ঔরঙ্গজেবর দাক্ষিণাত্য নীতি আলোচনা কর বা,ঔরঙ্গজেবের দাক্ষিণাত্যনীতি মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের জন্য কতখানি দায়ী ছিল?
ঔরঙ্গজেবর দাক্ষিণাত্য নীতি আলোচনা কর
সম্রাট ঔরঙ্গজেব দিল্লির মুঘল সিংহাসনে বসার আগে দাক্ষিণাত্যের সুবাদার বা প্রাদেশিক শাসক ছিলেন ৷ সিংহাসনে বসার পর তিনি দাক্ষিণাত্যে ত্রুটিপূর্ণ নীতি গ্রহণ করে ৷ তার দাক্ষিণাত্য নীতির মূলত দুটি উদ্দেশ্য ছিল, প্রথমতঃ, দাক্ষিণাত্যের বিজাপুর ও গোলকুন্ডা নামের দুটি শিয়া রাজ্য দখল করেই মুঘল সাম্রাজ্যের সম্প্রসারণ ঘটানো এবং দ্বিতীয়টি শিবাজী নেতৃত্বে দাক্ষিণাতে নবজাগ্রত মারাঠা শক্তিকে দমন করা ৷
সেনাপতি জয়সিংহ,দিলির খাঁ জয়বন্ত সিংহ প্রমূখকে দাক্ষিণাত্যে নিয়োগ করেও তিনি সেখানে বিশেষ সাফল্য লাভ করতে পারেনি । অবশেষে সম্রাট নিজেই ১৬৮২ খ্রিস্টাব্দে দাক্ষিণাত্যে উপস্থিত হন এবং জীবনের শেষ ২৬ বছর দাক্ষিণাত্যেই কাটান ৷
দাক্ষিণাত্যের শিবাজীর নেতৃত্বে মারাঠা জাতির উত্থান ওরঙ্গজেবের চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায় ৷ মুঘল অধিকৃত বিভিন্ন স্থান দখল আফজল খাকে হত্যা ওরঙ্গজেবের খাতুন শায়েস্তা খাঁকে পরাজিত করা প্রভৃতি ঘটনার মাধ্যমে শিবাজী নেতৃত্বেই মারাটা বাহিনী অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠে ৷ কিন্তু মুঘল সেনাপতি জয় সিংহের কাছে পরাজিত হয়ে শিবাজি ১৬৬৫ খ্রিস্টাব্দে মুঘলদের সঙ্গে পুরুন্দরের সন্ধি স্বাক্ষর করতে বাধ্য হয় ৷ এই সন্ধির দ্বারা আর শিবাজী 35 টি দুর্গের মধ্যে ২৩ টি দুর্গ এবং রাজ্যের ¾ অংশ মুঘলদের ছেড়ে দিতে বাধ্য হন ৷
পরবর্তীকালে ঔরঙ্গজেব ছলনা করে শিবাজী কে আমন্ত্রণ জানিয়ে আগ্রা এনে তাকে বন্দী করে ৷ কিন্তু কয়েক মাস পর শিবাজী আমিন খাঁনের সহায়তায় সুকৌশলে পালিয়ে মহারাষ্ট্রে পৌঁছান ৷ তিনি ১৬৭০ খ্রিস্টাব্দে নতুন উদ্যোগে মোগলবিরোধী যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন ৷ তিনি একে একে হারানো অঞ্চলগুলিকে মুঘলদের হাত থেকে উদ্ধার করেন এবং মুঘল অধিকৃত অঞ্চল থেকে চৌথ ও স্বরদেশমুখী দুই প্রকার বলপূর্বক করা আদায় করে নিজের শক্তি বৃদ্ধি করে ৷ ১৬৭৪ খ্রিস্টাব্দে রায়গড় এর শিবাজীর অভিষেক হয় এবং তিনি 'ছত্রপতি' উপাধি গ্রহণ করেন ৷ ১৬৮০ খ্রিস্টাব্দের শিবাজীর মৃত্যু হয়, কিন্তু তার মৃত্যুতে ঔরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে মারাঠাদের লড়াই বন্ধ হয়নি ৷
গোড়া সুন্নি আদর্শের বিশ্বাসী ওরঙ্গজেবের দাক্ষিণাত্যে মুসলিম রাজ্য বিজাপুর কে পদণত করার জন্য সেখানে ১৬৬৫,১৬৮০,১৬৮২ খ্রিস্টাব্দে তিনটি অভিযান পাঠান ৷ এই অভিযান গুলিতে নেতৃত্ব দেন যথাক্রমে জয়সিংহ, দিল্লীর খা এবং যুবরাজ আজম ৷ কিন্তু তিনটি অভিযানে ব্যর্থ হলে ঔরঙ্গজেব নিজে সৈন্য সমেত বিজাপুর অভিযান করে সেখানকার শাহী বংশীয় সিকান্দারকে বশ্যতা স্বীকার করতে বাধ্য করে ৷ ১৬৮৫ খ্রিস্টাব্দে বিজাপুরের ২০০ বছর পুরানো আদিল শাহী বংশের পতন হয় এবং বিজাপুর মুঘল সাম্রাজ্য ভুক্ত হয় ৷
দাক্ষিণাত্যে অপর এক রাজ্য গোলকোন্ডা কিছু ঘটনা ওরঙ্গজেব কে সেখানে অভিযান করতে বাধ্য করে ৷ গোলকুন্ডার হিরে ও লোহার খনি এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদ ওরঙ্গজেবকে গোলকুন্ডা আক্রমণে প্রলুব্ধ করে ৷ পূর্বে এ গোলকুন্ডা মুঘলদের বার্ষিক কর প্রদানের প্রতিশ্রুতি দিলেও তা তারা ঠিক মতো পালন করত না ৷ এছাড়াও মদন্য ও আকণ্ড নামে দুজন হিন্দু ব্রাহ্মণ গোলকুন্ডার প্রধানমন্ত্রী ও সেনাপতি পদে নিযুক্ত হলে ঔরঙ্গজেব ক্ষুদ্ধ হয়ে তাদের অপসারণের দাবি জানায় ৷ গোলকুণ্ডা সুলতান আবুল হাসানকে চরমপত্র পাঠান সুলতান এই দাবি উপেক্ষা করলে ঔরঙ্গজেব মুয়াজ্জমের নেতৃত্বে গোলকন্ডার অভিযান পাঠান ৷ কিন্তু তীব্র লড়াই করে ও মুঘল বাহিনী গোলকুন্ডা দখলে ব্যর্থ হয় ৷ অবশেষে আবদুল নামে এক চৌনিক বিশ্বাসঘাতক দূর্গের দরজা খুলে দিলে আবুল হাসান বাধ্য হয়ে আত্মসমর্পণ করেন ৷ ১৬৮৭ খ্রিস্টাব্দে গোলকুন্ডা মুঘল সাম্রাজ্যভুক্ত হয় ৷
শিবাজীর মৃত্যুর পর যোগ্য নেতৃত্বের অভাবে মারাঠা শক্তিই কিছুদিনের জন্য দুর্বল হয়ে পড়ে ৷ শিবাজীর পুত্র শম্ভুজী ১৬৪৯ খ্রিস্টাব্দে মুঘল পরাজিত হয়ে বন্দী হয়ে মোগলদের হাতে নিহত হন ৷ ইতিমধ্যে শম্ভুজির ভাতা রাজারাম মারাঠা সিংহাসনে বসলে রায়গর অভিযান করে শম্ভুজির নাবালক পুত্র সাহুসহ রাজ পরিবারের অনেক সদস্যকে বন্দী করে ৷ তার মৃত্যুর পর তার পত্নি ও নাবালক শিশু পুত্র তৃতীয় শিবাজী কে সিংহাসনে বসিয়ে মোগল বিরোধী তুমূল লড়াই শুরু করে ৷
ঔরঙ্গজেবের দাক্ষিণাত্য নীতির ফলাফল মুঘল সাম্রাজ্যের পক্ষে মোটেও সুখকর হয়নি ৷ তিনি দাক্ষিণাত্যে একের পর এক ভুল করে মুঘল সাম্রাজ্যের সংকটবৃদ্ধি করেন ৷ ঐতিহাসিক ভিনসেন্ট স্মিথ এবং এলফিনস্টোন মনে করেন যে ঔরঙ্গজেব দাক্ষিণাত্যের বিজাপুর ও গোলকোন্ডা নামে শিয়া রাজ্য দুটি দখল করে ভুল করে ৷ তিনি রাজ্য দুটি দখল না করে এদের শক্তিকে মারাঠাদের বিরুদ্ধে কাজে লাগাতে পারত রাজ্য দুটি মারাঠাদের প্রতিরোধ করতে মুঘলদের সুবিধা হত ৷ দুটি দখল করায় মারাঠা প্রতিরোধ মুক্ত হয় । শেষ পর্যন্ত রণক্লান্ত ৯০ বছরের বৃদ্ধ সম্রাট হতাশা আর শোক নিয়ে দাক্ষিণাত্যেই মৃত্যুবরণ করে ৷ মুঘল শাসনব্যবস্থাতেও ভাঙ্গন শুরু হয় । ঐতিহাসিক ভিনসেন্ট স্মিথ মন্তব্য করেছেন যে ঔরঙ্গজেবের দাক্ষিণাত্য নীতি শুধু ঔরঙ্গজেবের নয় তার সাম্রাজ্যের ও সমাধি রচনা করেছিলেন ৷ ঐতিহাসিক যদুনাথ সরকার বলেছেন যে,"স্পেনীয় ক্ষত যেমন নেপোলিয়ানকে ধ্বংস করেছে তেমনি দাক্ষিণাত্য নীতি ঔরঙ্গজেবের ধ্বংস সাধন করেছিল ৷"
তোমাকে অনেক ধন্যবাদ ঔরঙ্গজেবর দাক্ষিণাত্য নীতি আলোচনা কর এই নোটটি পড়ার জন্য