আকবর ও ঔরঙ্গজবের রাজপুত নীতির তুলনা করো
![]() |
একটি সাম্রাজ্য পরিচালনা করার সময় একজন রাজা কূটনীতিকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে থাকেন । কারণ এর উপর ভিত্তি করেই অন্য সাম্রাজ্য বা দেশের সঙ্গে একটি সাম্রাজ্যের সংযোগ স্থাপিত হয় । মুঘল সম্রাট আকবরের কূটনৈতিক দক্ষতার সর্বোত্তম দৃষ্টান্ত হল রাজপুত নীতি । ড.পার্সিভ্যাল স্পিয়ারের মতে "রাহ্মণরা যদি হিন্দুধর্মের মানসিক শক্তি হয় তাহলে রাজপুতরা ছিল তাদের শক্তি।" - আওরঙ্গজেব এই মন্তব্যের সত্যতা উপলব্ধি করতে অক্ষম ছিলেন, তবে আকবর পেরেছিলেন । আকবর রাজপুতদের প্রতি সৌহার্দপূর্ন বা বন্ধুত্ব পূর্ণ নীতি গ্রহণ করলেও ঔরঙ্গজেব রাজপুতদের তলোয়ারের সামনে রেখে তাদেরকে পদানত করার নীতি গ্রহণ করেন ।
আপনি চাইলে এগুলো পড়তে পারেন
মুঘল সম্রাট আকবর, বুঝতে পেরেছিলেন যে ভারতে মুঘল সাম্রাজ্য বজায় রাখতে তার বিশেষজ্ঞ রাজপুতদের সহায়তা প্রয়োজন হবে । আকবর বীরত্ব ও বীরত্বের দিক থেকে অন্যান্য উত্তর ভারতীয় জাতিদের উপর রাজপুতদের শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কেও পুরোপুরি সচেতন ছিলেন । কিন্তু ওরঙ্গজেব সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হওয়ার আগেই রাজপুতরা তার সঙ্গে ভালোভাবে মিশে গিয়েছিল । যাইহোক, সিংহাসন লাভের দশ বছর পর থেকে ঔরঙ্গজবের একের পর এক অবিবেচিত নীতি রাজপুতদের ক্ষুদ্ধ ও শত্রুতে পরিণত হয় ।
রাজপুতদের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তোলার প্রয়াসে, আকবর বিকানীর অম্বররাজ বিহারীমলের রাজকন্যা মণিবাঈকে বিবাহ করেন । উপরন্তু, তিনি তার নিজের ছেলে সেলিমকে ভগবান দাসের কন্যার সাথে বিয়ে দিয়ে হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতির একটি নতুন যুগের উদ্ভব ঘটান । রাজপুতদের আনুগত্য জয়ের প্রচেষ্টায় আকবর তাদের গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ও প্রশাসনিক পদ দেন । উদাহরণস্বরূপ, আকবর বীরবলকে উপদেষ্টা এবং টোডরমলকে রাজস্ব মন্ত্রী হিসাবে মনোনীত করেছিলেন ।
আকবর রাজপুতদের স্নেহ ও সম্মান অর্জনের জন্য অনেক চেষ্টা করেছিলেন । 1563 খ্রিস্টাব্দে, তিনি "হিন্দু তীর্থযাত্রী কর" এবং 1564 খ্রিস্টাব্দে "জিজিয়া কর" আরোপ করেন । আকবর রাজপুতদের উপর জয়লাভ করার প্রয়াসে সংস্কৃত ভাষার শ্রেষ্ঠত্বের প্রতি আগ্রহী হতে শুরু করেন । কপালে 'তিলক' পরিয়ে তিনি রাজসভায় বসতেন এবং সমস্ত হিন্দুদের দেখানো আতিথেয়তা উপভোগ করতেন । তিনি রাজপুতদের ঘোড়াগুলিকে 'দাগ' চিহ্নে চিহ্নিত করার থেকে অব্যাহতি দেন । মেবার, রণথম্বোর আকবরের সাথে মৈত্রী বন্ধনে আবদ্ধ হতে না চাইলে আকবর যুদ্ধনীতির দ্বারা এই দুটি রাজ্য দখলের চেষ্টা করেন । এক্ষেত্রে তিনি অন্যান্য রাজপুত রাজাদের নিজের পক্ষে রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন ।
আকবর রাজপুতদের প্রতি বন্ধুত্বপূর্ন নীতি গ্রহণ করলেও ঔরঙ্গজেব ভিন্নপথে পরিচালিত হন । তিনি রাজপুতদের প্রতি ধ্বংসাত্মক নীতি গ্রহণ করেছিলেন বলে ঐতিহাসিকরা মনে করে থাকে । রাজপুতরা যশোবোন্ত সিংহের একমাত্র জীবিত শিশুপুত্র অজিত সিংহকে মাড়োয়ারের সিংহাসনে বসার জন্য ঔরঙ্গজেবকে অনুরোধ করেন । ঔরঙ্গজেব মোগল হারেম অজিত সিংহকে প্রতিপালনের শর্ত দেন । এতে রাজপুত জাতি ক্ষুদ্ধ হলে রাজপুতদের সাথে মোঘলদের বিরোধ বাঁধে । স্যার যদুনাথ সরকার এক্ষেত্রে, ঔরঙ্গজেবের ধর্মনীতিকে দায়ী করেন।
আসলে ঔরঙ্গজেব ভেবেছিলেন, যে শক্তিশালী মারোয়ারদের প্রথমে রাজ্যের অংশ হওয়া উচিত এবং অন্যান্য মারোয়াররা নিজেরাই ইসলাম গ্রহণ করবে । আওরঙ্গজেব এ কারণে ইসলামিকরণ নীতি গ্রহণ করেন । মুঘল সাম্রাজ্যের নাম "দার-উল-হারব" থেকে "দার-উল-ইসলাম" এ পরিনত করতে চাইলে রাজপুতরা ঔরঙ্গজেবের শত্রুতে পরিণত হয় ।
রাজপুতদের ধ্বংসের লক্ষ্যে ঔরঙ্গজেব তাদের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হলে, তার ফলাফল ছিল বিপর্যয়কর । আওরঙ্গজেব শেষ পর্যন্ত মারওয়ার এবং মেবারের সঙ্গে যুদ্ধ করলেও শেষপর্যন্ত ঔরঙ্গজেব রাজপুতদের সাথে সন্ধির প্রস্তাব করেন । আইন এর আলোকে, ওরঙ্গজেব এবং মেবারের রানা জয়সিংহ 1681 সালে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেন । তিনি চুক্তির মাধ্যমে জয়সিংহকে মেবারের রানা হিসাবে স্বীকার করেন ।
ওরঙ্গজেবের রাজপুত কৌশল শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয় এবং এর ফলে সাম্রাজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়। রাজপুতদের বিরুদ্ধে আওরঙ্গজেবের সামরিক নীতির কারণে মুঘল রাজকোষ ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যার ফলে জনসংখ্যাও হ্রাস পায় । যদুনাথ সরকারের ভাষায়, " ঔরঙ্গজেবের রাজপুত যুদ্ধের ফলে সাম্রাজ্যের মর্যাদা তো ক্ষুন্ন হয়েইছিল; বৈষয়িক ক্ষতির পরিণামও কম ছিল না।" অধ্যাপক আতাহার আলী ও সতীশচন্দ্রের মতে, " আসলে ঔরঙ্গজেব তদানীন্তন পরিস্থিতির চাপে পড়েই রাজপুত নীতি গ্রহণ করেছিলেন।"
সুতরাং, আকবর ও ঔরঙ্গজেব উভয় মোগল সম্রাটের রাজপুত নীতির আদর্শ ছিল একেবারেই অভিন্ন ছিল । মধ্যযুগের বাতাবরণে আকবর রাজপুতদের ক্ষেত্রে বন্ধুত্বপূর্ন নীতি গ্রহণ করায় ঐতিহাসিকরা তার কূটনীতিকে "A Master of Diplomacy" বলে অভিহিত করেছেন । অন্যদিকে, আওরঙ্গজেব আকবরের সমধর্মী আদর্শ নীতি থেকে বিচ্যুত হন । তার লক্ষ্য ছিল ভারতে ইসলামের শিক্ষা নিয়ে আসা এবং একটি মুসলিম রাষ্ট্র গড়ে তোলা । জবাবে তিনি রাজপুতদের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন যার খেসারত সম্রাটকে সারাজীবন দিতে হয় ।