বাংলায় নমঃশূদ্র আন্দোলন সম্পর্কে সংক্ষেপে লেখো।
বাংলায় দলিত আন্দোলনের মধ্যে অন্যতম প্রধান ছিল নমঃশূদ্র আন্দোলন। উনিশ শতকে বাংলায় সর্বাধিক পিছিয়ে পড়া নিম্নবর্গের হিন্দু তথা নমঃশূদ্র বা চন্ডালরা নিজেদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অধিকার আদায়ের জন্য আন্দোলন গড়ে তোলে। বাংলার দলিত জাতিগুলির মধ্যে নমঃশূদ্ররা ছিলেন সবচেয়ে বেশী ঐক্যবদ্ধ ও উচ্চাকাঙ্ক্ষী। নমঃশূদ্রেরা তাদের ধর্মগুরু শ্রী হরিচাঁদ ঠাকুর ও শ্রী গুরুচাঁদ ঠাকুরের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হয়ে সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অধিকার আদায়ের জন্য আন্দোলন করে। পূর্ব বাংলার খুলনা, ফরিদপুর, বরিশাল, যশোহর প্রভৃতি অঞ্চলে এই আন্দোলন ব্যাপক আকার ধারণ করে। ইহাই নমঃশূদ্র আন্দোলন নামে পরিচিত।
নমঃশূদ্র আন্দোলনের সূচনা হয় ১৮৭২ সালে বাংলার ফরিদপুর জেলার বাখরগঞ্জ অঞ্চলে। এক বিশিষ্ট নমঃশূদ্র নেতার মায়ের শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে উঁচু জাতের লোকেরা আসতে অস্বীকার করে। এই ঘটনায় ক্ষুব্ধ হয়ে নমঃশূদ্ররা উঁচু জাতের লোকের বাড়িতে কাজ করতে অস্বীকার করে। এই ঘটনাই নমঃশূদ্রদের ঐক্যবদ্ধ হতে সাহায্য করে এবং আন্দোলনের সূচনা হয়।
বাংলার নমঃশূদ্ররা বিভিন্ন কারণে সংঘবদ্ধ হয়ে আন্দোলন করেছিল। ১৯১৬ সালে ঢাকায় এবং ১৯১৭ সালে কলকাতায় নমঃশূদ্রদের সম্মেলনে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলা হয় যে, নমঃশূদ্ররা হল অধিকাংশই দরিদ্র কৃষক ও শ্রমজীবী। এরা উচ্চ বর্ণের ভূস্বামীদের দ্বারা অত্যাচারিত হচ্ছে। শ্রী হরিচাঁদ ও শ্রী গুরুচাঁদ ঠাকুরের ধর্মীয় নেতৃত্ব নমঃশূদ্রদের ঐক্যবদ্ধ হতে বিশেষভাবে সহায়তা করে।
হরিচাঁদ ঠাকুর প্রতিষ্ঠিত মতুয়া ধর্ম-সম্প্রদায়কে কেন্দ্র করেই নমঃশূদ্রদের সামাজিক আন্দোলন শুরু হয়। তাদের আন্দোলনের প্রধান কেন্দ্র ছিল ফরিদপুর জেলার ওড়াকান্দি গ্রাম। নমঃশূদ্ররা এই আন্দোলন ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য ১৯০২ সালে একটি সমিতি গঠন করে এবং নিয়মিত উন্নয়নী সভার আয়োজন করে। এছাড়া যাত্রানুষ্ঠান ও প্রতি পরিবার থেকে মুষ্ঠি সংগ্রহের মাধ্যমেও আন্দোলনের বিস্তার ঘটে।
নমঃশূদ্ররা ১৯১২ সালে বেঙ্গল নমঃশূদ্র আঅ্যাসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠা করে পুরোপুরি সংগঠিত হয়ে অন্দোলন পরিচালনা করে। নমঃশূদ্ররা তাদের নমঃশূদ্ররা নামের আনুষ্ঠানিক অনুমোদন দাবি করেছিল। ১৯১১ সালের আদমসুমারিতে তাদের নমঃশূদ্র নামকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। নমঃশূদ্ররা তাদের অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য শিক্ষা ও চাকরির ক্ষেত্রে কিছু সুযোগ-সুবিধার দাবি করে এবং ক্ষেত্রে তারা সেই দাবি আদায় করতে সক্ষম হয়। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নমঃশূদ্রদের দাবি ছিল পৃথক নির্বাচন ও স্বায়ত্তশাসনমূলক প্রতিষ্ঠানে প্রতিনিধির সংখ্যা বৃদ্ধি। ব্রিটিশ সরকার এক্ষেত্রেও নমঃশূদ্রদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিল। এজন্য নমঃশূদ্ররাও ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেনি।
নমঃশূদ্রদের ঐক্যবদ্ধ করার ক্ষেত্রে ও রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে সচেতন করার ক্ষেত্রে বেশ কয়েকজন বাক্তি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেন। এঁদের মধ্যে শ্রী হরিচাঁদ ঠাকুর, শ্রী গুরুপদ ঠাকুর, রাজেন্দ্রনাথ মন্ডল, মুকুন্দবিহারী মল্লিক, যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল, প্রমথরঞ্জন ঠাকুর প্রমুখের ভূমিকা বিশেষ উল্লেখযোগ্য।
শ্রী হরিচাঁদ ঠাকুর মতুয়া নামে একটি সংগঠন গড়ে তুলে নমঃশূদ্রদের মধ্যে আত্মত্মশক্তি ও আত্মমর্যাদা বোধের বিকাশে প্রথম উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তাঁর পুত্র শ্রী গুরুচাঁদ ঠাকুরের সময় নমঃশূদ্রদের মধ্যে শিক্ষার প্রসার ঘটে। তিনি ১৯০৭ সালে বাংলা ও আসাম সরকারের কাছে নমঃশূদ্রদের চাকরিতে নিয়োগের দাবি পেশ করেন। নমঃশূদ্র ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন নিখিলবঙ্গ নমঃশূদ্র সম্মেলন -এর মাধ্যমে নমঃশূদ্রদের বিভিন্ন দাবি-দাওয়ার কথা তুলে ধরেন। তাঁর দাবির ভিত্তিতে ব্রিটিশ সরকার ১৯১১ সালের আদমসুমারি রিপোর্টে চন্ডাল নাম পরিবর্তন করে এই সম্প্রদায়কে নমঃশূদ্র নামে অভিহিত করে।
১৯০৫ সালে রাজেন্দ্রনাথ মন্ডলের নেতৃত্বে নমঃশূদ্ররা ভাইসরয় লর্ড কার্জনের বঙ্গভঙ্গকেই সমর্থন জানায়। তাদের মনে হয়েছিল যে, দুই বঙ্গ আলাদা হলে উচ্চবর্ণের হিন্দুদের শোষণ, অত্যাচার ও বঞ্চনার হাত থেকে পূর্ববঙ্গের নমঃশূদ্ররা নিষ্কৃতি পাবে। সামাজিক মর্যাদা আদায় ও আর্থিক শোষণ থেরে মুক্তির লাভের জন্য নমঃশূদ্ররা জমিদার, ব্রিটিশ সরকার ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে ১৯০৯ খ্রিঃ, ১৯১১ খ্রিঃ, ১৯২৫ খ্রিঃ এবং ১৯৩৮ খ্রিঃ আন্দোলন গড়ে তোলে।
রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্বের দাবিং দলিত শ্রেণির রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্বের দকি ভিত্তিতে ১৯০৯ সালে মন্টেও-চেমসফোর্ড সংস্কার আইনের দ্বারা বঙ্গীয় প্রাদেশিক আইনসভায় একজন নমঃশূদ্র প্রতিনিধি পাঠানোর সুযোগ লাভ করে।
সম্ভাব্য প্রশ্নগুলিঃ
- বাংলায় নমঃশূদ্র আন্দোলনের উদ্ভব ও বিকাশ ব্যাখ্যা কর
- ঔপনিবেশিক শাসনকালে বাংলায় নমঃশূদ্র আন্দোলনের পরিচয় দাও।
- নমঃশূদ্র নামে কারা পরিচিত ছিল
- বাংলায় নমঃশূদ্র আন্দোলনের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দাও
- বাংলায় নমঃশূদ্র আন্দোলন pdf