জাপানের সোগুনতন্ত্র সম্পর্কে আলোচনা করো।
প্রায় দীর্ঘ দুই শতক পর্যন্ত বাইরের জগৎ থেকে নিজেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে রাখার ফলে জাপান বহির্বিশ্বের কোনো রাজনৈতিক পরিবর্তনের দ্বারা বিন্দুমাত্র প্রভাবিত হয়নি। বিদেশী কোনো রাষ্ট্রের সাথে কোনো প্রকার যোগাযোগ না থাকায় জাপান কোনো বাইরের দেশের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়নি। অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রেও দীর্ঘ কয়েক শতকের মধ্যে জাপানে কোনো বিশেষ পরিবর্তন দেখা দেয়নি। অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ক্ষেত্রে দীর্ঘদিন যাবৎ শাস্তি অব্যাহত থাকার ফলে সোগানদের শাসনতন্ত্রে শৈথিলা দেখা দিতে শুরু করে এবং দেশের উপর তাদের রাজনৈতিক প্রভাব ধীরে ধীরে হ্রাস পেতে থাকে।
টোকুগাওয়া সোগানগণ প্রথম যখন রাজনৈতিক ক্ষমতা অধিকার করে তখন একটি শক্তিশালী শাসনযন্ত্র নির্মাণ করা তাদের প্রয়োজন ছিল। প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় সোগানের চেষ্টায় এই শাসনতন্ত্র গড়ে ওঠে এবং খুব সাফল্যের সাথে দেশের শান্তি, শৃঙ্খলা ও সমৃদ্ধি আনয়ন করতে সমর্থ হয়। কিন্তু পরবর্তীকালে এই শাসনযন্ত্র অব্যাহত থাকলেও তার কার্যকারিতা হ্রাস পায়।
বিদেশীদের সাথে সম্পূর্ণ সম্পর্কহীন জাপানে অভ্যন্তরীণ শান্তি-শৃঙ্খলা স্থাপিত এবং বিভিন্ন গোষ্ঠীর অন্তর্বন্দ্বের অবসান হযার পর সোগান নিশ্চিন্ত মনে রাজপ্রাসাদের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ও বিলাসের প্রতি মাত্রাতিরিক্ত দৃষ্টি দিতে শুরু করেন। সামরিক শক্তি অব্যাহত রাখা অথবা তার উন্নতির দিকেও দুষ্টি দেওয়ার কোনো প্রয়োজন সোগান মনে করেনি। নিয়মিত সেনাবাহিনী গঠনের পরিবর্তে সেখান সনাতন প্রথা অনুসরণ করে ডাইম্যে নামে পরিচিত ভূস্বামীদের উপর সামরিক সহয্যের জন্য নির্ভরশীল হয়ে থাকাই বেশি পছন্দ করতেন।
বিভিন্ন সামন্ডগোষ্ঠীর টকুগাওয়া সোগানদের বিরুদ্ধে অপ্রকাশ্য ও প্রকাশা প্রান্তোষ বৃদ্ধি পাওয়ার সাথে সাথে সোগানদের নির্দেশ প্রভৃতি তারা অমান্য করপ্রেকাশ্য হর। প্রথম দিকে শক্তিশালী উকুগাওয়া সোগানদের আমলে তারা গুরুকরতে শুরু পড়েছিল। কিন্তু সেগাগানদের দুর্বলতা বৃদ্ধির সাথে সাথে তাদের গুরুত্ব দ্রুত হারে বৃদ্ধি একা পেতে থাকে এবার। তারা প্রায় স্বাধীনভাবেই তাদের অধীনস্থ অঞ্চলে শাসনকার্য যারে বৃদ্ধি করতে শুরু করে। ১৮-৫৩ খ্রিঃ মধ্যে সোগানদের ক্ষমতা এতটাই হ্রাস পায় যে তাদের। বিরুদ্ধে অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ দেখা দেওয়া এবং সেই বিদ্রোহে সাফল্য অর্জন করা কোনক্রমেই অস্বাভাবিক ছিল না।
প্রকৃতপক্ষে সোগানদের চেষ্টায় এই বিদ্রোহের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়। পরিবর্তে সোগানগণ দুর্ধর্ষ সামুরাইদের শক্তি ও উৎসাহ, একা ও সংস্কৃতির দিকে পরিচালিত করতে চেষ্টা করেন। শিক্ষাব্যবস্থার পুনঃপ্রতিষ্ঠার জলে শিক্ষার্থীগণ চীন ও জাপানের প্রাচীন সাহিত্য ও ইতিহাসের দিকে বিশেষভাবে আকৃষ্ট হয় এবং জাপানের সভ্যতা ও সংস্কৃতির উপর চীনের প্রভাবের গভীরতা সম্পর্কেও তারা বিশেষভাবে অবগত হবার সুযোগ লাভ করে। জাপানের প্রাচীন সংস্কৃতির প্রতি আকর্ষণ বৃদ্ধির ফলে পুরাতন সিস্টো ধর্মেরও পুনর্জাগরণ ঘটে। সিন্টো ধর্মের নীতি অনুসারে সম্রাটই ধর্ম জগতের প্রধান। সুতরাং সিস্টো ধর্মের পুনরুত্থানের সাথে সাথে সম্রাটের মর্যাদ্য যথেষ্ট পরিমাণে বৃদ্ধি পায়।
প্রকৃতপক্ষে শিক্ষাব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তনের ফলে জাপানে দুটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন দেখা দেয়। প্রথমতঃ শিক্ষার ফলে জাপানে জাতীয়তাবাদের সূচনা ঘটে। দ্বিতীয়তঃ 'ঈশ্বরের প্রত্যক্ষ সন্তান' সম্রাটের প্রতি তাদের আনুগত্যের সৃষ্টি হয়। অপরদিকে জাতীয়তাবাদী আদর্শ সম্রাটের প্রতি আনুগত্য থেকে জাপানে সাম্রাজ্যবাদী চিন্তাধারার সূত্রপাত ঘটে। সোগানদের আমলে প্রবর্তিত জাপানের অভ্যন্তরে ভ্রমণের জন্যও ছাড়পত্র গ্রহণের নীতির বিরুদ্ধেও জনসাধারণের মনে অসন্তোষ দেখা দেয়। নিজেদের ক্ষমতাকে অক্ষুন্ন রাখার জন্যই সোগানগণ ছাড়পত্র বাবস্থার প্রবর্তন ও স্বাধীনভাবে ভ্রমণের ওপর বাধানিষেধ আরোপ করেছিলেন। কিন্তু নতুন জাতীয়তাবাদী চিন্তায় উদ্বুদ্ধ তরুণ জাপানীরা সমগ্রদেশ সম্বন্ধে সম্যক জ্ঞান অর্জনের পূর্ণ সুযোগ পাওয়ার জন্যই সোগানদের এই সংকীর্ণ নীতির বিরুদ্ধে তীব্র সমালোচনা শুরু করে।
সোগানগণ বাইরের জগৎ থেকে জাপানকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে রাখার নীতি গ্রহণ করেন। একমাত্র দেশিমা বন্দরে বসবাসকারী ওলন্দাজ বণিকদের সাথে তাদের সামানা যোগাযোগ ছিল। তবে ওলন্দাজ বণিকগণ সাধারণতঃ চার বছর পরে একবার করে সোগানদের রাজধানী ইয়েদো শহরে আসার সুযোগ পেত। যদিও পরে প্রতি বছরই তারা দেশিমাতে আসার অনুমতি পায়। তবে রাজসভার দোভাষীর মাধ্যমে অতি সামান্য সংবাদই তারা ওলন্দাজদের কাছ থেকে সংগ্রহ করতে পারত। বিশেষতঃ বিদেশীদের আগমণের সাথে সাথে জাপানের শিক্ষিত সম্প্রদায়ের বাইরের জগৎ সম্পর্কে আগ্রহ দ্রুত বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। সুতরাং বিদেশীদের সম্পর্কে টোকুগাওয়া সোগানদের অনুসৃত নীতি তাদের পক্ষে বেশি দিন সহ্য করা সম্ভব ছিল না।
কমোডোর পেরীর জাপানে আগমনের পূর্বেই জাপানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে এক বিরাট পরিবর্তন দেখা দিতে শুরু করে। পুরানো দিনের সকল সংস্থাই তখন অব্যাহত ছিল। কিন্তু প্রত্যেকটি সংস্থাই এত দুর্বল ছিল যে কোনো মুহূর্তে তাদের পতন অস্বাভাবিক ছিল না। কিয়োতোর সম্রাট, ইয়েদোর সোগান, পশ্চিমাঞ্চলের শক্তিশালী সামন্তগোষ্ঠী, ক্ষমতাবান ডাইমো সম্প্রদায়, যুদ্ধপ্রিয় সামুরাই শ্রেণী প্রত্যেকেই একটি পরিবর্তনের জন্য অপেক্ষা করছিল। কিন্তু চিরাচরিত প্রথার উপর আঘাত করার সাহস কোনো পক্ষেরই হয়নি। সুতরাং অতি সহজেই কমোডোর পেরী জাপানের সাথে চুক্তি সম্পাদন করে বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত করার সুযোগ লাভ করেন।