ঠান্ডা লড়াই কী? ইহা উদ্ভবের কারণ কী? বিশ্ব-রাজনীতিতে এর কী প্রভাব পড়েছিল?

ঠান্ডা লড়াই কী? ইহা উদ্ভবের কারণ কী? বিশ্ব-রাজনীতিতে এর কী প্রভাব পড়েছিল?

ঠান্ডা লড়াই কী? ইহা উদ্ভবের কারণ কী? বিশ্ব-রাজনীতিতে এর কী প্রভাব পড়েছিল?


 দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সোভিয়েত রাশিয়া এবং অনুগামী রাষ্ট্রগুলির সাথে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র ও তার অনুগামী রাষ্ট্রগুলির মধ্যে নানা বিষয়ে মত পার্থক্য ও সন্দেহ দেখা দেয়। এসময় ইউরোপের সামাবাদের প্রসারকে প্রতিহত করার উদ্দেশ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র টুম্যান নীতি ও মাশাল পরিকল্পনা গ্রহন করে। ফলে বিশ্ব-রাজনীতি দুটি ভাগে ভাগ হয়ে যায় -একদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রপক্ষ এবং রাশিয়া ও তার অনুগামী রাষ্ট্র। যে কোন কারনে এই উভয় শিবিরে স্নায়ু যুদ্ধ বা ঠান্ডা লড়াই চলতে থাকে।


 পরস্পর বিরোধী দুই শক্তি-জোটের মধ্যে যে প্রবল বিদ্বেষ ও কূটনৈতিক বিরোধ দেখা দেয়, যার ফলে যুদ্ধের একটি বাতাবরন সৃষ্টি হয়, সেই অবস্থাকে বলে ঠান্ডা লড়াই বা স্নায়ু যুদ্ধ। ঠান্ডা লড়াই কোন প্রতাক্ষ যুদ্ধ নয়, কিন্তু যে কোন সময় যুদ্ধ ঘটতে পারে এমন একটা অবস্থার সৃষ্টি হয়। ফলে রাষ্ট্রগুলির উপর মানসিক চাপ বৃদ্ধি পায় এবং তাদের সর্বদা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাকতে হয়। ঐতিহাসিক ফায়েল-এর ভাষায় বলা যায় যে, পারস্পরিক সন্দেহ ও অভিযোগের ফলে বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে যে উত্তেজনাপূর্ন আবহাওয়ার সৃষ্টি হয়, তাহা যে কোন সময় সংঘর্ষের রূপ নিতে পারে, দেখা দেয় ঠান্ডা যুদ্ধ।


 ঠান্ডা লড়াইয়ের পূর্ব মুহূর্তে রাশিয়ার বিরুদ্ধে শক্তি প্রয়োগ সম্ভব ছিলনা। ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সোভিয়েত সম্প্রসারন নীতি প্রতিরোধ করতে গিয়ে দীর্ঘস্থায়ী ঠান্ডা লড়াইয়ের সূচনা করে। এই যুদ্ধের বৈশিষ্ট্যগুলি হল :- ১৷ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত রাশিয়ার নেতৃত্বে দুটি শিবিরের সংঘাত, ২। সশস্ত্র যুদ্ধ এড়িয়ে যাওয়া এবং ৩৷ সংঘাতের ভিত্তি আদর্শগত উপাদান দ্বারা গঠিত। 


 কোন একটি নির্দিষ্ট কারনে ঠান্ডা লড়াই সংঘটিত হয় নি। আদর্শবাদের বিভিন্নতা, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক প্রভৃতি বিভিন্ন কারণ ঠান্ডা যুদ্ধের পিছনে জড়িত ছিল। 


অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন, আদর্শগত সংঘাত থেকে ঠান্ডা লড়াইয়ের সূচনা হয়। তারা মনে করেন, এ লড়াই ছিল আসলে সমাজতন্ত্রী সোভিয়েত রাশিয়ার সাথে পশ্চিমী রাষ্ট্র-বর্ণের আদর্শগত লড়াই। প্রকৃতপক্ষে ১৯১৭খ্রিঃ রুশ বিপ্লবের পর-ই সোভিয়েত রাশিয়া সম্পর্কে পশ্চিমী রাষ্ট্রগুলির মধ্যে নানা রকম সন্দেহ ও বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। এই মনোভাব অপরিবর্তিত থাকে। পশ্চিমী- দুনিয়ার কাছে সাম্যবাদের ভয়ঙ্কর ছবি ঠান্ডা লড়াইয়ের আবহাওয়া সৃষ্টি করে।



মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সচিব হাল -এর মতে, ঠান্ডা লড়াই একটি অর্থনৈতিক বিরোধ। তাঁর মতে, দ্বিতীয় বিশ্ব-যুদ্ধের পর মার্কিন অর্থনৈতিক কাঠামোর বৈশিষ্টা হিসাবে দেখা দেয়, বিশ্বে পুঁজি বিনিয়োগে নতুন বাজার সৃষ্টি। এই উদ্দেশ্যে ইউরোপে ফাসীবাদ ধূৎস করে সেখানে মার্কিন অর্থনৈতিক সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ইতিমধ্যে ইউরোপে সমাজ -তান্ত্রিক ভাবধারা ছড়িয়ে পড়ায় সোভিয়েত রাশিয়ার সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঠান্ডা লড়াই শুরু হয়। 


রাশিয়ার উপর জার্মানীর আক্রমনের চাপ হ্রাস করতে রাশিয়া জার্মানীর বিরুদ্ধে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর দ্বিতীয় যুদ্ধক্ষেত্র খোলার প্রস্তাব দেয়। কিন্তু মিত্রশক্তি এ প্রস্তাব গ্রহন করেন নি। পরে রাশিয়া নিজ শক্তিতে জার্মানীকে পর্যদন্ত করলে দ্বিতীয় যুদ্ধক্ষেত্র তৈরী হয়। ইহা পশ্চিমী শক্তির উদ্দেশ্য সম্পর্কে রাশিয়ার মনে একটা গভীর সন্দেহের সৃষ্টি করে। ১৯৪৫খ্রিঃ আমেরিকা জাপানে পরমানু বোমা নিক্ষেপ করলে রাশিয়া আতঙ্কিত হয়ে ওঠে। এজন্য আলিন দক্ষিন-পূর্ব ইউরোপে প্রভাব বিস্তারে উদ্যোগী হলে সূচনা হয় ঠান্ডা লড়াইয়ের।




 দ্বিতীয় বিশ্ব-যুদ্ধের পরবর্তীকালে দুই বৃহৎ শক্তির প্রতিদ্বন্দ্বিতার প্রেক্ষিতে ইউরোপে যে ঠান্ডা লড়াইয়ের সূত্রপাত হয়, তা অচিরেই সমগ্র আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে প্রবলভাবে প্রভাবিত করে। সেই প্রভাবের ক্ষেত্র কেবল রাজনীতিতেই সীমাবদ্ধ ছিল না, সমাজ, সংস্কৃতি, অর্থনীতি প্রভৃতি সমস্ত কিছুকেই প্রভাবিত করেছিল।



 ঠান্ডা লড়াই দ্বি-মেরুকরণ রাজনীতির সৃষ্টি করেছিল। অর্থাৎ যুদ্ধ পরবর্তীকালে বিশ্বে যে দুটি মহাশক্তির তথা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত রাশিয়ার বিকাশ ঘটেছিল, তাতে অন্য কোনো শক্তির ভূমিকা মোটেই গুরুত্বপূর্ন ছিল না। এই উভয় শক্তিকে কেন্দ্র করেই পরবর্তীকালে অর্থনীতি ও সামরিক দুনিয়া দু-ভাগে ভাগ হয়ে যায়।



দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়ে যাবার পর দুই মহাশক্তির মধ্যে কোনো যুদ্ধ বাধেনি, কিন্তু ঠান্ডা লড়াইয়ের প্রভাবে বিভিন্ন দেশের মধ্যে প্রায়শই যুদ্ধ লেগেই ছিল। যেমন- কোরিয়ার যুদ্ধ, ভিয়েতনামের যুদ্ধ প্রভৃতি যুদ্ধ ঠান্ডা লড়াইয়েরই



ঠান্ডা লড়াইয়ের একটি অনুষঙ্গ ছিল বৃহৎ শক্তিবর্গের আঞ্চলিক সামরিক জোট গড়ে তোলা। ঐসব সামরিক জোটগঠন বিশ্ব-শান্তির পক্ষে কখনোই বাঞ্ছনীয় ছিল না। এগুলি একদিকে যেমন উষ্ণ যজ্ঞের আশঙ্কাকে জিইয়ে রেখেছিল, তেমনি অনাদিকে জাতিপুঞ্জের গুরুত্বকে বহুলাংশে হ্রাস করেছিল। এছাড়া ঠান্ডা লড়াইয়ের প্রভাবে বিশ্বে পারমাণবিক যুদ্ধের আশঙ্কা ভয়াবহ আকার ধারন করেছিল।




ঠান্ডা লড়াইয়ের আবর্ত থেকেই জন্ম নিয়েছিল তৃতীয় বিশ্বের ধারনা। এজন্য সদ্য স্বাধীনতা প্রাপ্ত তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলি স্বাভাবিকভাবেই নিজেদের ঠান্ডা লড়াইয়ের আবর্তে শামিল করতে চায়নি। তবুও এসময় তৃতীয় বিভিন্ন দেশের মধ্যে যে সংঘর্ষ ঘটেছিল, তার পিছনে বহু ক্ষেত্রেই ঠান্ডা লড়াইয়ের ভূমিকা ছিল। 




ঠান্ডা লড়াইয়ের প্রভাবেই বিশ্বে জন্য নিয়েছিল জোটনিরপেক্ষতা। এই নীতি হল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা সোভিয়েত রাশিয়া কোনো জোটের সাথেই নিজেদের যুক্ত না করা। অর্থাৎ কী গণতান্ত্রিক ধনতন্ত্রবাদের জোট, কী সমাজতান্ত্রিক শিবির -উভয়ের থেকেই সমদূরত্ব বজায় রাখা।




ঠান্ডা লড়াই প্রত্যেক দেশকে নিজ নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে আধুনিক সমরাস্ত্র সংগ্রহ করার প্রতিযোগিতায় নামিয়েছিল। ফলে তাদের প্রতিরক্ষা ব্যয় প্রবলভাবে বেড়ে যায়। এজনা প্রতিটি দেশেরই আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা প্রবলভাবে ব্যহত হয়।






দ্বিতীয় বিশ্ব-যুদ্ধের পর হতে উনবিংশ শতকের নবম দশক পর্যন্ত এই ঠান্ডা লড়াই চলছিল মার্কিন-সোভিয়েত শিবিরের মধ্যে। অবশেষে সোভিয়েত রাশিয়া ভেঙে গেলে এই ঠান্ডা যুদ্ধের অবসান ঘটে। ঠান্ডা লড়াই ছিল মূলত আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত রাশিয়ার মধ্যেকার দ্বন্দ্ব যা বিশ্বের অধিকাংশ দেশগুলিকেই প্রভাবিত করেছিল। 

About the author

Irisha Tania
"আমি সেই মেয়ে, যে শব্দে বাঁচে। কলম আমার অস্ত্র, আর কাগজ আমার স্বপ্নের আকাশ। প্রতিটি অনুভব, প্রতিটি চিন্তা আমি সাজিয়ে রাখি অক্ষরের গাঁথুনিতে। কখনো গল্পে, কখনো কবিতায়, আবার কখনো নিঃশব্দের ভেতরে। আমি লিখি, কারণ লেখার মাঝে আমি নিজেকে খুঁজে পাই। …

Post a Comment

🌟 Attention, Valued Community Members! 🌟