মুঘল যুগে ভারত মহাসাগরীয় বাণিজ্যের মূল বৈশিষ্ট্য অলোচনা করো?

 মুঘল যুগে ভারত মহাসাগরীয় বাণিজ্যের মূল বৈশিষ্ট্য অলোচনা করো?  

মুঘল যুগে ভারত মহাসাগরীয় বাণিজ্যের মূল বৈশিষ্ট্য অলোচনা করো?


ভারতের দক্ষিণে বিস্তৃত জলরাশির সমৃদ্ধ ইতিহাস রয়েছে। চোল আমল থেকেই ভারত সমুদ্রের ওপর কর্তৃত্ব করেছে। চোল শাসক রাজেন্দ্র চোল, প্রথম রাজরাজের আমলে চোলদের শৈলেন্দ্র সাম্রাজ্য অভিযান, বা মালদ্বীপ বিজয়ের মাধ্যমে ভারতীয়রা সমুদ্র শাসনের যে নজির রেখেছে, পরবর্তীকালে তা না থাকলেও সমুদ্রের ইতিহাসের সঙ্গে ভারতবর্ষের নাম ওতপ্রোতভাবে যুক্ত। অষ্টাদশ শতক থেকে এদেশ যে ঔপনিবেশিক শাসনের বেড়াজালে জড়িয়ে পড়ে তা এসেছে সামুদ্রিক সংযোগের কারণেই। পর্তুগিজ, দিনেমার, ইংরেজ বা ফরাসিরা সামুদ্রিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার সূত্র ধরেই ভারতে তাদের উপনিবেশ প্রতিষ্ঠা করতে সমর্থ হয়। প্রত্যক্ষভাবে ইউরোপকে জুড়ে দেয় এ দেশের বাণিজ্যের সঙ্গে। আর সেই সূত্রেই 'বণিকের মানদণ্ড' দেখা দেয় 'রাজদণ্ড' রূপে।



এদেশের ভৌগোলিক অবস্থান তথা ভারতের পূর্ব-পশ্চিম ও দক্ষিণ প্রান্ত জুড়ে বিস্তৃত জলরাশির উপস্থিতি সুপ্রাচীনকাল থেকে সমুদ্র বাণিজ্যকে সম্ভব করে তুলেছিল। ভারতের পশ্চিমে আরব সাগর পূর্বে বঙ্গোপসাগর আর দক্ষিণে ভারত মহাসাগরের অবস্থান। একাদশ শতকের শেষ দিকে ভারত মহাসাগরে বাণিজ্যের গতিবিধির কিছু লক্ষণ স্পষ্ট হয়। ভারতের পশ্চিম উপকূলের সবচেয়ে বড় বন্দর ছিল গুজরাটের ক্যাম্বে। পিরেজ লিখেছেন, ক্যাম্বের দুদিকে দুই বাহু প্রসারিত ছিল। ক্যাম্বের বড় প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল সে সময়ে ভারতের দক্ষিণে মালাবার উপকূলের কালিকট বন্দর। কালিকটের সঙ্গে বাণিজ্য চলত পারস্য, ক্যাম্বে, মালদ্বীপ ও লোহিত সাগর অঞ্চলের। পঞ্চদশ শতকে ভারত মহাসাগরের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো ভারত, চিন ও জাপানের মধ্যে পণ্য ক্রয় বিক্রয়ের কেন্দ্র হিসেবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় মালাক্কার উত্থান। এই উত্থান কালিকটে চিনা বণিকদের আগমনকে অপ্রয়োজনীয় করে তোলে ৷


ভারত মহাসাগরের পশ্চিম দিকে অর্থাৎ আরব সাগর অঞ্চলে ছিল আরব বণিকদের প্রাধান্য, পূর্বদিকে চিনা বণিকদের প্রাধান্য। সে সময়ে ইন্দোনেশিয়ার সমুদ্রপথে একচেটিয়া বাণিজ্য করত জাভা ও মালয়ের ব্যবসায়ীরা। মধ্যবর্তী অংশে অর্থাৎ ক্যাম্বে থেকে মালাক্কা পর্যন্ত ছিল গুজরাটের মুসলমান তথা ভারতীয় বণিকদের প্রাধান্য। এককথায় ভারত সাগরের পূর্বদিকে চিনা জাঙ্কের প্রাধান্য আর পশ্চিমদিকে আরবদের ধাও-এর প্রাধান্য। আর মধ্যবর্তী অংশে ভারতীয় জাহাজ। পঞ্চদশ শতকের শেষ ও ষোড়শ শতকের সূচনায় এই ছিল ভারতসাগরের  বাণিজ্যের মূল কথা।


১৪৯৮ খ্রিস্টাব্দে ভাস্কো-দা-গামা-র নেতৃত্বে উত্তমাশা অন্তরীপ হয়ে ভারতে আসার পথ আবিষ্কৃত হয়। এর ফলে এখন থেকে ভারতের বাণিজ্য ইউরোপের বাণিজ্যের সাথে যুক্ত হয়ে পড়ে। পর্তুগিজরা ভারত মহাসাগরের সমুদ্রে বাণিজ্য প্রতিষ্ঠা করেন তা Estado-da-India নামে পরিচিত। ভারত মহাসাগরে পর্তুগিজদের এই আবির্ভাব  ষোড়শ শতকে সমুদ্র বাণিজ্যে এক নতুন যুগের সূচনা ঘটিয়ে দেয়। তবে এই শতকেই আরব সাগরের গা ঘেঁষে তিন-তিনটি সাম্রাজ্যের আবির্ভাব ঘটে। তার মধ্যে ভারতের মুঘল সাম্রাজ্য ছিল অন্যতম। আর । এই সাম্রাজ্যের শ্রেষ্ঠ শাসক আকবর পনেরোশো সত্তরের  দশকে গুজরাট অধিকার করেন। পঞ্চদশ শতকের শেষে ভারতে পর্তুগিজদের এই আবির্ভাব ষোড়শ শতকে ভারত ড: মহাসাগরীয় বাণিজ্যে এক বিরাট পরিবর্তন নিয়ে আসে। তাঁরা আরব সাগরের উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার উপর জোর দেয়। ভাস্কো দা গামা প্রথম যাত্রার সঙ্গে সঙ্গে পর্তুগালের রাজা ম্যানুয়েল 'পারস্য, ভারত এবং আরব জলপথের  নৃপতি' উপাধি নেন। পর্তুগিজদের লক্ষ্য হয়ে পড়ে আরব সাগরের কর্তত প্রতিষ্ঠার ওপর।



ষোড়শ শতকে পর্তুগিজরা মূলত মসলার বাণিজ্য করত। ১৫১১ খ্রিস্টাব্দে তারা গোলমরিচ উৎপাদনের  প্রধান কেন্দ্র ভারত মহাসাগরের পূর্ব দিকে অবস্থিত মলুক্কাস দখল করে। তবে মালাবার (ভারত) থেকে তারা  অধিকাংশ গোলমরিচ সংগ্রহ করতো। এছাড়া ঘোড়ার ব্যবসায়ে পর্তুগিজদের আকর্ষণ ছিল। তাদের গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি গোয়া ঘোড়া বাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল। গুজরাটি বণিকরা জাহাজে করে পারস্য ও লোহিত সাগরের বন্দরগুলিতে তাদের পণ্য  পাঠাতো। তার মধ্যে মশলাও ছিল। পর্তুগিজরা মাঝ সমুদ্রে এইসর জাহাজের উপর আক্রমণ চালাতে শুরু করে গুজরাটি বণিকরা এই পরিস্থিতিতে সমুদ্রপথে নিরাপদে চলাচলের জন্য পর্তুগিজদের কাছ প্রথা মেনে নিয়েছিল। ক্যাম্বে থেকে যাত্রা শুরু করে গুজরাটি জাহাজ দিউ-তে গিয়ে গিয়ে শুল্ক দিত। তারপর সেখান থেকে পারস্য বা লোহিত সাগরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করতো।



ষোড়শ শতকে যেসব ভারতীয় বন্দরগুলি গুরুত্ব হয়ে উঠেছিল ভারত মহাসাগরীয় বাণিজ্যে তার মধ্যে গুজরাটের ক্যাম্বে, সুরাট ও দিউ-য়ের কথা বলতে হয়। মালাবার অঞ্চলের প্রধান বন্দর ছিল কালিকট আর পূর্ব উপকূলে মসুলিপত্তন। আর বাংলাদেশে ছিল চট্টগ্রাম, সপ্তগ্রাম ও হুগলি। পরবর্তী কালে সুরাটই গুরুত্বপূর্ণ বন্দর হয়ে ওঠে। শুধু তাই নয়, এই শতকের শ্রেষ্ঠ· বন্দর হয়ে উঠেছিল সুরাট। সুরাটের এই সমৃদ্ধির পশ্চাতে মুঘল সম্রাটদের ভূমিকা ছিল। তারা সুরাট বন্দরকে হজের জন্য নির্দিষ্ট বন্দর হিসাবে গণ্য করেছিলেন। এই বন্দরে বাণিজ্যের জন্য একটা বড় মুঘল নৌবহর ছিল। শাহজাহান স্বয়ং সুরাটের নৌ-বাণিজ্যে আগ্রহী ছিলেন। সতীশচন্দ্রের লেখা থেকে জানা যায় ১৬৫০ খ্রিস্টাব্দে শাহজাহান গুজরাটে ৬ থেকে ৮টি জাহাজ তৈরির নির্দেশ দিয়েছিলেন।. মীর জুমলা, শাহ সুজা-র মত শাসকবর্গও সমুদ্র বাণিজ্যে অংশ নিয়েছিলেন।



ষোড়শ শতাব্দী ও সপ্তদশ শতকের প্রথমার্ধে এশিয়া থেকে মশলা রপ্তানির বাণিজ্যে পর্তুগাল আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছিল। তাতে আকৃষ্ট হয়ে ইংরেজ ও ডাচরা এশিয়াতে বাণিজ্য করার জন্য কোম্পানি প্রতিষ্ঠিত করেছিল। এইভাবে প্রায় একই সময়ে 'ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি' ১৬০০ খ্রিস্টাব্দে ও 'ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি' ১৬০১ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয়। সপ্তদশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে এই দুটি কোম্পানি এশিয় বাণিজ্যে পর্তুগিজদের পেছনে ফেলে দেয়। ফলে পর্তুগিজ বাণিজ্য গুরুত্ব হারিয়ে ফেলে। এই শতকের মধ্যবর্তীকালে এই দুই কোম্পানি বাংলায় (হুগলিতে ইংরেজরা আর চুচূড়ায় ডাচরা) তাদের কুঠি স্থাপন করে বাণিজ্য শুরু করে সুশীল চৌধুরীর মতে,"ষোড়শ শতকের শেষ দিক থেকে অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত বাংলার সর্বাপেক্ষা বৃহৎ বন্দর ছিল হুগলি। এছাড়াও অষ্টাদশ শতকের প্রথম দিকে অপর দুই ইউরোপীয় কোম্পানি-ডেনিশ কোম্পানি ও অস্টেন্ড কোম্পানি-বাংলায় বাণিজ্য শুরু করে।



এই সমুদ্র বাণিজ্যে যেসব পণ্যের ব্যবসা চলত তার মধ্যে বস্ত্র ও মসলা ছিল সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য। লোহিত সাগর অঞ্চলে রপ্তানি হতো কাপড়, নীল আর মাদকদ্রব্য। আমদানিকৃত পণ্যের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল গরম কাপড়, রেশম বস্ত্র ও সোনা রূপা। রপ্তানিকৃত পণ্যের মধ্যে নীল আসতো গুজরাট ও আগ্রা থেকে, মালাবার অঞ্চল থেকে গোলমরিচ, সিংহল থেকে দারুচিনি, ভারতবর্ষ থেকে কাপড় বিনিময়ে পূর্ব "আফ্রিকা থেকে ক্রীতদাস, আবলুশ কাঠ, হাতির দাঁত ও সোনা ইত্যাদি আমদানি করতো। এছাড়া অন্য একটি সমুদ্রপথে ভারতীয় বণিকরা হেড্রামও থেকে হরমুজ হয়ে পারস্য সাগর দিয়ে ভারতে আসত ঘোড়া, মুক্তো পার্শিয়ান সিল্ক ও কার্পেট নিয়ে। বাংলা থেকে সমুদ্র পথে  রপ্তানি হত কাপড়, কাঁচা রেশম ও খাদ্যশস্য। করমণ্ডল উপকূলের বন্দর থেকে রপ্তানি হতো কাপড় ও সুতো। 



যেসব পণ্য বাংলা থেকে রপ্তানি হতো তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল কাঁচা রেশম, চিনি ও বস্ত্র। এছাড়া গুজরাট থেকে রপ্তানি হতো তুলো, মালাবার থেকে গোলমরিচ। নীল রপ্তানি হতো গুজরাট ও বাংলা থেকে। ইউরোপে ভারতীয় নীলের খুব চাহিদা ছিল। কারণ এর দাম ও কার্যকারিতা বেশি। বুরহানপুর, সরখেজ-এ উৎকৃষ্ট নীল উৎপন্ন হতো। তবে সপ্তদশ শতকের ভারতীয় নীল এর চাহিদা হ্রাস পায়। এই সময় থেকে আবার সোরা রপ্তনি হতে শুরু করে। সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতকে পর্তুগিজরা ছাড়াও ডাচ ও ইংরেজরা এই সোরার ব্যবসায়ে লিপ্ত হয়। ষোড়শ শতকে যেসব পণ্য সামগ্রী ভারতবর্ষে ভারত মহাসাগরের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসতো তার মধ্যে প্রধান হচ্ছে সোনা,  রূপা, কিছু মশলাপাতি আর ঘোড়া। আর অল্প বিস্তর আসতো মালয় থেকে টিন, পূর্ব-আফ্রিকা থেকে হাতির দাঁত। পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চল থেকে রং করার জন্য গাচ-গাছড়া, মদ, গোলাপজল ও নানান শুকনো ফলা পশ্চিম এশিয়া থেকে সোনা রূপা ভারতে আমদানি হতো : সেটাই বেশি অর্থকরী ছিল। 



ভারতের সমুদ্র বণিকরা দেশের কয়েকটি বিশেষ এলাকায় বাস করতেন। গুজরাটের সুরাট বন্দর, কেরালার উপকূলের কালিকট, করমণ্ডলের মসুলিপত্তন, নিম্ন-গাঙ্গেয় উপত্যকার হুগলী ছিল ভারত মহাসাগরে সমুদ্র বাণিজ্যের প্রধান কেন্দ্র। এর মধ্যে সপ্তদশ শতকের মুঘল সাম্রাজ্যের শ্রেষ্ঠ ছিল সুরাট। সুরাটের বণিকরা ভারত মহাসাগরের বিভিন্ন বন্দরের সঙ্গে ব্যবসায় লিপ্ত হয়েছিলেন। সপ্তদশ শতকে সুরাটের সমৃদ্ধি ছিল বিশেষ উল্লেখযোগ্য। প্রায় ৪০টি গুজরাটি জাহাজ এই লোহিত সাগরীয় বাণিজ্যে প্রতিবছর নিযুক্ত থাকতো। প্রধানত গুজরাটি কাপড়, আগ্রা অঞ্চলের নীল, মালাবারের মশলা এই সবই রপ্তানি হত গুজরাটি জাহাজগুলোয়। এর বিনিময়ে ভারতে আসতো আরবি ঘোড়া, কফি, কিছু ফল আর প্রচুর টাকা। এভাবে কাঁচা টাকা কত যে আসতো তার সঠিক হিসাব জানা যায় না। মোখা  বন্দরকে সে যুগে বলা হতো 'মুঘল সাম্রাজ্যের রত্নভাণ্ডার'।


About the author

Irisha Tania
"আমি সেই মেয়ে, যে শব্দে বাঁচে। কলম আমার অস্ত্র, আর কাগজ আমার স্বপ্নের আকাশ। প্রতিটি অনুভব, প্রতিটি চিন্তা আমি সাজিয়ে রাখি অক্ষরের গাঁথুনিতে। কখনো গল্পে, কখনো কবিতায়, আবার কখনো নিঃশব্দের ভেতরে। আমি লিখি, কারণ লেখার মাঝে আমি নিজেকে খুঁজে পাই। …

Post a Comment

🌟 Attention, Valued Community Members! 🌟