ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে আলোচনা কর অথবা, বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে ভাষা আন্দোলনের প্রভাব বর্ণনা কর

 ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে আলোচনা কর অথবা, বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে ভাষা আন্দোলনের প্রভাব বর্ণনা কর 

ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে আলোচনা কর অথবা, বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে ভাষা আন্দোলনের প্রভাব বর্ণনা কর

ভাষা আন্দোলন (১৯৪৮-১৯৫২)


বাংলাদেশের স্বাধীনতার বীজ সৃষ্টিতে ১৯৪৮ এবং ১৯৫২ এ দুটি পর্যায় রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষাকে প্রতিষ্ঠার জন্য পূর্ব বাংলার ছাত্র-জনতার আন্দোলন এক যুগান্তকারী ঘটনা। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকেই পশ্চিম পাকিস্তানভিত্তিক শাসকগোষ্ঠী পূর্ব বাংলার জনগণের ভাষা ও সংস্কৃতির বিনাশ সাধনের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। ১৯৪৭ সালেই করাচিতে অনুষ্ঠিত শিক্ষা সম্মেলনে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব করা হয়। এর বিরুদ্ধে অধ্যাপক আবুল কাশেমের নেতৃত্বে তমুদ্দুন মজলিস, ১৯৪৭ সালে প্রথমে নূরুল হক ভূইয়া পরে সামছুল হকের নেতৃত্বে ১৯৪৮ সালে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। এ পরিষদ পূর্ব বাংলার শিক্ষার মাধ্যম ও অফিস- আদালতে সর্বত্র বাংলা ভাষার ব্যবহার এবং সমগ্র পাকিস্তানে উর্দুর পাশাপাশি বাংলাকেও সমগ্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মর্যাদা দানের দাবি তোলে। ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি বিষয়টি গণপরিষদের প্রথম অধিবেশনে উত্থাপিত হয়। তখন সমগ্র পূর্ব বাংলাব্যাপী ছাত্র ধর্মঘট, শোভাযাত্রা এবং প্রবল দাবির মুখে পূর্ব বাংলার প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন ভাষার দাবি মেনে নেন এবং ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে এক চুক্তি করেন।


আপনি চাইলে এগুলো পড়তে পারেন

কিন্তু ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ রেসকোর্সে এবং ২৪ মার্চ কার্জন হলের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব ঘোষণা করেন। এতে পূর্ববাংলার শিক্ষার্থী, শিক্ষক, পেশাজীবী, জনতা বিক্ষোভে ফেটে পড়েন। ১৯৫০ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান কর্তৃক গণপরিষদে পেশকৃত 'মূলনীতি কমিটির' রিপোর্টে উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উল্লেখ করা হয়। এতে গণপরিষদের বাঙালি সদস্যগণ এবং পূর্ববাংলার জনগণ বিক্ষুব্ধ হন। ১৯৫২ সালের ২৬ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন ঢাকার পল্টন ময়দানে এক জনসভায় উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা প্রদান করলে সমগ্র পূর্ববাংলায় তীব্র বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ শুরু হয়ে যায়। কেননা ১৯৫১ সালে ভাষার ভিত্তিতে পাকিস্তানের জনগণের শতকরা হার অনুযায়ী বাংলা ছিল ৫৬.৪০ ভাগ আর উর্দু ছিল ৩.২৭ ভাগ। খাজা নাজিমুদ্দিনের ঘোষণার প্রতিক্রিয়ায় ৩০ জানুয়ারি ঢাকায় প্রতিবাদ দিবস পালিত হয়। ৩১ জানুয়ারি সর্বদলীয় কর্মী সমাবেশে 'সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কার্যকরী পরিষদ' গঠিত হয়। এ সভায় স্থির হয় ২১ ফেব্রুয়ারি প্রদেশব্যাপী রাষ্ট্রভাষা দিবস পালন করা হবে। রাষ্ট্রভাষা দিবস কর্মসূচি সফল করে তোলার জন্য ৪ ফেব্রুয়ারি 'হরতাল' এবং ১১ ও ১৩ ফেব্রুয়ারি 'পতাকা দিবস' পালিত হয়। কারাগারে আটক অবস্থায় ১৯৫২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি 'রাষ্ট্রভাষা বাংলা' ও 'বন্দীমুক্তির' দাবিতে শেখ মুজিবুর রহমান এবং আওয়ামী লীগ নেতা মহিউদ্দিন আহমদ আমরণ অনশন ধর্মঘট শুরু করেন।


সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহবানে সমগ্র পূর্ব বাংলায় ধর্মঘট, সভা, শোভাযাত্রা চলতে থাকে। নূরুল আমীনের মুসলিম লীগ সরকার ২০ ফেব্রুয়ারি বিকেল থেকে এক মাসের জন্য ঢাকা শহরে ১৪৪ ধারা জারি করে এবং সভা, সমাবেশ ও শোভাযাত্রা নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের আমতলায় এক ঐতিহাসিক সভায় বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে প্রাদেশিক পরিষদ ভবনে (বর্তমানে জগন্নাথ হল মিলনায়তন) গমনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ সালে ঢাকায় ছাত্র-জনতা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিল করলে মেডিকেল কলেজের হোস্টেলের সামনে লাঠি চার্জ, কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপের পর পুলিশ গুলি চালায়। পুলিশের গুলিতে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার ও পরে শফিউদ্দিন নিহত হন। এই বর্বর হত্যার প্রতিবাদে পূর্ব বাংলার ছাত্র, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, পেশাজীবীসহ সর্বস্তরের জনতা প্রচণ্ড বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে শহীদদের স্মৃতিকে অম্লান করে রাখার জন্য মেডিকেল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গণে রাতারাতি ছাত্রজনতা গড়ে তোলে শহীদ মিনার যা ২৪ ফেব্রুয়ারি উদ্বোধন করেন শহীদ শফিউদ্দিনের পিতা। ২১ ফেব্রুয়ারির বর্বর হত্যার প্রতিবাদে বিক্ষোভের প্রচণ্ডতার কাছে পরাজয় স্বীকার করে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার দাবিকে মেনে নেয়।


পরে ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের প্রথম সংবিধানে তা অন্তর্ভুক্ত করে। বাংলাদেশের জনগণের এই ভাষ্য জাগরণই 'ভাষা আন্দোলন' নামে পরিচিত।



ভাষা আন্দোলনের তাৎপর্য


ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়েই পূর্ব-বাংলার বাঙালি জনগোষ্ঠীর জাতীয় চেতনার সর্বপ্রথম বহিঃপ্রকাশ ঘটে। ভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব ও তাৎপর্য নিম্নরূপ:

  1. ভাষা আন্দোলন ছিল বাঙালির স্বাধিকার এবং জাতীয়তাবাদী চিন্তা-চেতনা উন্মেষের আন্দোলন। এ আন্দোলন বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির আন্দোলন হলেও ভাষার দাবি পূরণের জন্য রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তের প্রয়োজন ছিল। তাই এ আন্দোলন রাজনৈতিক রূপ পরিগ্রহ করে।
  2. ভাষা আন্দোলন বাঙালি জনগণের মধ্যে ভাষা ভিত্তিক বাঙালি জাতীয়তাবোধের উন্মেষ ঘটায়। এ আন্দোলনের মধ্য দিয়েই বাঙালিরা সর্বপ্রথম নিজেদের স্বতন্ত্র স্বত্তা, স্বতন্ত্র অধিকার সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠে। একমাত্র ধর্ম ছাড়া পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে বাঙালিদের অন্য কোন সম্পর্ক নেই তা বাঙালিরা প্রথমবারের মত উপলব্ধি করতে সক্ষম হন।
  3. ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাঙালি জনগণ নিজেদের অধিকার এবং ন্যায়সঙ্গত দাবি আদায়ে সচেতন হয়ে ওঠেন।
  4. ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাঙালি জনগণ উপলব্ধি করে যে, সংগ্রামের মাধ্যমেই তাদের দাবি-দাওয়া আদায় করতে হবে এবং মুক্তির পথ খুঁজে বের করতে হবে।
  5. ভাষা আন্দোলনে সৃষ্ট জাতীয়তাবাদী চিন্তা-চেতনা বাঙালি জনগণকে স্বতন্ত্র স্বার্থ, স্বতন্ত্র অস্তিত্ব এবং স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যগত দিক থেকে পশ্চিম পাকিস্তানিদের থেকে পৃথক করতে শেখায়।
  6. ভাষা আন্দোলনের পর থেকে ছাত্রসমাজের গুরুত্ব ও মর্যাদা বৃদ্ধি পায়। পূর্ব বাংলার ছাত্রসমাজ একটি প্রভাবশালী রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়।


১৯৯৯ সালে জাতিসংঘ ২১ ফেব্রুয়ারি 'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস' ঘোষণা করে। বাংলাভাষা আন্তর্জাতিক মর্যাদা লাভ করে। ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃত হয়।


বাঙালিদের অধিকারবোধ, স্বাতস্থ্যের সচেতনতা ও জাতীয় চেতনার ভিত্তিতে স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধিকারের পথ ধরে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় ভাষা আন্দোলন উদ্বুদ্ধ করে। ২১শের চেতনা থেকেই বাঙালি জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটে। এই জাতীয়তাবাদী চেতনা থেকেই উদ্ভব হয় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। সুতরাং আমাদের জাতীয় জীবনে ভাষা আন্দোলনের তাৎপর্য অসীম।



ভাষা আন্দোলন আমাদের জাতীয় চেতনার উন্মেষ ঘটায় এবং রাজনৈতিক আন্দোলনে রূপ লাভ করে। কেননা বাঙালি এই ভাষা আন্দোলনের পথ ধরেই বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার প্রেরণা পায়।

About the author

Irisha Tania
"আমি সেই মেয়ে, যে শব্দে বাঁচে। কলম আমার অস্ত্র, আর কাগজ আমার স্বপ্নের আকাশ। প্রতিটি অনুভব, প্রতিটি চিন্তা আমি সাজিয়ে রাখি অক্ষরের গাঁথুনিতে। কখনো গল্পে, কখনো কবিতায়, আবার কখনো নিঃশব্দের ভেতরে। আমি লিখি, কারণ লেখার মাঝে আমি নিজেকে খুঁজে পাই। …

Post a Comment

🌟 Attention, Valued Community Members! 🌟