বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ছয় দফা সম্পর্কে আলোচনা কর অথবা,১৯৬৬ সালের ৬ দফা আন্দোলনের পটভূমি ও গুরুত্ব আলোচনা কর
![]() |
১৯৬৬ সালের ঐতিহাসিক ছয় দফা আন্দোলনের পটভূমি
'পাকিস্তান' রাষ্ট্র সৃষ্টি হয়েছিল লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে। লাহোর প্রস্তাবে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের কথা বলা হলেও পাকিস্তানে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠিত হয়নি। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই পূর্ব বাংলার জনগণের উপর শুরু হয় পশ্চিমা শাসক গোষ্ঠীর শোষণ, বঞ্চনা ও নির্যাতন। ফলে সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক বৈষম্য পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে প্রকট আকার ধারণ করে। পশ্চিমা শাসক গোষ্ঠীর অপশাসনের বিরুদ্ধে পূর্ব বাংলার আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করে। ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধ শুরু হলে পূর্ব পাকিস্তান সম্পূর্ণ অরক্ষিত হয়ে পড়ে। সামরিক দিক থেকে পূর্ব পাকিস্তানের অসহায় অবস্থা এবং অর্থনৈতিক বৈষম্য থেকে মুক্তির লক্ষে শুরু হয় স্বাধিকারের আন্দোলন। শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ এ আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে।
আপনি চাইলে এগুলো পড়তে পারেন
১৯৬৬ সালের ৫-৬ ফেব্রুয়ারি লাহোরে বিরোধী দলের এক সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। উক্ত সম্মেলনে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে শেখ মুজিবুর রহমান ঐতিহাসিক 'ছয় দফা' কর্মসূচি পেশ করেন। এরপর তিনি জনমত সৃষ্টি করতে হয় দফা দেশবাসীর সামনে তুলে ধরেন। ছয় দফা কর্মসূচিকে তিনি 'পূর্ব বাংলার বাঁচার দাবি' বলে অভিহিত করেন। বাঙালী জনগণ কর্তৃক উক্ত কর্মসূচি দ্রুত সমাদৃত হয়।
ছয় দফা কর্মসূচি
পশ্চিমা শাসক গোষ্ঠী কর্তৃক পূর্ব বাংলাকে শোষণের বিরুদ্ধে হয় দফা কর্মসূচি ছিল তীব্র প্রতিবাদ আর বাঙালির অধিকার আদায়ের সনদ বা মুক্তিসনদ। ছয় দফা কর্মসূচি ছিল নিম্নরূপ।
- ১ম দফাঃ লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে পাকিস্তানের জন্য সত্যিকার অর্থে একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করতে হবে। সরকার হবে সংসদীয় পদ্ধতির। সর্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে সকল প্রাপ্ত বয়স্কের ভোটে জাতীয় ও প্রাদেশিক আইনসভাগুলো গঠিত হবে।
- ২য় দফাঃ যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের হাতে থাকবে দেশরক্ষা ও পররাষ্ট্র বিষয়। অবশিষ্ট সকল বিষয় প্রদেশের হাতে থাকবে।
- ৩য় দফাঃ দেশের দুই অঞ্চলের জন্য দুটি পৃথক অথচ সহজ বিনিময়যোগ্য মুদ্রা চালু থাকবে অথবা দেশের দুই অঞ্চলের জন্য একই মুদ্রা থাকবে। তবে সংবিধানে এমন ব্যবস্থা রাখতে হবে যাতে এক অঞ্চলের মুদ্রা ও মূলধন অন্য অঞ্চলে পাচার হতে না পারে।
- ৪র্থ দফাঃ সকল প্রকার ট্যাক্স, খাজনা ও কর ধার্য এবং আদায়ের ক্ষমতা প্রাদেশিক সরকারের হাতে থাকবে তবে কেন্দ্রিয় সরকারের ব্যয় নির্বাহের জন্য আদায় কৃত অর্থের একটি অংশ কেন্দ্রিয় সরকার পাবে।
- ৫ম দফাঃ বৈদেশিক বাণিজ্যি ও বৈদেশিক মুদ্রার উপর প্রাদেশিক সরকারের ক্ষমতা থাকবে। সকল প্রকার বৈদেশিক চুক্তি ও সহযোগিতার ব্যাপারে প্রাদেশিক সরকার দায়িত্ব পালন করবে। তবে যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা যুক্তিযুক্ত হারে উভয় সরকার কর্তৃক মেটানো হবে।
- ৬ষ্ঠ দফাঃআঞ্চলিক নিরাপত্তার জন্য আঞ্চলিক সরকারগুলো স্বীয় কর্তৃত্বাধীন আধা সামরিক বাহিনী (প্যারা মিলিশিয়া) গঠন ও পরিচালনা করতে পারবে।
ছয় দফা কর্মসূচির মূল আবেদন ছিল পূর্ব পাকিস্তান শুধু একটি প্রদেশ নয় বরং একটি স্বতন্ত্র স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল। সকল প্রকার শোষণ ও বঞ্চনার অবসান ঘটানোই ছিল এর লক্ষ্য।
ছয় দফা আন্দোলন
ছয় দফা কর্মসূচি পূর্ব বাংলার অবহেলিত ও স্বাধিকারকামী মানুষের নিকট দ্রুত সমাদৃত হয়। ছয় দফা কর্মসূচির জনপ্রিয়তা অর্জন ক্রমশ একটি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে রূপ লাভ করে। স্বৈরাচারী আইয়ুব খানের দোসর মোনায়েম সরকার ছয় দফা আন্দোলনকে 'রাষ্ট্রবিরোধী আন্দোলন' বলে অভিহিত করে। শেখ মুজিবসহ আওয়ামী লীগ নেতাদের বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন আদালতে মামলা দায়ের করা হয়। বন্দি নেতাকর্মীদের মুক্তির দাবিতে দেশব্যাপী আন্দোলন ও হরতাল শুরু হয়। সভা ও শোভাযাত্রা বন্ধের জন্য সরকার ১৪৪ ধারা জারি করে। শেখ মুজিব সহ আওয়ামী লীগ নেতাগণ প্রতিটি মামলায় মুক্তি লাভ করেন। এতে আইয়ুব সরকার ক্ষিপ্ত হয়ে আওয়ামী লীগ নেতাদের বিশেষ করে শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে নিত্য নতুন মামলা রুজু করে কারাগারে প্রেরণ করে। ১৯৬৬ সালের ৭ জুন পূর্ব বাংলায় হরতাল আহবান করা হয়। ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে হয় দফার পক্ষে সভা ও শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণ করে। এ আন্দোলনে প্রায় এক হাজার আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী গ্রেফতার এবং পুলিশের গুলিতে শত শত লোক আহত এবং ১২ জন নিহত হয়। ১৬ জুন পূর্ব বাংলার মুখপাত্র 'ইত্তেফাক' নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয় এবং এর সম্পাদক তোফাজ্জল হোসেন (মানিক মিয়া)-কে গ্রেফতার করা হয়। এতসব সত্ত্বেও সরকার ছয় দফা ভিত্তিক আন্দোলন দমন করতে ব্যর্থ হয়। আন্দোলনের ফলে ছয় দফা জনগণের ম্যান্ডেট লাভ করে। শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জনগণের নিকট নির্ভীক, আপোসহীন ও ত্যাগী নেতায় পরিণত হন।
ছয় দফার গুরুত্ব ও তাৎপর্য
ছয় দফা কর্মসূচিকে পাকিস্তানের শাসক জেনারেল আইয়ুব খান বিচ্ছিন্নতাবাদী কর্মসূচি বলে আখ্যায়িত করেন এবং প্রবক্তাদের ওপর হয়রানি ও জুলুম শুরু করে। ছয় দফা কর্মসূচি ছিল বাঙালিদের ন্যায্য অধিকার আদায়ের সনদ। ছয় দফা ভিত্তিক আন্দোলনে সরকারের নির্যাতনমূলক ব্যবস্থা বাঙালিদের মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। হয় দফা আন্দোলনে অনেক নির্যাতন এবং অনেক তাজা রক্ত করেছে। অনেক মায়ের বুক খালি হয়েছে। হয় সফা এতই প্রবল ছিল যে অনেক অত্যাচার, নির্যতন সত্ত্বেও বায়ালিয়া আন্দোলন থেকে সরে যান নাই বরং আরও বেশি সংগঠিত হয়েছেন। যার ফলশ্রুতিতে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বাঙালি জনতা অকুণ্ঠ চিত্তে আওয়ামী লীগকে বিপুল ভোটে জয়যুক্ত করে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের প্রবল প্রেরণা আসে ছয় দফার ঐক্য থেকে। তাই ছয় দফাকে বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ বলা যায়।