বিশ্বায়ন বলতে কী বোঝ? সমকালীন অর্থনীতির উপর বিশ্বায়ণের প্রস্তাব লেখো।
বর্তমানে উদারীকরণ, বেসরকারীকরণ এবং বিশ্বায়ণ কথাগুলি আন্তর্জাতিক অর্থনীতির ক্ষেত্রে অত্যন্ত পরিচিত। অধ্যাপক অমিয়কুমার বাগচী বলেছেন, বিশ্বায়ণ কথাটি বিভিন্ন অর্থে এবং বিভিন্ন প্রসঙ্গে ব্যবহৃত হওয়ায় এর কোনো সর্বজন গ্রাহ্য সংজ্ঞা তৈরীর চেষ্টা পন্ডশ্রম মাত্র। রাজনীতি, অর্থনীতি, ধর্ম, সংস্কৃতি, জ্ঞান-বিজ্ঞান সমস্তন্ত ক্ষেত্রেই বিশ্বায়ণের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। বিশ্বায়ণ হল দেশীয় সীমানার উর্দ্ধে শিল্প-কর্পোরেশনের প্রসারতা এবং আন্তসীমা ভিত্তিক অর্থনৈতিক সুবিধা ও সম্পর্কের এক সংযুক্ত প্রক্রিয়া, যা ক্রমাগত পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে দ্রুত পরিণতি লাভ করেছে।
বৈষয়িক ক্ষেত্রে বিশ্বারণ কথাটি দুটি ভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়- ক) বিশ্বায়ণ একটি জগৎ ব্যাপী প্রক্রিয়া সমষ্টি। খ) বিশ্বায়ন হল কতকগুলি নির্দিষ্ট আর্থিক বা বৈষয়িক নীতির সমাহার, যে নীতিগুলি গ্রহন করলে বিশ্বায়ণের প্রক্রিয়া তরান্বিত হতে পারে।
বিশ্বায়ণ বলতে বোঝায়, বিশ্বব্যাপী তথ্য-প্রযুক্তির অগ্রগতি, বিমানপথে মাল পরিবহনের বহুল প্রচলন, টাকার বাজারে ফাটকাবাজি, দেশের সীমানা পেরিয়ে ক্রমবর্ধমান পুজি প্রবাহ, কেবল চ্যানেলের প্রসার, গণ-বিপনন, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং, বহুজাতিক কর্পোরেটের শক্তি বৃদ্ধি, নতুন আন্তর্জাতিক শ্রম-বিভাজন, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে শ্রমের অবাধ চলাচল, উত্তর আধুনিকতা প্রভৃতি।
বিশ্বায়ণের বৈশিষ্ট্যঃ সাম্প্রতিক বিশ্বায়ণ প্রক্রিয়ার পাঁচটি বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়- ক) আন্তর্জাতিকভাবে অর্থনৈতিক লেনদেন প্রক্রিয়ার দ্রুত বিকাশ, খ) বানিজ্য তথা বহুজাতিক কর্পোরেশনগুলির দ্রুত অগ্রগতি, গ) সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগের ব্যাপকতা, ঘ) বিশ্বব্যাপী যাতায়াত ও যোগাযোগের উন্নতি এবং ও) ভাবধারা আদান-প্রদানের ক্ষেত্রে প্রযুক্তিগত উন্নতি।।
বর্তমানে বিশ্বায়ণের দুটি প্রকিয়া সুস্পষ্টভাবে পরিলক্ষিত হয়- উৎপাদনের বিশ্বায়ন এবং ভাগ্নিপুজির বিশ্বায়ন। ১৯৮০ সাল থেকে উৎপাদন প্রক্রিয়ার ভূত বিশ্বায়ন লক্ষ্য করা যায়। যেমন- ক) বিশ্ব-ব্যাঙ্ক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা ভান্ডার যে কাঠামোগত পুনর্বিন্যাস কর্মসূচী তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির ওপর চাপিয়ে দেয়, তার ফলে এই প্রক্রিয়া জোরদার হয়। খ) বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে গ্যাটের মাধ্যমে যে সব চুক্তি সম্পাদিত হয় এবং যা পরে বিশ্ববাণিজ্য সংস্থায় চূড়ান্ত পরিণতি লাভ করে, সেই চুক্তিগুলি বিশ্বাষণ প্রক্রিয়াকে তেজি করে তোলে। গ) সমস্ত প্রক্রিয়ার পেছনে চালিকা শক্তি হিসাবে বহুজাতিক কর্পোরেশনগুলি কাজ করে। ঘ) তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির আত্মনির্ভর শিল্পের ক্ষতি হয় এবং ঐ দেশে বেকার বৃদ্ধি পায়।
পৃথিবীর অর্থনৈতিক চিত্রও বড়ো করুণ। পৃথিবীর প্রায় ৮০% সম্পদ দখল করে আছে ১০০ কোটি মানুষ এবং তারা মাত্র কয়েকটি দেশে বাস করে। এমন অবস্থায় 'মেধাস্বত্ব'-র চুক্তি ট্রিপসের করলে চলে গেছে। ফলে ভারতের মতো দেশের কৃষি গবেষণাগার থেকে অনেকগুলি সংস্থা বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার দখলে। চলে গেছে। এজন্য বিপুল অর্থনৈতিক ক্ষতি স্বীকার করতে হবে ভারতকে। গবেষকরা। অনুমান করেছেন, গবেষণাক্ষেত্রের এই ক্ষতির প্রভাব পরেছে ২০০৫ সাল থেকে। বাজারদর এখন আকাশচুম্বী।
এর সাথে দেশে খোলাবাজার অর্থনীতির সুযোগ নিয়ে বিদেশী দ্রব্য বাজার ছেয়ে ফেলছে। আপাতত উন্নতমানের জিনিস কম দামে বিক্রি করে স্থানীয় বাজার থেকে দেশি জিনিস হঠিয়ে দেবার কাজ শুরু হয়েছে। তৃতীয় বিশ্বের উৎপাদনকারীরা আজ বিরাট চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছেন। মার্কিন ও চায়না পণ্য বাজার ছেয়ে ফেলেছে। অপেক্ষাকৃত কম দামে সেসব পণ্য বিক্রি হচ্ছে বাজরে। সব মিলিয়ে জাতীয় অর্থনীতি স্বাতন্ত্র্য হারিয়ে ফেলে এক আগ্রাসী ব্যবস্থার মুখে বেসামাল অবস্থায় উপনীত হয়েছে।