মেইজি পুনঃস্থাপন কী জাপানে আধুনিক যুগের সূচনা করেছিন?
মেইজি পুনঃস্থাপন বা মেইজি পুনর্গঠন বা মেইজি সংস্কার বলতে বোঝায় ১৮৬৮ সালে জাপান সম্রাট মেইজির একটি সংস্কার ঘটনাকে, যার মাধ্যমে জাপান সাম্রাজ্যে প্রকৃত সাম্রাজ্যিক শাসন প্রতিষ্ঠা হয়। তবে এর পূর্বেও জাপানে শাসক সম্রাট ছিল। এই সংস্কার ঘটনাগুলির মাধ্যমে প্রকৃত ক্ষমতা এবং রাজনৈতিক ব্যবস্থা জাপানের সম্রাটের অধীনস্থ হয়। পুনঃস্থাপিত সরকারের লক্ষ্যগুলিকে নতুন সম্রাট মেইজি পঞ্চনিবন্ধ শপথে প্রকাশ করেন। এই সংস্কারের ফলে জাপানের সামাজিক ও রাজনৈতিক কাঠামোয় প্রচুর পরিবর্তন আসে এবং জাপানে আধুনিক যুগের সূচনা হয়।
প্রাক-মেইজি যুগে জাপানের সমাজব্যবস্থা ছিল সামন্ততান্ত্রিক। প্রশাসনিক বাবস্থা ছিল বিকেন্দ্রীভূত এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ছিল। কৃষিকেন্দ্রিক। সেই যুগে জাপানের সাথে বাইরের জগতের কোনো সম্পর্ক না থাকায় বৈদেশিক বাণিজ্য জাপানের কাছে অপরিচিত ছিল। জাপানের শিক্ষা-পদ্ধতিও ছিল ঐতিহ্যগত। কিন্তু মেইজি যুগের আবির্ভাবের সাথে সাথে জাপানের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থার বিশেষ পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়। সামন্ততন্ত্রের অবসানের সাথে সাথে জাপানে নতুন সমাজ-ব্যবস্থা গড়ে ওঠে, শাসনব্যবস্থাও কেন্দ্রীভূত হয়। অর্থনীতিতে কৃষির পরিবর্তে শিল্প অধিকতর গুরুত্ব লাভ করে। কমোডোর পেরীর অভিযান ও কামাগাওয়ার চুক্তি অনুসারে জাপানের সাথে বহির্বিশ্বের বানিজ্য সম্পর থকে উঠতে শুরু করে। পতিত জাপানের শিক্ষাপদ্ধতিতে পরিবর্তন সেন সম্পর জাপানে প্রচলিত হয়াব পাঠাপ্রতি মিক্ষাপদ্ধতি এবং এই শিক্ষার প্রভাবো খা দেয়। সমাজেও পাশ্চাত্য ভাবধারা প্রতিফলিত হতে থাকে। ফলে প্রাক-মেইজি ও সেনের যুগের মধ্যে পার্থক্য সহজেই পরিলক্ষিত হয়।
ঐতিহাসিক ভিনার্ক প্রাক-মেইজি ও মেইজি যুগের প্রসঙ্গকে সমালোচনা করে বলেছেন যে, -ক) পূর্বে দেশের প্রশাসনিক ব্যবস্থা ছিল অভিজাততান্ত্রিক ধাঁচের। পরেও শাসনব্যবস্থার এই বৈশিষ্ট্য অপরিবর্তিত থেকে যায়। খ) প্রাক-মেইজি যুগে প্রথাগত ভাবে সম্রাটের প্রধান উপদেষ্টা ছিলেন টকুগাওয়া বংশের সোগুন। মেইজি যুগে টকুগাওয়া পরিবারের আধিপত্যের অবসান ঘটলেও মেইজি যুগের সম্রাটের প্রধান উপদেষ্টা হিসাবে সাতসুমা, চোসু, ভোলাও ও বিজেন পরিবারের সামন্তগণ নিযুক্ত হতে থাকেন। গ) প্রাক-মেইজি যুগের সম্রাটের প্রশাসনিক ক্ষমতার সাথে মেইজি যুগের প্রশাসনিক ক্ষমতার মধ্যেও কোনো বিশেষ পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়নি। সোগুন যুগে প্রশাসনিক ব্যাপারে কার্যত সম্রাটের কোনো ক্ষমতা ছিল। মেইজি যুগের প্রশাসনেও প্রকৃতপক্ষে সম্রাটের কোনো ক্ষমতা ছিল না। ঘ) প্রাক-মেইজি এবং মেইজি যুগে কৃষকদের সামাজিক ও আর্থিক অবস্থার মধ্যে কোনো পার্থক্য লক্ষ্য করা যায় না।
ঐসিহাসিক ভিনাকের এই সিদ্ধাকে অন্যান্য ঐতিহাসিকগণ আংশিকভাবে গ্রহণ করলেও সম্পূর্ণভাবে গ্রহণ করতে সম্মত নন। তাঁদের মতে, প্রাক্-মেইজি ও মেইজি যুগের মধ্যে অনেক পার্থক্যই সম্পূর্ণভাবে উপলব্ধ করা যায়। তাঁদের মতে, শিল্পভিত্তিক অর্থনীতি, বহির্বিশ্বের সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন, পাশ্চাত্যের অনুকরণে শিক্ষা-ব্যবস্থার প্রবর্তন, সামাজিক রীতি-নীতির আধুনিকীকরণ, সামরিক শক্তিবৃদ্ধি ও ইউরোপীয় প্রথায় সেনাবাহিনী গঠন, সমাজে একটি শ্রেণীর উদ্ভব প্রভৃতি মেইজি যুগের বৈশিষ্ট্যের কোনো একটিও প্রাক্-মেইজি যুগে ছিল না। প্রাক্-মেইজি যুগে জাপানের সম্রাটকে প্রকৃতপক্ষে রাজপ্রাসাদে বন্দী জীবন যাপন করতে হত। কিন্তু মেইজি যুগে তিনি প্রকৃত অর্থে 'পুনর্বাসন' লাভ করেন।
প্রকৃতপক্ষে পরস্পর বিরোধী দুটি মতের মধ্যে কোনটিই পুরোপুরিভেব গ্রহণযোগ্য নয়। সাধারণভাবে বলা যায় যে, মেইজি পুনঃস্থাপনের প্রকৃতি ছিল রক্ষণশীল। জাপানের সর্বস্তরের মানুষের সম্মিলিত আন্দোলনের ফলে সোগুন শাসনের পরিসমাপ্তি ঘটে। ডাইমো, সামুরাই, বণিক, কৃষক প্রভৃতি সকল শ্রেণির মানুষই আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে। কিন্তু এই আন্দোলন সফল হলেও সাফল্যের ফলাফল সকল শ্রেণীর মধ্যে সমভাবে বণ্টন করা হয়নি। প্রকৃতপক্ষে জাপানের রাজনৈতিক পটপরিবর্তন সম্পর্কে বলা যায় যে, সাতসুমা, চোসু তোজা, হিজেন প্রভৃতি সামন্তশ্রেণীর নেতৃবৃন্দ প্রশাসনিক ক্ষমতা লাভের আশায় সোগুন বিরোধী আন্দোলন শুরু করে এবং সাফল্য পেতে সকল শ্রেণীর সাহায্য গ্রহণ করে। কিন্তু আন্দোলনের সাফল্যের পর প্রায় সকল সুযোগ-সুবিধা নিজেরাই আত্মসাৎ করে। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ কৃষক শ্রেণীর অবস্থার সামান্যতম পরিবর্তন হয়নি।
মেইজি পুনঃস্থাপন যে রক্ষণশীল প্রকৃতির ছিল তার পরিচয় পাওয়া যায় তারা পুনঃস্থাপনের পর জাপানে কোনো গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেনি বা করার চেষ্টাও করেনি। সাতসুমা, চোসু, তোজা এবং হিজেন -এই চারটি সামন্ত গোষ্ঠী নিজেদের মধ্যেই সকল রাজনৈতিক ক্ষমতা সীমিত করার চেষ্টা করে। ফলে গঠিত হয় অভিজাততান্ত্রিক সরকার। মেইজি সম্রাট দেশের শাসন ব্যবস্থা আধুনিকীকরণে আগ্রহী থাকলেও গণতন্ত্রে বিশ্বাসী ছিলেন না। এজন্য তাঁর মঞ্জুরীকৃত ১৮৮৯ সালের সংবিধান দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেনি, প্রতিষ্ঠা করেছিল অভিজাততন্ত্র। অর্থাৎ সম্রাট কর্তৃক সম্রাট কর্তৃক মনোনীত অল্পসংখ্যক ব্যক্তির দ্বারা দেশ শাসনের ব্যবস্থা।
মেইজি যুগে জাপানীদের আরও রক্ষণশীলতার পরিচয় পাওয়া যায়। মেইজি যুগের জাপান পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞানে দীক্ষা গ্রহণ করলেও প্রাচ্য জগতের নীতিবোধ তারা ত্যাগ করেনি। মেইজি জাপান পাশ্চাত্য সভ্যতার বাহ্য অংশটুকু মাত্র গ্রহণ করে, কিন্তু জাতিগত বৈশিষ্ট্যের পরিচয় হিসাবে তার নিজস্ব ঐতিহ্যগত সভ্যতাই অক্ষুণ্ণ রাখে। অর্থাৎ বলা যায় যে, আধুনিক জাপানের সভ্যতা ও সংস্কৃতিতে পাশ্চাত্য প্রভাব পড়লেও অন্তরের অন্তস্থল থেকে জাপানীরা তাদের পুরাতন প্রথা ও ঐতিহ্যের বিন্দুমাত্র বিসর্জন দেয় নি। মুলত মেইজি যুগের জাপানীরা ছিল প্রয়োগবাদে বিশ্বাসী। অর্থাৎ তারা ছিল বাস্তবক্ষেত্রে প্রয়োগের দ্বারা পাশ্চাত্য সভ্যতার উপকারিতা নির্ণয়ের নীতিতে বিশ্বাসী।
পশ্চিমী সভ্যতার যা জনহিতকর জাপানীরা কেবল তাকেই গ্রহন করে বাক্তিগত ও সমষ্টিগত জীবনে প্রয়োগের পক্ষপাতী ছিল। সেজন্য অন্ধের মতো বিচার-বিশ্লেষণ না করে তারা পাশ্চাতোর ভাবধারার কাছে আত্মসমর্পন করেনি। বেন্থাম ও মিলের উপভোগবাদের দ্বারা প্রভাবিত হলেও এবং ধর্মনিরপেক্ষতার মনোভাব তাদের মধ্যে গড়ে উঠলেও প্রাচীন ঐতিহ্যকে তারা অস্বীকার করেনি।
মেইজি পুনঃস্থাপনের যুগে জাপানের নেতৃবর্গ জাপানী সমাজকে পাশ্চাতা দেশগুলির আদর্শে গড়ে তুলতে চেষ্টা করেন। এই নতুন আদর্শের সার্থক রূপায়নের জন্য প্রাচীন কৃষি-ভিত্তিক অর্থনীতিকে পরিত্যাগ করে শিল্পভিত্তিক অর্থনীতি গড়ে তোলার ব্যবস্থা করেন। বৃহৎ ও ক্ষুদ্র শিল্প সংগঠন, নগর ও বন্দরের পত্তন, পোতাশ্রয় নির্মাণ, রেলপথ ও টেলিগ্রাফ স্থাপন প্রভৃতির মাধ্যমে জাপানের বহিরঙ্গকে সম্পূর্নভাবে পাশ্চাত্য দেশের আদশে গড়ে তোলার ব্যবস্থা করা হয়।
পাশ্চাত্যের উন্নত ও আধুনিক কারিগরী বিদ্যা ছাড়াও রাষ্ট্রনীতি, দর্শন, সংস্কৃতি প্রভৃতির সাথে ঘনিষ্ঠ পরিচয় লাভের উদ্দেশ্যে মেধাবী বহু ছাত্রকে ইউরোপ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয় এবং স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের পরে তারা যাতে তাদের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা যথোপযুক্তভাবে কাজে লাগাতে পারে তার ব্যবস্থা করা হয়। মেইজি যুগের এই নীতি নিঃসন্দেহে খুবই সফলতা লাভ করে এবং সামগ্রিকভাবে জাপানের জাতীয় জীবনের উপর গভীরভাবে প্রভাব বিস্তার করে। এই পরিবর্তন ও রূপান্তরকে বিপ্লবাত্মাক তখ্যা দেওয়া যায়।
কিন্তু জাতীয় জীবনে নাজিল বিরাট পরিবর্তন জাপানে কোনো বিরাট রাজনৈতিক পরিবর্তন আনে নি। অর্থনৈতিক ও সামাজিক চিন্তাধারার বিরাট রূপান্তর ঘটলেও রাশিয়ার রাজনৈতিক বিপ্লবের মতো কোনো বিপ্লবই জাপানে দেখা দেয় নি। পাখালেও দেশগুলির অনুকরণে জাপানের শাসনকার্য পরিচালনার জনা মেইজি জাপানেও একান্ত সংবিধান তৈরী হয় কিন্তু তাহা জনগণের হাতে শাসনক্ষমতা অর্পণ করেনি। একটি মুথ সামাজিক ক্ষমতার বিকালে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তনে সেইজ হলেও রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতার অবস্থানে কোনো পরিবর্তন দেখা দেয় নিকে
প্রাক-মেইজি জাপানে রাজতন্ত্র প্রচলিত থাকলেও প্রকৃত অর্থে প্রশাসনিক কাঠামো ছিল অভিজাততান্ত্রিক। মেইজি যুগেও এর সামান্য পরিবর্তন হয় মাত্রা স্বৈরাচারী টকুগাওয়া সোগুন ক্ষমতাচ্যুত হলেও সেই স্থান পূরণ করার অধিকার প্রকৃতপক্ষে পুনস্থাপিত সম্রাটও পাননি। জনগণও এই অধিকার থেকে বঞ্চিত ছিল। সাতসুমা, চোসু, তোজা, হিজেন প্রভৃতি সামন্তগোষ্ঠী রাজনৈতিক এক ক্ষমতা লাভ করতে সমর্থ হয়। এই দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করে বলা যায়, মেইজি পরিবর্তনকে প্রকৃতপক্ষে বিপ্লব বলা চলে না। বরং ইহা ছিল স্বৈরাচারিতার রূপান্তর।
মেইজি জাপান কখনোই পাশ্চাত্যের জীবনধারা সামগ্রিক ভাবে গ্রহণ করে নি। প্রায়োজন অনুসারেই তারা পাশ্চাত্য ভাবধারা গ্রহণ করে, আবার প্রয়োজন অনুসারেই তা বর্জন করে। পাশ্চাত্য ভাবধারায় পুষ্ট হয়ে জাপানীরা ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদে বিশ্বাসী হয়ে উঠলেও খ্রিষ্টধর্মের পরিবর্তে তারা শিল্টো ধর্মকেই জাতীয় ধর্ম হিসাবে গ্রহণ করে। পাশ্চাত্য বিজ্ঞান ও ধ্যানধারণায় আকৃষ্ট হয়ে জীবনে তা প্রয়োগ করতে উদ্বুদ্ধ হলেও পাশ্চাত্যের নীতিবোধ তারা গ্রহণ করেনি। ঐতিহ্যগত নীতিবোধকেই তারা শ্রদ্ধার সাথে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করে। সংবিধান তৈরীর ব্যাপারেও এই ঐতিহাগত আদর্শের প্রতি জাপানীদের অপরিবর্তিত মনোভাবের পরিচয় পাওয়া যায়। সংবিধানের বাহ্য কাঠামো সংসদীয় আদর্শে গড়ে উঠলেও জাপানে সংসদীয় গণতন্ত্র স্থাপিত হয়নি।
প্রাক-মেইজি যুগে সংসদীয় গণতন্ত্রের কোনো অভিজ্ঞতা জাপানের ছিল না। সুতরাং মেইজি যুগেও সেই সংসদীয় গণতন্ত্রের আদর্শ নিয়ে তারা কোনো প্রকার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে সম্মত হয়নি। গণতন্ত্রের মুখোশের আড়ালে তারা সামন্ততান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে প্রয়াসী হয়েছিল। সেজন্য সাংবিধানিক শাসনের প্রথম দিকে ফলভিত্তিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি। তাদের শিক্ষা-নীতির উদ্দেশ্যও স্বাধীন চিন্তাকে উদ্রেক করেনি, তারা রাষ্ট্রের স্বার্থের সহায়ক শিক্ষা-বাবস্থা গঠন করে। আধুনিক অর্থে জাতীয়তাবাদের উদ্ভবও মেইজি জাপানে সৃষ্টি হয়নি। মেইজি জাপানের জাতীয়তাবাদের অর্থ ছিল ঐতিহ্যের পূজা এবং সম্রাটের প্রতি আনুগত্যের প্রকাশ। সুতরাং উপরোক্ত আলোচনা থেকে বলা যায় মেইজি পুনঃস্থাপন প্রকৃত অর্থে জাপানে আধুনিক যুগের সূচনা করতে পারেনি।