষেত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন সাধিত হয়। স্বাভাবিকভাবে চিনকে উপেক্ষা করে এই অঞ্চলের শক্তিসামা নির্ধারণ করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। এভাবে চিন এশিয়ার সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ এ প্রভাবশালী রাষ্ট্রে পরিণত হয়। এশিয়ার বৃহত্তম রাষ্ট্র চীন এবং ইউরোপের বৃহত্তম রাষ্ট্র সোভিয়েত রাশিয়ায় কমিউনিস্ট শাসন প্রতিষ্ঠিত হ ওয়ায় বিশ্বের ছোটো ছোটো দেশগুলির শোষিত ও নিপীড়িত জনগণের মনে মুক্তির আশা সঞ্চার করে। এই দুই রাষ্ট্রের প্রভাবে ও সাহায্যে বিভিন্ন দেশে আন্দোলন শক্তিশালী ও প্রসার লাভ করে নিপীরিত জনগণের মধ্যে প্রবল উৎসাহ উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়। ফলশ্রুতিতে বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রে কমিউনিস্ট পার্টি ক্ষমতা দখলে সফলতা লাভ করে।
এভাবে গণপ্রজাতন্ত্রী চিন বিশ্বে তার অবস্থানকে এক দৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করেছে। এর ফলে চিন বিশ্বের এক অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শক্তিতে পরিণত হয়েছে। কোরিয়া যুদ্ধকালে জাতিপুঞ্জের বাহিনী চিন আক্রমণ করলে একক শক্তিতে চিন তার সফল মোকাবিলা করতে সমর্থ হয়েছিল। সুতরাং চিনকে উপেক্ষা করে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া তথ্য বিশ্বের শক্তিসামোর পরিবর্তন অসম্ভব।
তোমাকে অনেক ধন্যবাদ মাও-সে-তুং-এর নেতৃত্বে গণ-প্রজাতন্ত্রী চিনের উত্থান কীভাবে ঘটেছিল? সমকালীন রাজনীতিতে এর প্রভাব লেখ এই নোটটি পড়ার জন্য