বাংলায় স্বদেশি আন্দোলনের ব্যর্থতা ও সীমাবদ্ধতা উল্লেখ কর অথবা, বাংলায় স্বদেশি আন্দোলনের সীমাবদ্ধতার দিকগুলি বিশ্লেষণ করো।

বাংলায় স্বদেশি আন্দোলনের ব্যর্থতা ও সীমাবদ্ধতা
ভারতবর্ষের লর্ড কার্জনের শাসনকালে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ছিল বঙ্গভঙ্গের পরিকল্পনা ৷ সাম্রাজ্যবাদী কার জনের একমাত্র লক্ষ্য ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের নিরাপত্তা বিধান করা৷ ইতি মধ্যে ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে ব্রিটিশ সরকার সংগত এবং সাধন নীতি গ্রহণ করতে শুরু করেছিল এবং ভবিষ্যতে এই ধরনের বিরোধিতা যাতে হতে না হয় তার জন্য সমস্ত ধরনের পদক্ষেপ নিতে আগ্রহী ছিলেন ৷ বিচক্ষণী কার্জন যথার্থই বুঝতে পেরেছিলেন যে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের প্রাণ কেন্দ্র ছিল বঙ্গ প্রদেশ ৷ পাশ্চাত্য শিক্ষা ও ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ বাঙালি জাতি ইংরেজ সরকারের শোষণ সম্পর্কে ক্রমশ সচেতন হয়ে ওঠে এবং তার প্রকাশ ঘটে সমকালীন বিভিন্ন পত্রপত্রিকা ও সাহিত্যের মধ্যে ৷ এমত অবস্থায় লর্ড কার্জন বাঙ্গালী জাতির জাগ্রত ব্রিটিশ বিরোধী ভাবধারাকে খন্ডিত করার জন্য "বিভাজন ও শাসন" নীতির অনুসরণ করে শাসন কেন্দ্রিক সুবিধা ও উন্নতার অজুহাতে বাংলাকে বিভক্ত করার পরিকল্পনা পেশ করেন ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে । এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করে বাংলাতে এক অভূতপূর্ব আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে, যা বঙ্গভঙ্গ বিরোধী বা স্বদেশী আন্দোলন নামে পরিচিত ৷
বঙ্গভঙ্গ বিরোধী স্বদেশী আন্দোলন ভারতে জনমানুষে গভীর প্রভাব ফেলে ৷ ছাত্র ,শ্রমিক, নারী সহ সমাজের নানা শ্রেণীর মধ্যে সর্বপ্রথম এই সঙ্ঘবদ্ধ জাতীয় আন্দোলনের সামিল হন ৷ কিন্তু প্রবল উৎসাহ উদ্দীপনার সঙ্গে শুরু হয়েও শেষ পর্যন্ত স্বদেশী আন্দোলন ব্যর্থহীন হয়ে পড়ে ৷ অন্তর্নিহিত নানা ত্রুটি ও দুর্নীতি এই আন্দোলনকে ব্যর্থ করেছিল সেগুলি হল --
স্বদেশী আন্দোলনের পিছনে কোন কার্যকরী সংগঠন ছিল ৷ বয়কটের প্রয়োগ নিয়ে ও নরমপন্থী ও চরমপন্থীদের মধ্যে যথেষ্ট মতপার্থক্য ছিল ৷ এমনকি
কংগ্রেস সংগঠন ও ঐক্যবদ্ধ ছিল না ৷ স্বদেশী ও বয়কট অপেক্ষা নেতৃত্বমন্ডলী তখন নরমপন্থী ও চরমপন্থী নিয়ে বিরোধ ছিল ৷ ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে জাতীয় কংগ্রেসের সুরাট অধিবেশনে শাসন গোষ্ঠীর কাছে ছিল এক বিরাট জয় ৷ স্বদেশী আন্দোলনের নেতৃত্বরা বা নেতৃত্ববৃন্দরা কৃষকদের স্বার্থ সহ একান্ত কোন কর্মসূচি নেন নি ৷ কৃষকদের দাবি-দাওয়া নিয়ে তাদের সংগঠিত করার প্রসঙ্গ এই আন্দোলনে ছিল না ৷ ডক্টর সুমিত সরকারের মতে ," কৃষকদের স্বদেশী আন্দোলনের যুক্ত করার ব্যর্থতা এই আন্দোলনের প্রধান কারণ ছিল ৷"
স্বদেশী আন্দোলনের অন্যতম দুর্বলতা ছিল সাধারণ মুসলিম শ্রেণীর আন্দোলন থেকে বিচ্ছিন্নতা ৷ বঙ্গ বিভাগ মুসলিমদের সর্থের সহায়ক এই তথ্য প্রচারিত হলে মুসলিমরা আন্দোলনের মূল স্রোত থেকে সরে যায় ৷ এছাড়াও আন্দোলনের নেতারা হিন্দু জাতীয়তাবাদকে সমর্থন করলে মুসলিম রা হতাশা হন ৷ লিয়াকত হোসেন, আব্দুল রসূল প্রমূখ অল্প সংখ্যক জাতীয়তাবাদী মুসলমান স্বদেশী আন্দোলনের নেতৃত্ব দিলেও সাধারণ মুসলিম সমাজ এই আন্দোলন থেকে দূরে সরে গিয়েছিল ।
এই আন্দোলন মূলত মধ্যবিত্ত ভদ্রলোক শ্রেণীর মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল ৷ মধ্যবিত্ত ও পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত চাকুরীজীবী ,আইনজীবী, সাংবাদিক ও জমিদাররাই এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন ৷ নিম্নবর্গের বা বর্ণের সাধারণ শ্রমজীবী মানুষ ও কৃষকদের সঙ্গে এই আন্দোলনের কোন সম্পর্ক ছিল না ৷ স্বদেশী আন্দোলন পরিচালনার জন্য যে সমিতি গুলি গঠিত হয় তাতে প্রাধান্য ছিল ভদ্রলোক শ্রেণীর ৷ শ্রমিক ও কৃষকরা সেখানে সামিল হয়নি ৷ উদাহরণস্বরূপ বলা যায় স্বদেশ বাধার সমিতির ৭৩ জন জমিদারের মধ্যে ১৯ জন উকিল ও ১০ জন শিক্ষক ৷ অনেকে মতে এটি ছিল এলিটস আন্দোলন । এই আন্দোলনের মূল শক্তি ছিল উকিল, শিক্ষক ও বিচ্ছিন্ন পেশাদারী ব্যক্তিবর্গ ৷ তারা জমিদার না হলেও মধ্যসত্ত্ব ভোগী ছিলেন এবং স্বাভাবিকভাবে কৃষিভিত্তিক কর্মসূচি গ্রহণ করে সামাজিক অর্থনৈতিক কাঠামোর পরিবর্তনের রাজি ছিলেন না ৷ তাছাড়া এই আন্দোলন এক দিক থেকে হিন্দু কৃষক ও নিম্ন শ্রেণি ৷
অপরদিকে মুসলমান সম্প্রদায়ের সঙ্গে ওই আন্দোলনের কোন আত্মীয় সম্পর্ক গড়ে ওঠেননি ৷ প্রাথমিক পর্বে জাতীয়তাবাদী বেশ কিছু মুসলিম এই আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিল কিন্তু ঢাকার নবাব সলিমউল্লাহ ও তার কিছু সহকর্মী সাম্প্রদায়িক প্রচার কার্য হিন্দু-মুসলিম বিভেদকে তীব্র করে তোলে ৷ এ ব্যাপারে ও হিন্দু নেতৃবৃন্দের দায়িত্ব কম ছিল না। হিন্দু পুনর জীবন বাদ যেমন শিবাজী উৎসব, গণপতি উৎসব, কালীঘাটে মন্দিরের শপথ গ্রহণ ,গঙ্গা স্নান প্রভৃতি মুসলিমদের মনে সন্দেহ ও ত্রাসের সৃষ্টি করে ৷ এইসব কারণে মুসলিমনেত্রী মন্ডলের ক্রমশ ওই আন্দোলন থেকে দূরে সরে আসতে থাকে ৷ সুমিত সরকার বলেছেন ,"নেত্রী মন্ডলের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার ব্যাপারে যথেষ্ট সচেতন হয়নি এর ফলে আন্দোলনের পরিধি সীমিত হয়ে যান এবং তা উচ্চবিত্ত হিন্দু আন্দোলনে চরিত্র ধারণ করে ৷"
কেবল মাত্র মুসলিম সম্প্রদায়ই নয় অমলেন্দু দে, তার "বাঙালি বুদ্ধিজীবী ও বিচ্ছিন্নতাবাদ" গ্রন্থে এবং শেখর বন্দ্যোপাধ্যায় তার "The Nomasudra movement Bengal" গ্রন্থে দেখিয়েছেন যে পূর্ববঙ্গের অধিকাংশই তফসিল হিন্দু বিশেষত নমঃশূদ্র ও রাজবংশীয় হিন্দুরা স্বদেশী আন্দোলনের প্রতি বিরোধ ছিলেন ৷ কারণ তারা উচ্চবর্ণ হিন্দুদের শোষণের জর্জরিত ছিলেন এবং এই উচ্চ বর্ণের হিন্দুরাই স্বদেশী আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ৷ ড, রজত কান্ত রায় ও একই ধরনের বক্তব্য পেশ করেন ৷
প্রবল উত্তেজনা ও উদ্দীপনা সাথে শুরু হলেও কাতর ধরনীর মধ্য দিয়ে এই আন্দোলনের অবসান ঘটে ৷
তোমাকে অনেক ধন্যবাদ বাংলায় স্বদেশি আন্দোলনের ব্যর্থতা ও সীমাবদ্ধতা উল্লেখ কর অথবা, বাংলায় স্বদেশি আন্দোলনের সীমাবদ্ধতার দিকগুলি বিশ্লেষণ করো। এই নোটটি পড়ার জন্য