কোরিয়া যুদ্ধের প্রকৃতি সম্পর্কে আলোচনা করো।
১৯১০খ্রিঃ থেকে কোরিয়ার ওপর জাপান প্রভুত্ব করত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চিন, ইংল্যান্ড, রাশিয়া প্রভৃতি রাষ্ট্র কোরিয়াকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্ররূপে গঠন করতে চিন্তাভাবনা শুরু করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের পরাজয়ের পর কোরিয়ার উত্তরাংশে অর্থাৎ ৩৮ডিগ্রী অক্ষরেখার উত্তর ভাগে সোভিয়েত হহিনীর এবং দক্ষিণাংশে অর্থাৎ ৩৮ ডিগ্রী অক্ষরেখার দক্ষিণ ভাগে মার্কিন বাহিনীর কর্তৃত্ব সু-প্রতিষ্ঠিত হয়। এরপর এই দুই শক্তি সমগ্র কোরিয়ায় তাদের প্রাধানা স্থাপনের জন্য সচেষ্ট হল। এভাবে কোরিয়ার ভাগ্য ঠান্ডা লড়াইয়ের আবর্তে জড়িয়ে পড়ল।
১৯৪৫ সালে আমেরিকা ও রাশিয়ার মধ্যে মস্কোয় এক বৈৗকের মাধামে একটি যৌথ কমিশন গঠনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এই কমিশন কোরিয়ায় একটি অস্থায়ী সরকার গঠনের চেষ্টা করবে। কিন্তু এই চেষ্টা ব্যর্থ হয়। ফলে ১৯৪৭ সালে আমেরিকা সমস্যাটি জাতিপুঞ্জের সাধারণ সভায় উত্থাপন করে। জাতিপুঞ্জ সমস্যা সমাধানে ভারতীয় কূটনীতিবিদ মেনন -এর সভাপতিত্বে নয়জন সদস্য বিশিষ্ট একটি অস্থায়ী কমিশন গঠন করে। কোরিয়ায় শান্তিপূর্ণ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে একটি জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠা ও কোরিয়া থেকে বিদেশী সেনা প্রত্যাহারের দায়িত্ব এই কমিশনের হাতে দেওয়া হয়।
সোভিয়েত রাশিয়া নিয়ন্ত্রিত উত্তর-কোরিয়ায় এই কমিশনকে কোনো কাজ করতে দেওয়া হয় নি। এরপর ১৯৪৮-সালে জাতিপুঞ্জের তত্ত্বাবধানে দক্ষিণ-কোরিয়ায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনের পরিপ্রেক্ষিতে দক্ষিণ- কোরিয়ায় মার্কিন আজ্ঞাবাহক একটি সরকার গঠিত হয়, যার নেতৃত্বে ছিলেন সিংম্যান বী। সিগুল হয় এই সরকারের রাজধানী। জাতিপুঞ্জ এই সরকারকে সমগ্র কোরিয়ার একমাত্র বৈধ সরকার বলে ঘোষনা করে। এইসাথে আরো বত্রিশটি রাষ্ট্র এই সরকারকে স্বীকৃতি দেয়। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র এই সরকাকে নানা ভাবে সাহায্য করতে থাকে। এভাবে দক্ষিণ-কোরিয়া একটি মার্কিন ঘাঁটিতে পরিণত হতে থাকে।
একই সময়ে উত্তর-কোরিয়ার কমিউনিস্ট নেতা কিম-উল-সুর-এর নেতৃত্বে সেখানে একটি সোভিয়েত অনুগামী কমিউনিস্ট সরকার গঠিত হয়। জনগণতান্ত্রিক কোরিয়া নামে এই সরকারের রাজধানী হয় পানগুনজম সোভিয়েত রাশিয়া এই সরকারকে স্বীকৃতি জানায়। এভাবে কোরিয়াকে কেন্দ্র করে দুই মহাপক্ষের মধ্যে যুদ্ধের পরিবেশ গড়ে ওঠে।
১৯৫০ সালে ২৫জুন উত্তর-কোরিয়ার সেনাধরিদ্র ৩৮ডিগ্রী অক্ষরেখা অতিক্রম করে দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রবেশ করলে দুই কোরিয়ার মায়া যুদ্ধের সূচনা হয়। জাতিপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদ সোভিয়েত রাশিয়ার অনুপস্থিতিতে উত্তর কোরিয়াকে আক্রমণকারী বলে চিহ্নিত করে এবং দক্ষিণ কোরিয়াকে সর্বপ্রকার সাহায্য করার জন্য সদস্য রাষ্ট্রগুলিকে আবেদন জানায়। ৭ জুলাই জাতিপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদ কোরিয়ায় জাতিপুঞ্জের সেনাবাহিনী, যার অধিকাংশই মার্কিন সেনা পাঠানোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এভাবে দুই কোরিয়ার মধ্যে যুদ্ধের সূচনা হয়। জাতিপুঞ্জের সেনাবাহিনীর আক্রমণে ৩০ সেপ্টেম্বর উত্তর কোরিয়ার সেনাবাহিনী দক্ষিণ কোরিয়া ত্যাগ করতে বাধ্য হয়।
অবশেষে সোভিয়েত রাশিয়ার আহ্বানে যুদ্ধের গতি মন্থর হয়। এরপর মোট ৫৭৫টি বৈঠকের পর ১৯৫৩ খ্রিঃ ২৭ জুলাই উভয়পক্ষে যুদ্ধবিরতি ঘটে। পূর্বের মতোই ৩৮ডিগ্রি অক্ষরেখাকে কেন্দ্র করেই কোরিয়া দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়।
কোরিয়া যুদ্ধ ছিল একটি নিষ্ফল যুদ্ধ । তবুও এই যুদ্ধের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম ৷ যথা,
প্রথমতঃ বল প্রয়োগের মাধ্যমে উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়ার মধ্যে সংযুক্তিকরণ সম্ভব হয় নি। বরং কোরিয়ার বিভাজন আজও এক ঐতিহাসিক সত্য।
দ্বিতীয়তঃ কোরিয়া যুদ্ধের মাধ্যমে প্রাচ্যে ঠান্ডা লড়াই বিস্তার লাভ করে।
তৃতীয়তঃ দীর্ঘস্থায়ী এই যুদ্ধের ফলে দুই কোরিয়াকেই প্রচুর মূল্য দিতে হয়। উভয় রাষ্ট্রের অর্থনীতি বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। প্রায় পচিশ লক্ষ মানুষ নিহত হয়।
চতুর্থতঃ চিন এই যুদ্ধে তার সামরিক বাহিনীর শক্তিকে পরখ করে নেয় এবং তাহা যে আমেরিকাকে প্রবল আঘাত দিতে সক্ষম তা প্রমাণিত হয়।
পঞ্চমতঃ এই যুদ্ধে মার্কিন স্বার্থে জাতিপুঞ্জকে ব্যবহার করা হলে জাতিপুঞ্জের মর্যাদা হ্রাস পায়।
আলোচনা শেষে একথা বলা যায় যে, কোরিয় যুদ্ধ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নগ্ননীতিকে প্রকাশে এনে দেয় । এশিয়াবাসীরা মার্কিনী মনোভাব সম্বন্ধে সন্দিগ্ধ হয়ে ওঠে । অনাবশ্যক ও নিষ্ফল এই যুদ্ধ দুই কোরিয়ার আর্থিক, সামরিক ও পরিকাঠামোগত ক্ষতি ছাড়া আর কিছুই বিশ্বকে দিতে পারেনি।
সম্ভাব্য প্রশ্নঃ
- কোরিয়া যুদ্ধর প্রকৃতি সম্পর্কে আলোচনা করো।