১৯৪৭-৬৪ সালের কাশ্মীর সমস্যার বিশেষ উল্লেখসহ ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক আলোচনা করো।
ভারতবর্ষ স্বাধীনতার আগে ও পরে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক ব্যাপারে মতামত প্রকাশ করেছিল। স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী পন্ডিত জহরলাল নেহরু এই ঐতিহাসিক ঐতিহ্য রক্ষা করে চলেন। তাঁর প্রধানমন্ত্রীকালে ভারত বিশেষ করে প্রতিবেশী রাজাগুলির সাথে সমস্যা মেটানোর পক্ষে উদগ্রীব ছিল। সেজনা নেহরু নেপাল, ব্রহ্মদেশ তথা মায়ানমার, শ্রীলঙ্কা প্রভৃতি দেশের সাথে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখেছিলেন। কেবলমাত্র দুটি প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তান ও চীনের সাথে নেহরুর আন্তরিকতা থাকা সত্ত্বেও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক নষ্ট হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত এই দুই দেশের সাথে সম্পর্ক যুদ্ধ ডেকে আনে।
ভারতের নেতারা আশা করেছিলেন যে, ভারত বিভাজনের পর আর তাঁদের পাকিস্তানের বৈরীমূলক মনোভাবের সম্মুখীন হতে হবে না। কিন্তু দুঃখের বিষয় ভারত ব্যবচ্ছেদের অতি অল্প দিনের মধ্যেই পাকিস্তান কাশশ্মীর আক্রমণ করেছিল (অক্টোবর, ১৯৪৭)।
কাশ্মীর সমস্যার অন্ততম কারণ। হল মহারাজ হরি সিং-এর দ্বিধাগ্রস্ত মনোভাব। তিনি ভারতের সাথে যুক্ত হওয়ার ব্যাপারে প্রায় এক বছর সময় নষ্ট করেন। ইতিমধ্যে পাকিস্তানে গণভোটে যাওয়ার প্রস্তাব মেনে নিলেও তার আশঙ্কা ছিল যে ভোটে কাশ্মীরের জনগণ ভারতের অন্তর্ভুক্ত হতে চাইবে। অপর একটি কারণ হল কাশ্মীরে শেখ আবদুল্লার দল ন্যাশনাল কনফারেন্সের সাথে নেহরু ও কংগ্রেসের সম্পর্ক ভাল ছিল। সুতরাং পাকিস্তান দোটানায় পড়ে সীমান্ত প্রদেশ থেকে উপজাতীয়দের কাশ্মীর আক্রমণে উস্কে দিয়েছিল। এরূপ এক সংকটময় মুহুর্তে হরি সিং ইনস্ট্রুমেন্ট অব অ্যাকসেশন-এ সাক্ষর করেন।
হরি সিং-এর সাক্ষরের পর কাশ্মীর ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশরূপে পরিগণিত হয়। কিন্তু পাকিস্তানের হানাদারবাহিনীরা তাদের দখলীকৃত অঞ্চল ত্যাগ করতে রাজি ছিল না। এই বিষয়টি জাতিপুঞ্জে পাঠানো হয়। জাতিপুঞ্জের হস্তক্ষেপে যুদ্ধবিরতি ঘোষিত হয়। ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আগ্রাসনের অভিযোগ এনেছিল। জাতিপুঞ্জে ভারত কাশ্মীর সমস্যা নিয়ে ঠান্ডা লড়াইয়ের আবর্তে পড়ে যায়। কারণ ভারত বিভাগের পরেও পশ্চিমী শক্তিবর্গ বিশেষ করে ব্রিটিশরা পাকিস্তানকে সমর্থন করে চলেছিল এবং কংগ্রেস ও ভারতের প্রতি তাদের না-পসন্দ নীতি জারী ছিল। পরিস্থিতি ভারতের অনুকূলে থাকায় ভারত কাশ্মীরের ক্ষেত্রে গণভোট মেনে নিয়েছিল।
গণভোট ও যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব মেনে নেওয়ার জন্য নেহেরুকে অনেক সমালোচনার সম্মুখীন হতে হয়। গণভোটের পূর্বে দুটি শর্ত আরোপ করা হয়। প্রথমতঃ পাকিস্তান জন্ম ও কাশ্মীর থেকে তাদের সেনা সরিয়ে নেবে। দ্বিতীয়তঃ কাশ্মীরের সমগ্র অঞ্চলকে শ্রীনগর সরকারের শাসনাধীনে রেখে দিতে হবে। কিন্তু পাকিস্তান এই শর্ত পূরণ করেনি। আর কাশ্মীরের সংবিধানসভা ভারতের সাথে অন্তর্ভুক্তির পক্ষে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিল। এর পর কাশ্মীর সাধারণ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। সুতরাং গণভোটের প্রস্তাব অর্থহীণ হয়ে পড়েছিল।
১৯৫৩-৫৪ সালে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্কের উন্নতির ক্ষেত্রে কাশ্মীর সমস্যার সমাধানের আশা দেখা গিয়েছিল। পাক- প্রধানমন্ত্রী বোগরা ও নেহরুর এক যৌথ বিবৃতি প্রকাশিত হয়। এতে বলা হয়েছিল যে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নেহরু শেষ পর্যন্ত কাশ্মীরে গণভোট করতে রাজী হয়েছেন। ইতিমধ্যে কোরিয়ার ব্যাপারে অমেরিকা ভারতের ভূমিকাকে হেয় করে। তারা ভারতের জোটনিরপেক্ষ নীতি গ্রহণ করেনি। ফলে আমেরিকা পাকিস্তানকে অস্ত্র সাহায্য করতে থাকে। ফলে ভারত ও পাকিস্তানের সাথে বিবাদের মীমাংসার আর কোনো সম্ভাবনা রইল না।
ভারতের ওপর চাপ সৃষ্টি করার জন্য পাকিস্তান বাগদাদ, বাগদাদ, সিয়াটো, সেনটো প্রভৃতি চুক্তিতে সাক্ষর করেছিল। এইসব সংগঠিত সংঘগুলি আমেরিকার তাঁবেদার রাষ্ট্রগুলি নিয়ে গঠন করা হয়েছিল। কিন্তু ভারত নেহরুর নেতৃত্বে ঠান্ডা লড়াই থেকে নিজেকে দূরে রেখেছিল। কোরিয়াকে কেন্দ্র করে সাম্রাজ্যবাদের যে লড়াই শুরু হয়েছিল তা থেকে ভারত নিজেকে দূরে রেখেছিল। সুতরাং এরূপ পরিস্থিতিতে কাশ্মীর সমস্যার সমাধান হওয়া সম্ভব ছিল ন। এর ফলে ১৯৫৬ সালের পর জাতিপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদে পাকিস্তান আমেরিকার সহযোগিতায় কাশ্মীর সংক্রান্ত বিবাদের কথা তুললেই সোভিয়েত ইউনিয়ন তার 'ভেটো' প্রয়োগের দ্বারা ভারতকে সমর্থন করেছিল। এভাবে ভারত কাশশ্মীর সমস্যার সমাধানের বিষয়ে আন্তর্জাতিক চাপ প্রতিহত করতে সক্ষম হয়েছিল।
দুর্ভাগ্যবশত তিব্বতের ঘটনাকে কেন্দ্র করে চীনের সাথে ভারতের সম্পর্ক তিক্ত হয়। চীন ১৯৬২ সালে ভারত আক্রমণ করে। নেহেরু চীনের এই পদক্ষেপে অসহায় বোধ করেন। ফলে ১৯৬২ সালে চীনের ভারত আক্রমণ নেহেরু তথা ভারতকে ব্রিটেন ও আমেরিকার সাহায্য নিতে বাধ্য করেছিল। ইতিমধ্যে ভারতের অসুবিধাজনক অবস্থার সুযোগও পাকিস্তান নেবার চেষ্টা করে। এমনকি সোভিয়েত ইউনিয়ন পাকিস্তান ও চিনের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিল। তবে অচিরেই ভুল বুঝতে পেরে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভারতের পাশেই দাঁড়ায়।
নেহেরু পাকিস্তানের প্রতি অনেকক্ষেত্রেই উদারত দেখিয়েছিলেন। পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে সাংস্কৃতিক দিক থেকে অনেক মিল ছিল। তথাপি এই তিক্ত সম্পর্কে জন্য কাশ্মীর বহুলাংশে দায়ী ছিল। যদিও এটি একমাত্র বিষয় ছিল না। কারণ নেহেরু দেশ-বিভাগজনিত বিভিন্ন সমস্যার সমাধানের জনা পাকিস্তানের প্রতি নানা দিক থেকে উদারনীতি অনুসরণ করেছিলেন। আর্থিক বিষয়, সিন্ধু-নদের জল-বণ্টন প্রভৃতি ব্যাপারে নেহেরু সরকার পাকিস্তানের প্রতি উদারতা দেখিয়েছিল। তা সত্ত্বেও পাকিস্তান ভারত আক্রমণ করেছিল।
নেহেরু পাকিস্তানকে দেশবিভাগের ফলে সম্পত্তির মূল্যবাবদ দেয় অর্থ পাঠানো বন্ধ করে দেন। গান্ধীজী আপত্তি করলে তাঁকে জানানো হয় পাকিস্তান সেই অর্থ ভারত আক্রমণের কাজে ব্যবহার করছিল। তথাপি গান্ধীজী কাশ্মীরে ভারত যে পূর্ণ নিরাপত্তা ও সুরক্ষার ব্যবস্থা নিয়েছিল তাতে সম্মতি দিয়েছিলেন। নেহেরু ১৯৫২-৬৪ সাল পর্যন্ত ভারতের প্রধানমন্ত্রী পদে আসীন ছিলেন। এই সময় তাঁকে দেশের বিভিন্ন অভ্যন্তরীণ সমস্যা সামলাতে হয়েছিল। এছাড়াও পাকিস্তান ও চীন আক্রমণ তাঁকে বিব্রত করেছিল। তথাপি তিনি পাকিস্তানের সাথে আন্তর্জাতিক নিয়মানুযায়ী সম্পর্ক বজায় রেখেছিলেন। কিন্তু তাঁর উদারনীতির যথাযোগ্য সম্মান পাকিস্তান দেয়নি। জোটনিরপেক্ষ নীতির রূপায়ন ও প্রণয়নের ক্ষেত্রে নেহরুকে অনেক বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। তথাপি তিনি এ ব্যাপারে ঠান্ডা লড়াই থেকে ভারতকে দূরে রেখেছিলেন। তবে একথা অনস্বীকার্য যে পাকিস্তানের সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে কাশ্মীর সমস্যা তাঁকে বিশেষভাবে বিব্রত করেছিল। নেহেরুর উদারনীতিকে পাকিস্তান ভারতের দুর্বলতা ভেবে ভুল করেছিল।