জাপানের ইতিহাসে শোগুনতন্তের পতনের কারণগুলি তুমি কিভাবে ব্যাখ্যা করবে?
জাপানের ইতিহাসে সামন্তযুগ । মধ্যযুগের স্থায়িত্বকাল ছিল ১১৯২ খৃষ্টাব্দ থেকে ১৮৬৭ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত। এ যুগ শোগুন শাসনের যুগ নামেই সমধিক প্রসিদ্ধ। সর্বপ্রথম শোগুন ছিলেন মিনামিটো জোরিটোমো এবং সর্বশেষ শোগুন কেইকি (Keiki) বা জোশিনোবু। সর্বশেষ শোগুনবংশ ছিল টোকুগাওয়া বংশ। ১৬০৩-১৮৬৭), যোশিনোহ্, ছিলেন টোকুগাওয়া বংলের সর্বশেষ প্রতিনিধি। তাঁর পদত্যাগের সঙ্গে সঙ্গে শোগুন শাসনের অবসান ঘটে। এই অবসানের কারণ কি?
শোগুনশাসনের পতনের কারণ বিশ্লেষণে জাপানী ইতিহাসে অভিজ্ঞ ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতপার্থক্য দেখা যায়। G. C. Allen, Sir George Sansom এবং W. Elliot Griffis-এর মতে আভ্যন্তরীণ দুর্নীতি ও দুরবস্থা শোগুনে ঘুষ্ঠের অবসানের প্রধ ন কারণ। Allen অর্থনৈতিক সঙ্কটকেই প্রধান কারণ হিসাবে ব্যাখ্য্য করেছেন। দ্ব্যর্থহীন ভাষায় তিনি এই অভিমত প্রকাশ করেছেন যে বিদেশী শক্তিবর্গের জাপানের বন্দরে প্রবেশ লাভ এবং ফলে জাপানের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক' স্থাপন শোগুন শাসন-পতনের প্রধান বা মুখ্য কারণ, একথা ঠিক নয়। তাঁর মতে এই বাণিজ্যিক সম্পর্ক' স্থাপন এবং তজ্জনিত বৈহেশিক চাপ সৃষ্টি একটি অপ্রধান বা গৌণ কারণ মান্ত্র ছিল। মেজী যুগের অন্যতম প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ Prince Matsukataয় উত্তি উল্লেখ ক'রে Allen অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলাকেই মুখ্য কারণ হিসাবে গণ্য করেছেন। ৩৭Sir George Sansom-এর মতে আভ্যন্তরীণ বিস্ফোরণই ছিল প্রধান কারণ, বিদেশী চাপ নয়। ৩৬ এই আভ্যন্তরীণ বিস্ফোরণ বিশ্লেষণ-প্রসঙ্গে স্যানসম৩৭লিখেছেন যে সমগ্র জাপান তখন অশান্তির পুরী। সম্ভ্রান্ত, অসম্ভ্রান্ত সকল সম্প্রদায়ের কাছেই যেন শোগুন শাসন অসহ্য হয়ে উঠেছে। ডাইমিয়ো, সামুরাই, বণিক, কৃষক, শিক্ষাবিদ-সকলেই তখন 'বক্ষুদ্ধ, পরিবর্ত'নমুখী এবং জাপানের বন্ধ দরজা উন্মুক্ত ক'রে বহির্বিশ্বের সঙ্গে নূতনভাবে সম্পর্ক'-স্থাপনে অধীর আগ্রহী। এই পশ্চিম-মুখী দরজা উম্মোচনের প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় শোগুন-শাসনের অবসানে।৩৮ গ্রিফিসের মতে বিদেশী এবং বৈদেশিক চিন্তাধারা ছিল দ্বৈতশাসনের পতনের উপলক্ষ মাত্র, প্রকৃত কারণ নয়। যা পূর্বেই অনিবার্য' হয়ে ওঠে বৈদেশিক চাপ তা ত্বরান্বিত করে মাত্র। আসল কারণ আভ্যন্তরীণ, বাহ্যিক নয়। Reischauer কিন্তু আভ্যন্তরীণ বিস্ফোরণকে মুখ্য কারণ হিসাবে গণ্য করেন না। তাঁর মতে বহির্বিশ্বের চাপই পতনের প্রকৃত কারণ। পেরীর অভিযান না ঘটলে শোগুন-শাসন আরও শতবর্ষ স্থায়ী হ'তে পারত বলে তিনি অভিমত প্রকাশ করেছেন। অর্থনৈতিক সঙ্কটকে তিনি ঋতনের কারণ হিসাবে গুরুত্ব দেন নি। তাঁর মতে যদি অর্থনৈতিক সঙ্কটই পতনের প্রকৃত কারণ হত তাহলে অষ্টাদশ শতকেই শোগুন শাসনের অবসান ঘটত, কারণ ঐ সময় জাপানের অর্থনৈতিক অবস্থায় গুরুতর অবনতি ঘটে। ঊনবিংশ শতকের মধ্যভাগে আর্থিক অবস্থার অধিকতর অবনতি ঘটে নি, অথচ উনবিংশ শতকের মধ্যভাগ নাগাদ শোগুন শাসনের অবসান আসন্ন হয়ে ওঠে। সে ক্ষেত্রে তাঁর মতে পতনের অন্য কোন কারণ ছিল-তা ছিল বৈদেশিক চাপ। ৩৯ Allen-এর গবেষণা-প্রসূত সিদ্ধান্ত হচ্ছে অষ্টাদশ শতকে নয়, ঊনবিংশ শতকেই জাপান গুরুতর অর্থনৈতিক সঙ্কটের সম্ম, খাঁন হয়।
আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ঐতিহাসিক আরনোল্ড টয়েনবি (Arnold Toynbee) সভ্যতার সঙ্কটের তিনটি প্রধান লক্ষণ যা কারণের উপর গুরুত্ব দিয়েছেন, যথা (১) সংখ্যাম্প সম্প্রদায়ের মধ্যে অর্থাৎ শাসকশ্রেণীর মধ্যে সৃজনী-শন্তির অভাব, (২) সংখ্যাগরিষ্ঠের অর্থাৎ শাসিত শ্রেণীর শাসক শ্রেণীর প্রতি আনুগত্যের তথা অনুকরণ-প্রবণতার অভাব এবং (৩) সামাজিক একতার অভাব। এই তিনটি কারণে যখন কোন সভ্যতা বিনষ্ট হয় তখন বুঝতে হবে সভ্যতা আত্মঘাতী হয়েছে। যেহেতু এই লক্ষণগুলি আভ্যন্তরীণ, সেইজন্য টয়েনষি মনে করেন যে, আভ্যন্তরীণ কারণেই সাধারণতঃ সভ্যতা তথা সাম্রাজ্যের ধ্বংসের পথ প্রশস্ত হয়। তিনি বহিরাক্রমণের প্রতিক্রিয়াও চিন্তা করেছেন। এই বহিরাক্রমণ হচ্ছে তাঁর ভাষায় 'murder' (হত্যা) স্বরূপ। তবে 'murder' অপেক্ষা আত্মহত্যাকেই তিনি প্রাধান্য দিয়েছেন সভ্যতার বিনাশের হেতু হিসাবে। তাঁর ভাষায় 'Civilizations perish through suicide, not by murder.' আভ্যন্তরীণ দুর্নীতি ও কুশাসন পরিণতি লাভ করে এক মারাত্মক বিস্ফোরণে। সেই সুযোগে বহির্শত যে আঘাত হানে তার প্রত্যক্ষ ফল সভ্যতা বা সাম্রাজ্যের বিনাশ। টয়েনবি সভ্যতার সঙ্কটের যে তিনটি কারণ উল্লেখ করেছেন সেগুলি টোকুগাওয়া সভ্যতার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। ঊনবিংশ শতকের শোগুন শাসকেরা সৃজনীশক্তিবিহীন ছিলেন। তাঁদের ক্ষমতার উৎস ছিল শুধুমাত্র সামরিক শক্তি। সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায় অর্থাৎ কৃষকশ্রেণী শোগুন সরকারের প্রতি আস্থাবান বা অনুগত ছিল না। তৎকালীন জাপানী সমাজে অর্থনৈতিক বৈষম্য প্রকট হওয়ায় একতার অভাব ঘটেছিল। কাজেই আভ্যন্তরীণ বিস্ফোরণ টোকুাগাওয়া শাসনকে পরিণামে পতনোন্মুখ করে তোলে। শোগুন সভ্যতা মূলতঃ হয় আত্মঘাতী। Challengeএর তুলনায় Response যথোপযুক্ত না হওয়ায় এই আত্মহত্যার পথ সুগম হয়ে ওঠে।
মোট কথা, আভ্যন্তরীণ দুর্নীতি-প্রসূত বিস্ফোরণ এবং বহিচাপ-এই কারণদ্বয় মিলিতভাবে শোগুন শাসনের পতন ঘটায়। আভ্যন্তরীণ অবস্থা ও বাঁহচাপুের বিস্তৃত আলোচনা নিম্নে প্রদত্ত হল।
শোগুন শাসকেরা চীন থেকে আগত বৌদ্ধধর্মে' বিশ্বাসী ছিলেন এবং কৌলাম'কেই রাষ্ট্রীয় ধর্ম' হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। সাধারণ মানুষ কিন্তু জাপানের নিজস্ব ধর্ম' শিস্টোর প্রতি আসক্ত ছিলেন এবং দীর্ঘকাল ধরে শিস্টোকেই রাষ্ট্রীয় ধর্মে'র মর্যাদা দিতে আগ্রহী ছিলেন। শিস্টো ধর্মানুযায়ী সম্ভাটই হচ্ছেন দেশের প্রকৃত শাসক। অথচ শোগুনই কার্যতঃ সর্বময় কর্তৃত্বের অধিকারী হয়ে বিরাজমান ছিলেন। কাজেই জনসাধারণের চক্ষে শোগুন শাসনের কোন ধর্মগত বা ন্যায়সঙ্গত ভিত্তি ছিল না। শোগুন অবৈধভাষে সম্রাটের ক্ষমতা অপহরণ করেছেন-এই চিন্তা জনগণকে শোগুন বিরোধী ক'রে তোলে। ফলে জনগণ সম্ভাটের অপহৃত ক্ষমতার পুনরুদ্ধারের জন্য আন্দোলনের পথে পা বাড়ায়। আন্দোলনকারীদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন অষ্টাদশ শতকের প্রচারক প্রখ্যাত নোবুনাগা মোটুরি (Nobunaga Motoori)। তিনি জাপানের জাতীয় জীবনে চৈনিক ও বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাব বর্জ'ন ক'রে প্রাচীন জাপানী ভাবধারা এবং শিল্টো ধর্মের পুনঃপ্রতিষ্ঠার উপর গুরুত্ব আরোপ করেন। শোগুন-বিরোধী আন্দোলনের শেষ পর্যায়ে শোগুন-বিরোধী Sonno jo-i শ্লোগান জনপ্রিয় হয় মোটুরির-ই প্রচারকার্যের ফলে ।
শোগুন-শাসনের ইতিহাস আলোচনা করলে দেখা যায় যে শোগুন-শাসকেরা ক্রমশঃ আরামপ্রিয় এবং শাসনকার্যে উদাসীন হয়ে ওঠেন, যেমন মুঘল সম্রাট ঔরঙ্গজেবের পরবর্তী সম্রাটেরা জীবনে বিলাসিতাকে প্রাধান্য দিয়ে শাসনে অপটু হয়ে উঠেছিলেন। প্রথম তিনজন শোগুন-ইয়েয়াস, হিদেতদ এবং ইয়েমিটস,- অবশ্য জাপানের মধ্যযুগের ইতিহাসে শক্তিশালী শাসকহিসাবেই সুপরিচিত। কিন্তু পরবর্তী' শোগুনেরা ধীরে ধীরে শক্তিহীন হয়ে পড়েন। পরবর্তী চারজন শোগুন ইস্তেমুনা, সুনায়োশি, ইয়েনো এবং ইয়েতসুগু -পূর্ববর্তী শাসকদের মত ততটা দক্ষ ছিলেন না। তাঁরা তাঁদের অনুগত কর্মচারীদের উপর শাসনের দায়িত্ব অর্পণ ক'রে নিজেরা নিশ্চিন্তমনে আরামে কালাতিপাত করতেন। তাঁদের এই অবস্থা অনেকটা ছিল 'বোতাম-আঁটা জামার নীচে শাস্তিতে শয়ান' অবস্থার অনুরূপ। ১৬৮৪ খৃষ্টাব্দে শোগুন কাউন্সিল সভার প্রবীণ সদস্য হোট্টা মাসাটোশির হত্যার পর শোগুন সুনাযোশি শাসনকার্য' থেকে একেবারে হাত গুটিয়ে নিয়ে তাঁরই আস্থাভাজন, প্রধান কন্তুকী ইয়ানাগিজাওরা যোশিযাসুকে দেশ শাসনের সম্পূর্ণ দায়িত্ব দেন। শাসনকার্যে' বিমুখ শোগুন ক্রমশঃ মনোনিবেশ করেন সাংস্কৃতিক চর্চায় এবং বৌদ্ধধর্মাচরণের শাস্ত্রীয় পদ্ধতিতে। সুনাযোশির শাসনকালে প্রশাসনিক শিথিলতা এবং অনিয়ন্ত্রিত অর্থব্যয় দেশে সর্বপ্রথম সঙ্কটের সৃষ্টি করে-প্রশাসনিক সঙ্কট তথা অর্থনৈতিক সঙ্কট। এমন কি তখন মুদ্রার মূল হ্রাসেরও প্রয়োজন হয়। অষ্টম শোগুন হিসাবে এডো প্রাসাদে অধিষ্ঠিত হন যোশিমুনে । তিনি অবশ্য দেশ-শাসনে কিছুটা সংস্কার সাধনে প্রয়াসী হন এবং বজ্রমুষ্ঠিতে শাসনভার গ্রহণ করেন। দেশ তখন অতীব অর্থনৈতিক সঙ্কটের কবলে। তাই তিনি আর্থিক অবস্থার উন্নতি সাধ'ন এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে সংস্কার সাধনে আত্মনিয়োগ করেন। তাঁর প্রবর্তিত সংস্কার কার্যের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল প্রশাসনিক ব্যয়-সঙ্কোচ, ব্যবসা-নিয়ন্ত্রণ, মাদ্রার মূল্যে বৃদ্ধি, কৃষির উন্নতি-সাধন এবং চাউলের উৎপাদন-বৃদ্ধি। যোশিমুনের জীবিতাবস্থায় এইসব সংস্কারমূলক ব্যবস্থা কার্যকরী হওয়ায দেশের আর্থিক অবস্থার কিছুটা উন্নতি দেখা দেয় কিন্তু তাঁর মৃত্যুর প্রাক্কালে তাঁর প্রবর্তি'ত উন্নতিমূলক সমস্ত ব্যবস্থাই ভেঙে পড়ে। পরবর্তী দুজন শোগুন-ইয়েলিগে এবং ইয়েহার -স্বয়ং প্রত্যক্ষভাবে দেশশাসন না ক'রে পুনরায় অনুগত কর্মচারীদের উপর শাসনের দায়িত্ব অর্পণ করেন। ফলে দেশে দুরবস্থা বৃদ্ধি পায়। একাদশ শোগুন ইয়েনরি টোকু গাওয়া শোগুনের মধ্যে সর্বাপেক্ষা দীর্ঘকাল দেশ-শাসনের সুযোগ পান কিন্তু তাঁর শাসনকালে দেশ নিদারুণভাবে অর্থসঙ্কটের কবলে পতিত হয়। তখন দেশের অর্থনৈতিক কাঠামো ভেঙ্গে পড়ে; দুর্ভিক্ষ, মড়ক ও আর্থিক অনটনে জন-সাধারণের দুর্গতি সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যায়। চাউলের অভাবে দাঙ্গাহাঙ্গামা দেখা দেয়। পরবর্তী অর্থাৎ দ্বাদশ শোগুন ইয়েযোশির শাসনকালে দেশের অর্থনৈতিক কাঠামো অধিকতর দুর্বল হয়ে পড়ে এবং অর্থনৈতিক উন্নতির সকলপ্রকার অন্তিম প্রচেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। দেশে পুনরায় দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। এই সময় বৈদেশিক শন্তির চক্রান্তে জাপানের সমস্যা রাজনৈতিক রূপ ধারণ করে। বৈদেশিক শক্তির চাপে শেষ অধধি লোগুন-শাসনের অবসানও ঘটে। এই অবসান মুর্ত' হয়ে ওঠে সর্বশেষ তিনজন শোগুনের শাসনকালে-ইয়েসদ , ইয়েমোচি , এবং যোশিনোবু বা কেইকি । সর্বশেষ শোগুন যোশিনোবুকে দেশের সর্বশ্রেণীর রুদ্রবিক্ষোভের কাছে নতি স্বীকার ক'রে ১৮৬৭ খৃষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে পদত্যাগ করতে বাধ্য হতে হয়। প্রায় নাটকীয়ভাবে দীর্ঘস্থায়ী (১৬০৩-১৬০৭) টোকুগাওয়া শোগুন-শাসনের উপর যবনিকা পড়ে। (শোগুন এবং সেইকি (Seiki, জাপানের রাজনৈতিক ইতিহাস)। এই সব ক্রনায় শোগুনের অবৈধভাবে ক্ষমতাসীন হওয়ার কাহিনী এবং রাজবংশের শোচনীয় অবনতির ইতিহাস লিপিযন্ত্র আছে। এই সব 'গ্রন্থ এবং প্রাচীন জাপানের ইতিহাস পাঠ ক'রে জাপানীরা দড়নিশ্চয় হন যে সম্রাট শোগুন কর্তৃক প্রতারিত হয়েছেন এবং দেশের প্রকৃত শাসক জিদুটোল্লার বংশধরগণ, শোগুন নন। এই দৃঢ়নিশ্চয়তার ফলশ্রুতি হয় শোগুন-বিরোধী মনোভাষের সৃষ্টি। শোগুন যে উদ্দেশ্য নিয়ে দেশে সাংস্কৃতিক কার্যকলাপে মদত দিতে চেয়েছিলেন তা শুধু ব্যর্থ হয়নি, পরন্তু তা শোগুন-শাসনের পরিপন্থী হয়। সাহিত্য ও ইতিহাস পাঠের ফল হয় দুটি-জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ও সম্রাটের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ। এই সময় আদর্শবাদী চৈনিক দার্শনিক ওয়াং ইয়াং মিঙের (Wang yang-ming, ১৪৭২-১৫২৯) তত্ত্বগত শিক্ষাপ্রচার শোগুন-বিরোধী আন্দোলনে মদত যোগায়। তাঁর মূল শিক্ষা হল 'আত্মানম বিদ্ধি' অর্থাৎ নিজকে জানতে চেস্টা কর বা আত্মপরীক্ষা কর। স্বীয় প্রকৃতি সম্পর্কে সম্যক ধারণা না জন্মালে কাহারও নিজ মঙ্গল-অমঙ্গলের বোধ জন্মে না। চৈনিক দার্শনিকের এ হেন শিক্ষা জাপানের জনগণকে স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে অনুপ্রেরণা দেয়। ফলে জাপানী মনে শোগুন-শাসনেব বৈধতা সম্পর্কে সন্দেহ জাগে এবং দেশে শোগুন বিরোধী মনোভাব গড়ে ওঠে। জাপান এইভাবে এক বিরাট পরিবর্তনের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়। এই পরিবর্ত'ন স্বরান্বিত করে অর্থনৈতিক সঙ্কট তথা বহির্জগতের সঙ্গে পুনঃসংযোগস্থাপন।
স্যার রবার্ট পাঁল (Sir Robert Peel) ইংলন্ডের রাণী ভিক্টোরিয়ার রাজত্বকালে দ্বিতীয়বার মন্ত্রিসভা গঠন করেন ১৮৪১ খৃষ্টাব্দে। পীলের এই দ্বিতীয় মন্ত্রিসভার স্থায়িত্বকাল ১৮৪১ থেকে ১৮৪৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। ইংল্যান্ড তখন এক নিদারুণ অর্থনৈতিক সঙ্কটের কবলে। জনসাধারণের দারুণ দুর্দশা, ব্যবসা-বাণিজ্যে অপরিসীম মন্দা, অদ্ভুতপূর্ব বেকার অবস্থা; হ্রাসমান রাজস্ব, দ্রুতবর্ধমান ঘাটতি বাজেট-সব কিছুর মিলনে তৎকালীন ইংলন্ডে যে সংকটের, উদ্ভব হয় তার বর্ণনা-প্রসঙ্গে পীল বৃটিশ হাউস অব কমান্স-এ এক দ্বিধতিতে বলেন-'অর্থমন্ত্রী (চাম্পেলার অব এক্সচেকার) তখন এক অতল-স্পর্শ' জলাশয়ের তীরে একটি শূন্য-গঞ্জ' সিন্দুকের উপর উপবেশন ক'রে অর্থাভাব পূরণের জন্য বাজেট-রূপ মৎস্য শিকারে বৃথাই সচেষ্ট ছিলেন। এর চেয়ে দুঃখদায়ক চিত্র আর কি হতে পারে?'৪০ টোকুগাওয়া শাসনকালে,বিশেষতঃ ঊনবিংশ শতকের প্রথমার্থে' জাপানের অর্থনৈতিক অবস্থা বহুলাংশে পীল-বর্ণিত ইংলন্ডের অর্থনৈতিক অবস্থার অনুরূপ ছিল।
মেজি যুগের প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ প্রিন্স মাৎস্কাটা অর্থনৈতিক সঙ্কটকেই টোকুগাওয়া শাসনের অবসানের মুখ্য কারণ হিসাবে বর্ণনা করেছেন। অধ্যাপক অ্যালেন (Allen) ও এই মতের সমর্থক। উভয়েরই একই বক্তব্য-১৮৬৭খৃষ্টাব্দের পূর্বে বহু বৎসর যাবৎ জাপানে এক অর্থনৈতিক সঙ্কট বিদ্যমান ছিল। এই সঙ্কট-প্রসূত বিক্ষোভ ও আন্দোলন শোগুন শাসনের পতন অনিবার্য' ক'রে তোলে। সপ্তদশ শতকের প্রথমার্ধে অর্থাৎ প্রথম তিনজন "শোগুনের শাসনকালে জাপানের অর্থনেতিক অবস্থা মোটের মাথায় স্বচ্ছল ছিল, বলা যেতে পারে। উক্ত শতকের দ্বিতীয়ার্ধে এই স্বচ্ছলতার অভাব প্রথম পরিলক্ষিত হয়। বিশেষতঃ পঞ্চম শোগুন সুনাযোশির শাসনকালে (১৬৮০-১৭০৯) প্রশাসনিক দুর্নীতি ও অর্থসংকট দেখ্য দেয়। অনিয়ন্ত্রিত প্রসাসনিক ব্যয় তথা অগ্নিকাণ্ড ও ভূমিকম্প-জনিত ক্ষয়ক্ষতির মেরামত যাবদ প্রচুর অর্থব্যয রাজস্বে ঘাটতি সৃষ্টি করে। এই সময় মুদ্রার মূল্য হ্রাসেরও প্রয়োজন হয়। অষ্টাদশ শতকে সাময়িকভাষে আর্থিক উন্নতি দেখা দেয়। এই সময় চাউল ও খনিজ সম্পদ থেকে কিছু রাজস্ব উপার্জিত হয়। এতদ্ব্যতীত বন্দর এবং শহরাঞ্চলে যে সব বণিক ব্যবসায়ে লিপ্ত ছিলেন তাঁদের নিকট থেকেও কিছু রাজস্ব আদায় হয়। ফলে কিছু পরিমাণে অর্থনৈতিক উন্নতি সম্ভবপর হয়। তখন বহির্বাণিজ্য না থাকায় শোগুন সরকার আমদানী ও রপ্তানি কর থেকে বঞ্চিত ছিল। অষ্টাদশ শতকের এই সামযিক অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতার পর দেখা দেয় ঊনবিংশ শতকের দীর্ঘস্থায়ী ভয়াবহ অর্থনৈতিক সঙ্কট। সরকারের আয় অপেক্ষা ব্যয় বহুলাংশে বৃদ্ধি পাওয়ায় বাজেটে ঘাটতি দেখা দেয়। ১৮০৪ ১৭ খৃষ্টাব্দের মধ্যে শোগুন সরকারের মোট আয় ছিল বৎসরে এক মিলিয়ন রায়ো (Ryo, ১ রায়ো-১ ইয়েন)। যতদিন এই আয় বিদ্যমান ছিল ততদিন ঘাটতি দেখা দেয়নি। কিন্তু ১৮১৭ খৃষ্টাব্দের পরবর্তীকালে যুদ্ধ জাহাজ "ক্রয়, জাহাজ নির্মাণের কারখানা স্থাপন, দুর্গ নির্মাণ এবং জাপানের উপকূল অঞ্চল রক্ষণাবেক্ষণ ইত্যাদি যাবদ সরকারের প্রচুর অর্থব্যয় হতে থাকে, বিশেষতঃ (১৮৩০-৪৩) খৃষ্টাব্দের মধ্যে (টেম্পো যুগ, Tempo era) 1 । এই কালে ব্যয় বৃদ্ধি পায় ১৫ লক্ষ রায়ো থেকে ২৫ লক্ষ রায়ে। ৪১ ফলে বাজেটে ঘাটতি পড়ে। অধিকন্তু রাজত্ব বিভাগের শিখিল শাসন ব্যবস্থার সুযোগ নিয়ে দুর্নীতিপরায়ণ কর্মচারীরা রাজকোষের অর্থ আত্মসাৎ করতে থাকে। কৃষকেরা অতিরিক্ত করভারে নির্যাতিত হয়ে একাধিকবার বিদ্রোহ ঘোষণা করে। পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে ১৬০৩-১৮৬৭ খৃষ্টাব্দের মধ্যে ১১৫৩ বার কৃষকবিদ্রোহ সংঘটিত হয়। ১৮০৩-৩৭ খৃষ্টাব্দের বৎসরগুলি ছিল অজম্নার বৎসর । বহু কৃষক পরিবার তখন গ্রাম ত্যাগ ক'রে শহরা-ভিমুখী হয়। ১৮১৯-৩৭ খৃষ্টাব্দের মধ্যে ১৯ বার জাপানী ইয়েনের মূল্য হ্রাস করা হয়, যা অর্থনৈতিক সঙ্কটের ইঙ্গিত বহন করে। ফলে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির মূল্য বৃদ্ধি পায়। মুদ্রাস্ফীতি ও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি জনসাধারণের দৈনন্দিন জীবনযাপন দুর্বিষহ ক'রে তোলে। ১৮৫৪ খৃষ্টাব্দের পর বহিবাণিজ্য শুরু হওয়ার ফলে চাউল, চা, এবং কাঁচা রেশম প্রচুষ পরিমাণে বিদেশে রপ্তানী হতে থাকে। ফলে দেশের মধ্যে এই সব দ্রব্যের মূল্যে বৃদ্ধি পায়। ১৮৫৯-৬৭ খৃষ্টাব্দের মধ্যে চায়ের মূল্য বৃদ্ধি পায় দ্বিগুণ, কাঁচা রেশমের মূল্য বৃদ্ধি পায় তিনগুণ এবং সাধারণ মানুষের প্রধান খাদ্য, চাউলের মূল্য বৃদ্ধি পায় বারগুণ। অপর দিকে, বিদেশ থেকে সন্তাদরে কার্পাস বস্ত্র, কার্পাস সূতা ইত্যাদি আমদানী হওয়ায় জাপানে উৎপন্ন ঐ জাতীয় দ্রব্যের বিক্রয় মূল্য হ্রাস পায়। পরিণামে যে সমস্ত জাপানী পরিবার ঐ জাতীর দ্রব্য বিক্রয় ক'রে জীবিকা অর্জন করত তারা বিপন্ন হয়ে পড়ে। ডাইমিয়ো ও সামুরাই শ্রেণী ও অর্থনৈতিক সঙ্কটের সম্মুখীন হয়। ডাইমিয়োর জমিদারীর আর যথেট হ্রাস পায় অথচ ব্যয়ের বহর হ্রাস পায়নি। পূবে আলোচিত সাকিন কোটাই বিধানের ফলে ডাইমিয়োর ব্যয় অধিকতর বৃদ্ধি পায়। অধিকাংশ ডাইমিয়োকে, তখন বণিক শ্রেণীর নিকট থেকে খঋণ গ্রহণ করতে বাধ্য হতে হয়। ১৮০১ খৃষ্টাব্দে ওয়ারি (Owari) জমিদারীর বার্ষিক আয় চাউলের হিসাবে ছিল দুই লক্ষ পঞ্চাশ হাজার কোকু। তখন ঐ জমিদারীর ডাইমিয়োদের ঋণের পরিমাণ ছিল এক লক্ষ সাতাশ হাজার রায়ো। যদি মোটামুটি ধরা যায় যে এক কোকু চাউলের মূল্য ছিল এক রায়ো, তাহলে ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় মোট আয়ের অর্ধেকের কিঞ্চিদধিক। ৪২ ১৮৪৯-৫৩ খৃষ্টাব্দের মধ্যে ওয়ারিত্ব ডাইমিয়োদের চাউলের হিসাবে মোট ঋণ দাঁড়িয়েছিল ১৮ মিলিয়ন কোকু। ৪৩ সাতসুমার ডাইমিল্লোদের আর্থিক অবস্থা অধিকতর শোচনীয় ছিল। ১৮০৭ খৃষ্টাব্দে তাঁদের ঋণের পরিমাণ ছিল ১৩ মিলিয়ন রায়ো। ১৮৩০ খৃষ্টাব্দে ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৫ মিলিয়ন রায়ো। ১৮৪০ খৃষ্টাব্দ নাগাদ সাভদ্মার ডাইনিয়োগণ ওসাকার বণিকদের নিকট থেকে ঋণ গ্রহণ করেছিলেন ৬০ মিলিয়ন রায়ো। সামুরাই শ্রেণীর অবস্থা ডাইমিয়োদের অবস্থা অপেক্ষা অধিকতর সঙ্কটময় হয়েছিল। তাঁদের এমন কোন সঙ্গতি ছিল না যাতে তাঁরা তাঁদের পদমর্যাদা অনুযায়ী জীবন-যাপন করতে পারেন। তাই সামুরাইদেরও বণিক শ্রেণীর নিকট থেকে ঋণ গ্রহণ করতে হয়। বণিক শ্রেণীও সুযোগ বুঝে সামুরাই বংশের সঙ্গে সামাজিক সম্পর্ক স্থাপনে উদ্যোগী হয়, পোষ্য-সন্তান গ্রহণ এবং বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে। ফলে, একদিকে যেমন বণিক শ্রেণী সামাজিক প্রতিষ্ঠা লাভ করে, অন্যদিকে তেমনি সামুরাই-বণিক মৈত্রী শোগুন-শাসন পতনের পথ সুগম করে।
টেম্পা যুগে (১৮৩০-১৩) দেশব্যাপী এক ঘোরতর সঙ্কটময় পরিস্থিতির উদ্ভব হয়। ১৮২৪-৩২ খৃষ্টাব্দে অজম্মা, ১৮৩৩ খৃষ্টাব্দে উত্তর জাপানে দুর্ভিক্ষ এবং ১৮৩৬ খৃষ্টাব্দে দেশব্যাপী দুর্ভিক্ষ জাতীয় জীবন পর্যুদন্ত করে তোলে। ৪৫ মোট কথা, উনবিংশ শতকের প্রথমার্ধে শোগুন-শাসিত জাপানে অর্থনৈতিক প্রশাসন একেবারে ভেঙ্গে পড়ায় এক ভয়াবহ সঙ্কটের উদ্ভব হয়, যে সঙ্কটরূপ ঝড়ের সম্মুখে শোগুনের 'সিংহাসন' উচ্ছিষ্ট পাতার মত উড়ে যাওয়ার পর্যায়ে পৌঁছায়। ডাইমিয়ো, সামুরাই, কৃষক প্রভৃতি সকল শ্রেণীই স্ব স্ব কারণে তখন বিক্ষদ্ধ। অসম করস্থাপন, প্রশাসনিক ব্যয় বৃদ্ধি ও অমিতব্যয়িতা, ঘাটতি বাজেট, রপ্তানী অপেক্ষা আমদানী বৃদ্ধি, ইয়েনের মূল্যহ্রাস, মুদ্রাস্ফীতি, নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির মূল্যবৃদ্ধি, অজম্মা, দুর্ভিক্ষ, মহামারী প্রভৃতির সম্মিলিত প্রতিক্রিয়া শোগুন-যুগকে অন্তিমকালে পৌঁছে দেয়। তখন সকল শ্রেণীর মানুষই প্রশাসনিক ব্যবস্থায় তথা সামাজিক ও অর্থনৈতিক কাঠামোতে এক আমলে পরিবর্তনকে স্বাগত জানাতে উদগ্রীব। শোগুন-শাসনের রুদ্ধ দ্বারের পশ্চাতে দাঁড়িয়ে সর্বশ্রেণীর মানুষ দরজা ভঙ্গ ক'রে বাহিরে এসে এক নূতন পরিবেশের আশায় অধীর হয়ে ওঠে। সেই রুদ্ধদ্বার অর্গল-মুক্ত করে কমোডোর পেরী ১৮৫৩-৫৪ খৃষ্টাব্দে। এ যেন জাপানী জনগণের বন্দীজীবন থেকে মুক্তির খাদলাভ।)
১৮৫০ খৃষ্টাব্দ নাগাদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকার জাপানের সঙ্গে যাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপনে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তৎকালীন প্রেসিডেন্ট মিলার্ড' ফিলমোর (Millard Fillmore) জাপান সরকারের সঙ্গে আলাপ আলোচনার জন্য নৌ-বিভাগের অভিজ্ঞ পদস্থ কর্মচারী তথা বিচক্ষণ কূটনীতিক ম্যাথ সি পেরীকে (Matthew C. Perry) মনোনীত করেন। সুতরাং পেরী ১৮৫৩ খৃষ্টাব্দে জাপানের উদ্দেশ্যে পাড়ি দেন। তাঁর চারটি কৃষ্ণবর্ণ রণতরী সম্বলিত নৌবহর (Susquehanna) ঐ বৎসর জুলাই মাসে এডো উপসাগরে (Edo Bay) ইউরাগা-র (Uraga) অনতিদূরে নোঙ্গর করে। সমস্ত এডো শহর তখন সম্প্রন্ত হয়ে পড়ে এক আসন্ন বিপদের আশঙ্কায়। আমেরিকা জাপান আক্রমণ করতে এসেছে মনে ক'রে এন্ড এডোবাসীরা নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে শশব্যস্ত হয়ে ওঠে। যখন এডো শহর এবং তার চতুষ্পার্শ্বস্থ অঞ্চল এক অভূতপূর্ব ভয়-ভীতি ও আর্তনাদের কষলে, তখন কমোডোর পেরী তাঁর সঙ্গে আনীত প্রেসিডেন্ট ফিলমোরের একটি চিঠি শোগুনের দরবারে পেশ করেন। চিঠিটি গ্রহণ করেন তৎকালীন শোগুন যোশিনোবুর পক্ষ থেকে তাঁর দুইজন উচ্চপদস্থ কর্মচারী। হোয়াইট হাউসের উক্ত চিঠিতে তিন দফা অনুরোধ লিপিবদ্ধ ছিল-(১) যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য জাহাজের জন্য জাপানের উপকূলে তৈল গ্রহণের সুযোগ দান; (৫) অবাধ বাণিজ্যের অনুকূল একটি বাণিজ্যিক সন্দ্বিপত্র স্বাক্ষর করণ; এবং (৩) যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে জাপানের মৈত্রী স্থাপন। চিঠির উত্তর পেতে কিছু বিলম্ব হবে জানতে পেরে পেরী সাময়িকভাবে চীনের উপকূলে নোঙ্গর করেন। শোগুন ইত্যবসরে সম্রাট কোমিয়ো, ডাইমিয়ো এবং পদস্থ সরকারী কর্মচারীদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবগুলি আলোচনা করেন। বিদেশের সঙ্গে জাপানের বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপনে সম্রাট, ডাইমিয়োক্ষণ, বিশেষতঃ মিটোর ডাইমিয়ো, বিরোধিতা করেন কিন্তু সরকারী কর্ম'চারীরা এই সম্পর্ক' স্থাপনে উৎসাহ ও সম্মতি দান করেন। ফলে ভিন্ন মতাবলম্বী দুইটি দলের সৃষ্টি হয়-জয়তো (Joito) বা বিরোধীদল এবং কাইকোকুটো (Kaikokuto) যা সম্মতিদানে ইচ্ছুক দল। শোগুন বিরোধীদলকে অগ্রাহ্য ক'রে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপনে মনস্থির করেন। ইতিমধ্যে পেরী ১৮৫৪ খৃষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারীতে পুনরায় এডোতে উপস্থিত হন। তখন শোগুন ভাঁর সঙ্গে একটা সন্দ্বিপত্র স্বাক্ষরিত করেন-কানাগাওয়া সন্দ্বিপত্র (Treaty of Kanagawa)। দুইশত বৎসরেরও অধিককাল জাপান বহির্জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল। সম্রাট ও ডাইমিয়োদের বিরোধিতা সত্ত্বেও শোগুন নিজ গায়িত্বে সেই বিচ্ছিন্নতার অবসান ঘটিয়ে বিদেশের নিকট জাপানকে উন্মুক্ত ক'রে যে চরমপন্থী কূটনীতির পরিচয় দেন তা অদূর ভবিষ্যতে শোগুন সরকারের অবসানের পথই প্রশস্ত করে। কানাগাওয়া সম্মির শর্তগুলি ছিল -(১) নাগাসফি সমেত আরও দুটি বন্দর বিদেশীয় অর্থাৎ যুক্তরাস্ট্রীয় জাহাজের জন্য উন্মুক্ত করা হবে, জাহাজ মেরামতের জন্য, এবং জাহাজে ভৈল করলা ইত্যাদি গ্রহণের জন্য; (২) শিমোডাতে (এজ্যে থেকে ৬০ মাইল দুয়ে অবস্থিত) যুক্তয়া পাঁর একজন কনসাল নিযুক্ত হবেন। (৩) বিদাস জাহাজের নাবিকদিগকে আশ্রয় দেওয়া হবে; (৪) জাপানে অন্যান্য বৈদেশিক শক্তিবর্গ যে সমস্ত সুযোগ-সুবিধা ভোগ করবেন সেই সমস্ত সুযোগ-সুবিধা (Most-favoured-nation treatment) যুক্তরাষ্ট্রের অধিবাসীরাও ভোগ করতে পারবেন। পরে ইংলণ্ড, রাশিয়া, এবং হল্যান্ড ও জাপানের সঙ্গে অনুরূপ শর্ত-সম্বলিত সন্দ্বিপত্র স্বাক্ষরিত করেন যথাক্রমে ১৮৫৪, ১৮৫৫ এবং ১৮৫৫-৫৭খৃষ্টাব্দে।
কানাগাওয়া সন্ধির সর্তানুযায়ী যুক্তরাষ্ট্র সরকার টাউনসেন্ড হ্যারিশকে (Townsend Harris) কনসাল হিসাবে জাপানে প্রেরণ করেন ১৮৫৬ খৃষ্টাব্দে। হ্যারিশ শিমোডোতে উপস্থিত হন ঐ বৎসরের আগস্ট মাসে। পরে তিনি ২৯শে জুলাই ১৮৫৮ খৃষ্টাব্দে Harris Treaty নামে একটি সন্দ্বিপত্র স্বাক্ষরিত করেন। এই সন্দ্বিপত্রের শর্তগুলি ছিল-(১) যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানের মধ্যে নিয়মিতভাবে কুটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হবে; (২) পূর্বের তিনটি বন্দর ব্যতীত আরও চারটি জাপানী বন্দর যুক্তরাষ্ট্রের নিকট উন্মুক্ত হবে এবং যুক্তরাষ্ট্র ঐ সব বন্দরে ব্যবসা-বাণিজ্যের অনুমতি পাবে; (৩) ঐ সব বন্দরে আমদানী ও রপ্তানী করা দ্রব্যাদির উপর শুল্ক আপোরিত হবে এবং ঐ শুল্কের নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব থাকবে যুক্তরাষ্ট্রের হাতে; (৪) জাপানে অবস্থানকারী যুক্তরাষ্ট্রীয় নাগরিকেরা জাপানী আইনের আওতাধীন হবেন না, তাঁরা থাকবেন বন্ধুরাষ্ট্রের সরকারের আইনের অধীন বা আঁতরাষ্ট্রিক ( xtraterritorial) আইনের অধীন; (৫) জাপানে বৈদেশিক মুদ্রা চালু হবে এবং জাপান থেকে জাপানী মুদ্রা রপ্তানী হবে। সহজেই অনুমেয় যে হ্যারিস সন্ধির সকল শর্তগুলিই ছিল জাপানের স্বার্থে'র প্রতিকূল।
সম্রাট ও ডাইমিয়োদের মতের বিরুদ্ধে শোগুন এইভাবে বহির্বিশ্বের সঙ্গে জাপানের সম্পর্ক স্থাপন করেন। পরিণামে দেশে একটি আন্দোলনের সৃষ্টি হয়, যার উদ্দেশ্য ।
