লিগ অব নেশনস ও তার ব্যর্থতা সম্পর্কে আলোচনা কর
দুই মহাযুদ্ধের মধ্যবর্তী সময়কালে (১৯১৮-১৯৩৯) প্রতিষ্ঠা পায় জাতিপুঞ্জ তথা লীগ অব নেশনস। আজকের জাতিসংঘ যেমন বিশ্বের কোনো একটি স্থানে শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে নির্লজ্জভাবে ব্যর্থ তখনকার দিনে গড়ে ওঠা জাতিপুঞ্জও তেমনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মহারণ থেকে বিশ্বকে বাঁচাতে পারেনি। কার্যক্ষেত্রে এর কোনো গুরুত্ব থাক আর নাই থাক ঐতিহাসিক ঘটনা হিসেবে এর গুরুত্ব উড়িয়ে দেয়ার মত নয়। বলতে গেলে এর প্রতিষ্ঠাতা ও সদস্যদের সিংহভাগ ইউরোপীয় হওয়ায় অন্য দেশের সেখানে সহজে যুক্ত হওয়ার সুযোগ ছিল না। তবে শেষ পর্যন্ত ইউরোপেরই বিভিন্ন দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্বে ভেঙে যায় লীগ অব নেশনস। এক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশের ঔপনিবেশিক স্বার্থ ও দ্বন্দ্ব অনেক বড় হয়ে উঠতে দেখা গেলে শেষ পর্যন্ত ভেঙে যায় এই জাতিপুঞ্জ তথা লীগ অব নেশনস। লীগ অব নেশনসের ব্যর্থতার কারণগুলো হচ্ছে-
আপনি চাইলে এগুলো পড়তে পারেন
- ভার্সাই চুক্তিঃফ্রান্সের জাতিগত জিঘাংসা চরিতার্থ করার জন্য জার্মানির ওপর অনেকগুলো শর্ত আরোপ করে সম্পাদিত হয় ভার্সাই চুক্তি। অসম ও অনৈতিক এই চুক্তি লীগ অব নেশনস তথা জাতিপুঞ্জের ভেঙে পড়ার অন্যতম কারণ।
- অলীক আন্তর্জাতিকতাঃ একটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেও সেখানে চারটি বৃহৎ রাষ্ট্রের বাইরে অন্যদের কথা বলার কোনো সুযোগ ছিল না বললেই চলে। বলতে গেলে এই অবস্থানগত অসঙ্গতিও লীগ অব নেশনসের ভেঙে পড়ার মূল কারণ।
- দ্বিমুখী নীতিঃ বিশ্বের নানা স্থানে নিষ্পেষণকারী উপনিবেশিক দেশগুলো যখন শান্তির কথা প্রচার করেছিল তা শুরু থেকেই গণমানুষের আস্থা হারায়। তাই প্রথম দিক থেকেই রাষ্ট্রনেতাদের অংশগ্রহণে নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠান হিসেবে এ সংগঠন যতটুকু টিকে ছিল তাও ভেঙে পড়ে।
- সহযোগিতার অভাবঃ নামমাত্র লীগ অব নেশনস প্রতিষ্ঠা পেলেও মিত্র শক্তির বিজয়ী দেশগুলোর মধ্যে একধরনের থমথমে পরিবেশ বিরাজ করে। তারা নামমাত্র একে অন্যের সাথে সংযুক্ত থাকার কথা বললেও সহযোগিতামূলক মনোবৃত্তির ঘাটতি ছিল চোখে পড়ার মত।
- আঞ্চলিকতা ও অখণ্ডতাঃ লীগ অব নেশনস বিভিন্ন জাতির অখণ্ডতা বজায় রাখতে কাজ করার কথা। কিন্তু ভার্সাই চুক্তির মাধ্যমে জার্মানিকে যেভাবে খণ্ড-বিখণ্ড করা হয় লীগ অব নেশনস সেক্ষেত্রে নীরব দর্শকের ভূমিকায় থেকে নিজের অবস্থান প্রশ্নবিদ্ধ করে।
- রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তাঃ জাতিপুঞ্জ বিভিন্ন দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্পর্কিত তথ্যাদি নিয়ে কাজ করার কথা ছিল। কিন্তু জার্মানির ওপর অবৈধ অবরোধকে নির্লজ্জের মত সমর্থন দিয়ে গেছে এ প্রতিষ্ঠানটিই। এক্ষেত্রের ব্যর্থতাও লীগ অব নেশনস এর পতনকে ত্বরান্বিত করেছিল।
- চীন জাপান দ্বন্দ্বঃ চীন ও জাপানের দীর্ঘদিন থেকে চলে আসা দ্বন্দ্ব নিরসনেও পুরোপুরি ব্যর্থ হয় এই সংগঠনটি। ফলে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বিরোধিতা করতে থাকা দেশগুলোর অন্যতম হিসেবে চীন ও জাপান যে দীর্ঘ লড়াইয়ে লিপ্ত হয়েছিল তা থেকে মুক্ত করতে পারেনি এই লীগ অব নেশনস তথা জাতিপুঞ্জ। তাই শেষ পর্যন্ত এর ভেঙে পড়াটা হয়ে যায় সময়ের ব্যাপার।
- ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের শক্তিমত্তাঃ ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের অহেতুক শক্তিবৃদ্ধি বিশ্বের অন্য দেশের শান্তির জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। বিশেষ করে তারা ক্রমবর্ধমান শক্তি কাজে লাগিয়ে বিশ্বের নানা স্থানে তাদের উপনিবেশ বিস্তৃতির চেষ্টা চালালে সেখানে নীরব ভূমিকা পালন করে লীগ অব নেশনস। এতে সংস্থাটির ওপর থেকে আস্থা উঠে যায় অন্য দেশগুলোর।
- হিটলারের ও মুসোলিনির আতপ্রকাশঃ একনায়ক হিসেবে জার্মানির নেতা অ্যাডলফ হিটলার ও ইতালিতে বেনিতো মুসোলিনির আত্মপ্রকাশ লীগ অব নেশনসকে শুরুতেই অগ্রাহ্য করে। বিশেষ করে হিটলার ভার্সাই চুক্তির শর্তগুলো এক এক করে বদলের শপথ নিয়ে অনেকটা বন্ধ করে দেন জাতিপুঞ্জের কার্যক্রমকে।
- মহামন্দাঃ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতির পরোক্ষ কারণ হিসেবে মহামন্দা দেখা দেয়। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে তেমন কার্যকর পদ্ধতি গ্রহণ করতে না পারায় সংস্থা হিসেবে উপযোগিতা হারায় এ জাতিপুঞ্জ। বলতে গেলে সবাই তখন থেকেই একে ফ্রান্স-ব্রিটিশ অনুগত ও আজ্ঞাবহ একটি অকর্মণ্য প্রতিষ্ঠান হিসেবে চিহ্নিত করে।
- ইউরোপকেন্দ্রিকতাঃ জাতিপুঞ্জ ভেঙে পড়ার অন্যতম কারণ এর ইউরোপকেন্দ্রিকতা। এখানে ইউরোপীয়রা সংগঠন প্রতিষ্ঠা করে নিজেদের জন্য সুবিধাজনক নানা শর্ত যুক্ত করে দেয়। আর সেগুলো বিশ্বের অন্যদেশের মনঃপুত না হওয়াতে তারা এর বিরোধিতা করে।
- সাংবিধানিক দুর্বলতাঃ ইউরোপের শক্তিশালী দেশ হিসেবে ইংরেজ ও ফরাসিদের নানা স্বার্থ পূরণ করতে গিয়ে সাংবিধানিকভাবে দুর্বল একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয় জাতিপুঞ্জ। এ দুর্বলতা এর ভেঙে পড়ার অন্যতম কারণ।
ফ্রাঞ্জ ফার্দিনান্দের হত্যাকাণ্ড থেকে শুরু করে ইংরেজ গোলন্দাজ বেন ক্লাইটিং-এর প্রথম গুলি আর সবশেষে ভার্সাই চুক্তি পর্যন্ত চার বছর ধরে চলে মহাযুদ্ধে। যুদ্ধের শেষ দিকে মিত্রবাহিনীর ওপর মরণকামড় দিতে জার্মানরা স্প্রিং অফেলিভ শুরু করলে তার পাল্টা জবাব আসে হান্ড্রেড ডেজ অফেন্সিতে। জানমালের বিপুল ক্ষয়ক্ষতি, নানা আবেগ-উৎকণ্ঠা আর ধ্বংসযজ্ঞ শেষ পর্যন্ত মিত্রবাহিনীর বিজয় নিয়ে আসে। সবমিলিয়ে বিশ্ব ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাপ্রবাহ হিসেবে উল্লেখ করা হয় এই বিশ্বযুদ্ধের দিনগুলোকে। বস্তুত এতবড় সংঘাত ও যুদ্ধের প্রথম অভিজ্ঞতা পায় মানবজাতি।