বাগদাদ চুক্তি (The Bagdad Pact or CENTO) সম্পর্কে আলোচনা কর
১৯৫৫ খ্রীষ্টাব্দের ২৪শে ফেব্রুয়ারি ইরাক ও তুরস্কের মধ্যে পরস্পর নিরাপত্তা ও সাহায্যমূলক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ইহাই বাগদাদ চুক্তি নামে পরিচিত) আরব লীগের সদস্য রাষ্ট্রবর্গের তীব্র প্রতিবাদ সত্ত্বেও ইরাক এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করিল। যে-কোন রাষ্ট্র এই চুক্তিতে যোগদান করিতে পারিবে এই শর্তের সুযোগে ব্রিটেন, পাকিস্তান, ইরাণ উহাতে যোগদান করিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও এই রাষ্ট্রজোটে সংযুক্ত হইল। বাগদাদ চুক্তিতে ইরাকের যোগদান আরব লীগের যুগ্ম নিরাপত্তার প্রচেষ্টা কতক পরিমাণে ব্যাহত করিল এবং আরব রাষ্ট্রসমূহের উপর মিশরের নেতৃত্বও কতকাংশে ফলে সিরিয়া, মিশর, সউদি আরব প্রভৃতি রাষ্ট্রের নিরপেক্ষতা ক্ষুণ্ণ করিলে । (পশ্চিমী-রাষ্ট্রবর্গ বাগদাদ চুক্তিভুক্ত রাষ্ট্রগুলিকে সামরিক সাহায্য ও সামরিক শিক্ষা দান করিয়া মধ্য-প্রাচ্যাঞ্চলে সোভিয়েত রাশিয়া-বিরোধী এক সামরিক রাষ্ট্রজোট গড়ে তুলার মূলক নীতি অনুসরণের প্রয়োজন আরও বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হলে রাশিয়ার প্রতি এই সকল রাষ্ট্রের মনোভাব আরও মিত্রতাপূর্ণ হয়ে উঠে।
বাগদাদ চুক্তি স্বাক্ষরের ফলে মধ্য-প্রাচ্যের সমস্যা লইয়া পূর্ব ও পশ্চিমী ব্লকের মধ্যে ঠাণ্ডা লড়াই-এর মনোভাব যেমন বৃদ্ধি পাইয়াছিল তেমনি উহার ফলে ভারত-পাকিস্তান মনোমালিন্য, আরব দেশসমূহের সহিত বাগদাদ চুক্তিভুক্ত দেশসমূহের মনোমালিন্যের সৃষ্টি হইয়াছিল। ভারতের নিরাপত্তার দিক্ হইতে বিচার করিলে পাকিস্তানের বাগদাদ চুক্তিতে যোগদান এবং মার্কিন সামরিক সাহায্য গ্রহণ মোটেই সমর্থনযোগ্য নহে। কারণ ইহার ফলে ঠাণ্ডা লড়াই ভারতীয় সীমান্তে বিস্তৃত হইয়াছিল। তদুপরি পাকিস্তানী নেতৃবর্গের 'যুদ্ধং দেহি' মনোবৃত্তির কথা স্মরণ রাখিলে বিদেশী সামরিক সাজ-সরঞ্জাম পাকিস্তানের হস্তে দেওয়ার বিপদও নেহাৎ কম নহে, একথাও স্বীকার করিতে হইবে। এজন্য ভারতকে নিরাপত্তা খাতে অধিক ব্যয়-বরাদ্দ করিতে হইবে এবং তাহাতে উন্নয়নমূলক কার্য ব্যাহত হইবে। (ইহা ভিন্ন বৃহৎ শক্তিবর্গের সহিত সামরিক চুক্তিবদ্ধ হইবার রাজনৈতিক কুফল নীতিগতভাবে ভারত সমর্থন করিতে পারে না, কারণ এই ধরনের সামরিক রাষ্ট্রজোটে যোগদান করা দুর্বল রাষ্ট্রবর্গেব সার্বভৌমত্বের পরিপন্থী। ইহা ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদের আধুনিকতম রূপ।)
এদিকে ১৯৫২ খ্রীষ্টাব্দের জুলাই মাসে (২৩শে) মিশরের সেনানায়ক জেনারেল নগুইব-এর নেতৃত্বে এক সামরিক বিপ্লব সংঘটিত হয়। ইহাতে রাজা ফারুককে সিংহাসনচ্যুত করিয়া মিশরে সামরিক শাসন স্থাপিত হয়। ইহার দুই বৎসর পর (১৯৫৪) নগুইবকে পদচ্যুত করিয়া গামাল আব্দুল নাসের মিশরের শাসনকার্য হস্তগত করেন। তাঁহার নেতৃত্বাধীনে জাতীয়
স্বার্থবৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের চেষ্টা তাঁহাকে মিশরীয় জাতির অকুণ্ঠ আনুগত্যলাভে সমর্থ করিয়াছে।
বাগদাদ চুক্তি নাসের-এর মনে ভীতির সঞ্চার করিয়াছিল, কারণ মধ্য-প্রাচ্যে এই রাষ্ট্রজোট গঠন এবং বিশেষত ইরাকের এই চুক্তিতে যোগদান মিশরের নেতৃত্বের পরিপন্থী ছিল। ইহা ভিন্ন ইস্রায়েল-আরব বিরোধও মিশরের সমস্যার জটিলতা বৃদ্ধি করিয়াছিল। (এই পরিস্থিতিতে নাসের বাধ্য হয়ে রাশিয়া ও চেকোস্লোভাকিয়া হইতে সামরিক অস্ত্রশস্ত্র ক্রয় করিলেন। এদিকে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিকট হইতে অসওয়ান বাঁধ নির্মাণের জন্য অর্থ সাহায্য গ্রহণের উদ্দেশ্যে আলাপ-আলোচনা চালাইতেছিলেন। কিন্তু রাশিয়। ও চেকোস্নোভাকিয়া হইতে সামরিক উপকরণ ক্রয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও
ব্রিটেনের মনঃপূত ছিল না। এই অসন্তোষের কারণেই মার্কিন
যুক্তরাষ্ট্র আকস্মিকভাবে অসওয়ান বাঁধের জন্য অর্থ সাহায্যদানে অস্বীকৃত হইলে নাসের সুয়েজ খাল কোম্পানির (Suez Canal Company) জাতীয়করণ করিলেন। ইহাতে ব্রিটেন ও ফ্রান্সের স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হইলে এই দুই দেশ যুগ্মভাবে ইস্রায়েল এর সহযোগিতায় সুয়েজ খাল অঞ্চল, গাজা অঞ্চল প্রভৃতিতে সৈন্য প্রেরণ করিল (অক্টোবর, ১৯৫৬)।) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিবাদ উপেক্ষা করিয়া ইঙ্গ-ফরাসী সরকার এই যুদ্ধ-পন্থা অনুসরণ করিলে মার্কিন প্রতিনিধি ইউনাইটেড ন্যাশন-এ ইসরায়েলকে সৈন্যাপসারণে এবং ইঙ্গ-ফরাসী সরকারদ্বয়কে যুদ্ধ হইতে বিরত হইতে নির্দেশ-সম্বলিত এক প্রস্তাব উপস্থাপন করিলেন। (ইহা ভিন্ন ইঙ্গ-ফরাসী সাম্রাজ্যবাদী ঔদ্ধত্য পৃথিবীর সর্বত্র এক তীব্র ঘৃণার উদ্রেক করিল। পৃথিবীর জনমতের চাপে এবং আন্তর্জাতিক সংস্থা ইউনাইটেড ন্যাশন্স-এর নির্দেশক্রমে ১৯৫৭ খ্রীষ্টাব্দের ৭ই নভেম্বর তারিখে ইঙ্গ-ফরাসী সরকার যুদ্ধ হইতে বিরত হইলেন। এই ঘটনা একদিকে যেমন বৃটেন ও ফ্রান্সের আন্তর্জাতিক মর্যাদায় আঘাত হানিয়াছিল, অপরদিকে মিশরের করিয়াছিল। ইহা ভিন্ন, সাময়িকভাবে ইঙ্গ-মার্কিন সম্পর্কেও তিক্ততা দেখা দিয়াছিল। (যাহা হউক, সুয়েজ খাল আক্রমণের ঘটনা আরব জাতীয়তাবাদকে আরও উৎসাহিত করিরা তুলিল।
রাষ্ট্রনায়ক গামাল নাসের-এর জনপ্রিয়তা ও আন্তর্জাতিক মর্যাদা বহুগুণে বৃদ্ধি ইউনাইটেড আরব রিপাবলিক্ ইহার ফল ইউনাইটেড আরব রিপাবলিক্ (United Arab Republic)-এর স্থাপনে (১৯৫৮) পরিলক্ষিত হইল। মিশরের সহিত সিরিয়া
ও ইয়েমেন এই প্রজাতন্ত্রে যোগদান করিল। ইহা ভিন্ন রাশিয়া ও আন্তর্জাতিক ব্যাঙ্ক হইতে নাসের অসওয়ান বাঁধ নির্মাণ ও সুয়েজ খাল সংস্কারের জন্য অর্থ সাহায্য লাভে সমর্থ হইলেন। ব্রিটেনের সহিত শেষ পর্যন্ত মিশরের কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনঃস্থাপিত হইয়াছে।)
তোমাকে অনেক ধন্যবাদ বাগদাদ চুক্তি (The Bagdad Pact or CENTO) সম্পর্কে আলোচনা কর এই নোটটি পড়ার জন্য
