১৯০০ - এর দশকে নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু এবং জাতীয় কংগ্রেসের সাথে সম্পর্ক মূল্যায়ন করো।
পরাধীন ভারতবর্ষের মুক্তি সংগ্রামে যে সমস্ত দেশপ্রেমিক সংগ্রাম করে গেছেন তাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে প্রতিষ্ঠিত হলেন নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু।আজীবন সংগ্রামী সুভাষচন্দ্র কেবল ভারতেই নয়, সমগ্র পৃথিবীর ইতিহাসে একজন শ্রেষ্ঠ দেশ-প্রেমিকের আসন লাভ করে আছেন। ভারতের স্বাধীনতার জন্য সুভাষচন্দ্র নিজেকে সম্পূর্নভাবে উৎসর্গ করেন।
আপনি চাইলে এগুলো পড়তে পারেন
সুভাষচন্দ্র ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র। ছাত্রাবস্থাতেই তিনি তীব্র দেশাত্মবোধের জন্য অসহ্য যন্ত্রনা ও অত্যাচার ভোগ করেন। তিনি কৃতিত্বের সাথে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা পাশ করেও ইংরেজ অধীনে চাকুরীর মোহ ত্যাগ করেন। তিনি স্বামী বিবেকানন্দের জীবনী ও বাণী দ্বারা প্রভাবিত হয়ে দেশমাতার জন্য মুক্তির জন্য গান্ধীজী পরিচালিত অহিংস অসহযোগ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। এ সময় থেকেই সুভাষচন্দ্র আজীবনকাল ভারতের মুক্তি সংগ্রামে নিজেকে নিয়োজিত করেন।
১৯২ ১সালে সুভাষচন্দ্র ভারতের রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। তিনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় লক্ষ্য করেন এই যুদ্ধে যোগদান করে পোল্যান্ড, চেকোশ্লাভাকিয়া, আয়ারল্যান্ড প্রভৃতি দেশগুলি নিজেদের উদ্দেশ্যগুলিকে সিদ্ধ করেছে। তিনিও দেশ-মাতার মুক্তির জন্য চেষ্টা করেন। সে সময় অন্য কোনো পথ খুঁজে না পেয়ে তিনি গান্ধীজীর নেতৃত্বাধীন কংগ্রেসে যোগদান করে রাজনীতিতে প্রবেশ করেন।
কংগ্রেসের মধ্যে থেকেই সুভাষচন্দ্র বহু যত্নে যুব-সমাজকে গড়ে তোলেন। তিনি দেশের অভ্যন্তরের সকল প্রকার মুক্তিকামী শক্তিকে একত্রিত করে একটি ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলার দাবী করেন। কিছু গান্ধীজী তাঁর অহিংস তত্ত্বে অবিচল থাকায় সুভাষের পক্ষে তাঁর পরিকল্পনা কার্যকর করা সম্ভব হয় নি। অবশেষে সুভাষচন্দ্র বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটির তীপতি নির্বাচিত হওয়ার সাথে সাথে তাঁর নেতৃত্বে কংগ্রেসের বামপন্থী প্রভাব বিস্তার করে। তাঁর চেষ্টায় লাহোর কংগ্রেসে পূর্ণ স্বাধীনতার দাবী ঘোষনা হয়।
গান্ধীজীর আইন অমান্য আন্দোলন ব্যর্থ হওয়ার পর সুভাষচন্দ্রের মনে সশস্ত্র বিপ্লব উকি দিতে থাকে। তিনি ইংরেজদের সাথে আপোস-মীমাংসার পথ ছেড়ে দেশের যুব সমাজকে প্রত্যক্ষ সংগ্রামের পথ গ্রহনের জন্য আহবান জানান। সুভাষের জনপ্রিয়তা ক্রমশ বৃদ্ধি পায় এবং তিনি ১৯৩৮ সালে হরিপুরা কংগ্রেসে সভাপতি নির্বাচিত হন। এখানে তাঁর বক্তৃতায় শোনা যায় সক্রিয় সংগ্রামে দেশবাসীর প্রতি আহবান ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধীতা।
হরিপুরা কংগ্রেসে গান্ধীবাদী নেতাগন সুভাষচন্দ্রকে সভাপতি পদ থেকে অপসারণের চেষ্টা চালায়। এজন্য ত্রিপুরী কংগ্রেসে গান্ধীজী নিজে সভাপতি পদের জন্য পট্রভি সীতা রামাইয়াকে সমর্থন করেন। ত্রিপুরী কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচনে সুভাষচন্দ্র গান্ধীজী মনোনীত প্রার্থী সীতা রামাইয়াকে বিপুল ভোটে পরাজিত করে সভাপতি নির্বাচিত হন। গান্ধীজী এতে ক্ষোভের সাথে বলেন 'সীতা রামাইয়ার পরাজয় আমারই পরাজয়।' সুভাষচন্দ্রের সভাপতি পদ ত্যাগ ও ফরওয়ার্ড বুক গঠনঃ কলকাতা নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির অধিবেশনে এক অসহনীয় পরিবেশে সুভাষচন্দ্র কংগ্রেস সভাপতির পদ ত্যাগ করেন। এসময় সুভাষচন্দ্র কংগ্রেসের ভিতরের প্রগতিশীল শক্তিগুলিকে সংঘাবদ্ধ করার জন্য ফরওয়ার্ড ব্লক নামে একটি নতুন সংগঠন গড়ে তোলেন।
ইতিমধ্যে ১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে সুভাষচন্দ্র বিদেশী শক্তির সাহায্যে সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে ভারতের স্বাধীনতা ছিনিয়ে নেবার কথা চিন্তা করেন। ব্রিটিশ সরকার ১৯৪০ সালে বিনা বিচারে সুভাষচন্দ্রকে কারাগারে বন্দী করেন। এরপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে সুভাষকে কলকাতার এলগিন রোডে তাঁর নিজের বাড়ীতে নজরবন্দী করে রাখেন। এসময় পুলিশের চোষে ধুলো দিয়ে সুভাষ ছদ্মবেশে বিদেশের পথে পাড়ি দেন। জার্মানীর হাতে বন্দী ভারতী সৈন্যদের নিয়ে তিনি স্বাধীন ভারতের সামরিক বাহিনী গঠনের সংকল্প গ্রহন করেন। এজন্য তিনি জার্মান, রোম, প্যারিসে স্বাধীন ভারতের বেতার কেন্দ্র স্থাপন করেন।
ইতিমধ্যে জাপানে ব্রিটিশ শক্তিকে পরা করায় জাপানের সাহায্য লাভের আসায় সুভাষ নিজের জীবন তুচ্ছ করে ডুবো জাহা চড়ে হাজার মাইল পথে সমুদ্রে পাড়ি দিয়ে জাপানে পৌঁছান। সেখানে তিনি রাসবিহারী। জামা নেতৃত্বে গঠিত আজাদ-হিন্দ ফৌজের সর্বাধী নায়কের পদ গ্রহন করেন এর জাপানের হাতে বন্দী প্রায় পঞ্চাশ হাজার ভারতীয় সেনা নিয়ে সিঙ্গাপুরে আজাদহিন বাহিনী গঠন করেন। নেতৃত্ব পদ গ্রহন করে সুভাষচন্দ্র নেতাজী নামে পরিচিত হন।
জাপানে টোকিও বেতার থেকে সুভাষ ঘোষনা বান সশস্ত্র ভারতীয় বাহিনী নিয়ে ইংরেজদের সাথে যুদ্ধ করবেন। অবশেষে ১৯৪৩ আজাদহিন্দ সরকারের পক্ষ থেকে সুভাষ রাত্রি ১২টা ৫মিনিটে আনুষ্ঠানিক ভাবে ব্রিটেন ও আমেরিকার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন আজাদ হিন্দ বাহিনী 'দিল্লি চলো' শুনিতে আকাশ বাতাস মুখরিত করে পবিত্র ভারতভূমির দিকে অগ্রসর হয়। জাতীয় এক সমাবেশে সুভাষের কণ্ঠে শোনা যায়, 'তোমরা আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেব'। এই আজাদহিন্দ বাহিনী বীরবিক্রমে যুদ্ধ করে ভারতের মাটিতে স্বাধীন ভারতের পতাকা উত্তোলন করেন।
শেষ পর্যন্ত যুদ্ধে জাপান পরাজিত হয়ে আত্ম-সমর্পন করলে আজাদহিন্দ বাহিনীকেও আত্ম সমর্পন করতে হয়। এতে সুভাষের পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়। কিন্তু তিনি নিখোঁজ হয়ে যান। ১৯৪৫ সালে মাঞ্চুরিয়া অভিমুখে যাত্রার সময় এক বিমান দুর্ঘটনায় তাইহোকু বিমানবন্দরে সুভাষের মৃত্যু হয়েছে বলে জাপানী বেতারে ঘোষনা হয়। নেতাজীর মৃত্যু আজও আমাদের কাছে রহস্যময়।
ভারতের মুক্তিতে নেতাজীর স্বপ্ন স্বার্থক না হলেও তিনি যে দেশপ্রেম ও বীরত্বের পরিচয় দিয়েছিলেন তা ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে চিরদিন স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নেতাজী জাপানের সাহায্য গ্রহন করলেও তিনি কখনোই জাপানের ক্রীড়নকে পরিণত হন নি। সুভাষের দেশপ্রেমের গভীরতা সম্পর্কে গান্ধীজীও প্রশংসা করেছেন।