গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের কারণ সমূহ আলোচনা করো।
![]() |
Historichalls |
পৃথিবীর ইতিহাসে কোন সাম্রাজ্যই চিরস্থায়ী নয়, কালের অমোঘ নিয়মে একদা শক্তিশালী গুপ্ত সাম্রাজ্যকেও পতনের হাত থেকে রক্ষা করা যায়নি। সমুদ্রগুপ্ত ও দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের কৃতিত্বে উত্তর ও দক্ষিণ ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে যে বৃহৎ গুপ্ত সাম্রাজ্য গড়ে উঠেছিল, অল্পকালের মধ্যেই তা পতনের পথে ধাবিত হয়। কিন্তু কোন সাম্রাজ্যের উত্থান যেমন একদিন বা আকস্মিক ভাবে হয় না, তেমনি পতনও একদিনে বা একটি মাত্র কারণে ঘটে না। গুপ্ত সম্রাজ্যের পতনের জন্যও তাই একাধিক কারণের সমন্বয় খুঁজে পাওয়া যায়।
আপনি চাইলে এগুলো পড়তে পারেন
- প্রথমতঃ গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের অন্যতম প্রধান কারণ ছিল দুর্বল ও অযোগ্য উত্তরাধিকার। আমরা জানি স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থায় কেন্দ্রীয় সরকার বা রাজার যোগ্যতা, ব্যক্তিত্ব, দক্ষতা ও দূরদৃষ্টি রাজ্যের উন্নতি ও সংহতির প্রধান শর্তরূপে বিবেচিত হয়। স্কন্দগুপ্তকে গুপ্ত বংশের শেষ শক্তিশালী সম্রাট বলে ধরা হয়। তার পরবর্তী শাসকেরা ছিলেন দুর্বল ও অযোগ্য। তাদের পক্ষে বিশাল গুপ্ত সাম্রাজ্যের স্থায়িত্ব বজায় রাখা অসম্ভব হয়ে পড়ে। অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে প্রাদেশিক বিচ্ছিন্নতাবাদ মাথাচাড়া দিয়েছিল, তেমনি বৈদেশিক শক্তির আক্রমণ অবশ্যম্ভাবী হয়েছিল।
- দ্বিতীয়তঃ কোন সুনির্দিষ্ট উত্তরাধিকার আইন গুপ্তরাজ পরিবারে ছিল না। ফলে সিংহাসনের দখল নিয়ে বার বার দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়েছিল। সমুদ্রগুপ্তের সময় থেকে শুরু করে স্কন্দগুপ্তের সময় পর্যন্ত এই ভ্রাতৃ বিরোধ বজায় ছিল। পরাক্রান্ত সম্রাটদের আমলে এর ক্ষতিকর দিকটি বোঝা না গেলেও পরবর্তী সময়ে এই ত্রুটি প্রকট হয়ে ওঠে।
- তৃতীয়তঃ গুপ্ত সম্রাটগণ ক্রমশ যুদ্ধবিগ্রহের পথ থেকে সরে এসে আধ্যাত্মিক জগতের পথে পা বাড়ায়। কুমারগুপ্তের 'অপ্রতিঘ' নামাঙ্কিত মুদ্রা থেকে অনুমিত যে বৃদ্ধ বয়সে তিনি সন্ন্যাসধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। তাছাড়া গুপ্তরাজপরিবারে ক্রমশ বৌদ্ধধর্মের প্রভাব বৃদ্ধি পায়। এবিষয়ে বৌদ্ধ পন্ডিত বসুবন্ধু উল্লেখযোগ্য ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। তিনি ছিলেন বালাদিত্যের আচার্য, এই বালাদিত্যই মায়ের অনুরোধে পরাজিত ও বন্দি হুণনেতা মিহিরকুলকে মুক্তি দেন। এই ঘটনা তাঁর মনের উদারতা প্রকাশ করলেও সাম্রাজ্যের পক্ষে ছিল চরম ক্ষতিকর।
- চতুর্থতঃপ্রাদেশিক শাসনকর্তাদের বিদ্রোহ ও স্বাধীনতাকামীতা গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনকে অবশ্যম্ভাবী করে তুলেছিল। সমুদ্রগুপ্ত পরাজিত রাজাকে নিয়মিত করদান ও আনুগত্যের বিনিময়ে তাদের রাজ্য ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে গুপ্তরাজাদের দুর্বলতার কারণে এই প্রাদেশিক শাসকগণ স্বাধীন হয়ে বিদ্রোহ করলে তাদের দমন করা সম্ভব হয়নি। স্কন্দগুপ্ত পরবর্তী আঞ্চলিক শাসকেরা তাদের লিপিতে এমনকি গুপ্ত রাজাদের নাম পর্যন্ত বাদ দিতে থাকে।
- পঞ্চমতঃত্রুটিপূর্ণ ভূমিদান ব্যবস্থা গুপ্তবংশের দুর্বলতাকে ঘনীভূত করেছিল। দেখা গেছে মৌর্য যুগে ভূমির নিচে অবস্থিত খনিজ পদার্থে রাজার অধিকার বজায় থাকত। একইভাবে দানকৃত গ্রামের প্রশাসনিক কর্তৃত্বও থাকত রাজার হাতে। কিন্তু গুপ্তযুগে ব্রাহ্মণ্য বা কোন সংস্থাকে ভূমিদান করলে, সেই ভূমির উপর রাজার কোন দাবী থাকত না। এমনকি ঐভূমির প্রশাসনিক কর্তৃত্বও দানগ্রহীতার উপর বর্তাত।
- ষষ্ঠতঃগুপ্তদের সমসাময়িক একটি গুরুত্বপূর্ণ শক্তি ছিল বকাটকরা। দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত এদের সঙ্গে মৈত্রীর সম্পর্ক গড়ে তুললেও পরবর্তীকালে এই মৈত্রীতে ফাটল ধরেছিল। কুমারগুপ্ত বকটিকদের আক্রমণ করলে বকাটকদের সঙ্গে গুপ্তদের সম্পর্কের অবনতি ঘটে। তাই বকাটকরাজ নরেন্দ্র সেন গুপ্ত সাম্রাজ্য আক্রমণকারী পুষ্যমিত্রদের সাহায্য করেছিলেন প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য। জুনাগড় লিপিতে উল্লেখিত বৈরি রাজাগণ ছিলেন সম্ভবত এই বকাটকগণ।
- সপ্তমতঃ গুপ্তরাজাদের নিজস্ব বা প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণে কোন সুগঠিত সেনাবাহিনী ছিল কিনা তা জানা যায় না। এমনকি হরিষেণের প্রশস্তিতেও গুপ্ত সৈন্যবাহিনীর কোন উল্লেখ নেই। তাছাড়া গুপ্তদের ব্যবহৃত অস্ত্রশস্ত্রের মান সম্পর্কেও সঠিক জানা যায় না। পুষ্যমিত্র বা হুণ আক্রমণকারীদের ব্যবহৃত অস্ত্রের মোকাবিলা করার মত অস্ত্র খুব সম্ভব গুপ্তদের ছিল না।
পরিশেষে হুণ আক্রমণ গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের শেষ অধ্যায় রচনা করেছিল। স্কন্দগুপ্তের আমলে সাফল্যের সঙ্গে হুণ আক্রমণ প্রতিরোধ করা গেলেও পরবর্তীকালে তোরমানের নেতৃত্বে হুণরা আবার আক্রমণ চালায়। অভ্যন্তরীণ দ্বন্দুে দীর্ণ গুপ্ত সাম্রাজ্য এই আক্রমণ প্রতিরোধে ব্যর্থ হয়। হুণ আক্রমণের মোকাবিলা করতে গিয়ে গুপ্ত রাজকোষে ব্যাপক চাপ পড়ে, যা সাম্রাজ্যের পক্ষে অত্যন্ত ক্ষতিকর হয়ে ওঠে।
তোমাকে অনেক ধন্যবাদ গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের কারণ সমূহ আলোচনা করো। এই নোটটি পড়ার জন্য