দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া চুক্তি বা ম্যানিলা চুক্তি (South-East Asia-SEATO or Manila Pact) সম্পর্কে আলোচনা কর
(১৯৪৯ খ্রীষ্টাব্দে চীনে কমিউনিস্ট দলের জয়-লাভের পর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় আঞ্চলিক নিরাপত্তা-ব্যবস্থার জন্য তৎপরতা শুরু হইল। জাতীয়তাবাদী দলের নেতা চিয়াং-কাইশেক ফরমোজা দ্বীপে সদলবলে আশ্রয় গ্রহণ করিয়া কমিউনিস্ট, আক্রমণের বিরুদ্ধে শক্তিসঞ্চয়ের প্রয়োজন স্বভাবতই অনুভব করিলেন। ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট কুইরিনো ও চিয়াং-কাইশেক কয়েকটি এশীয় রাষ্ট্রের প্রতিনিধিবর্গের এক বৈঠক আহ্বান করিতে চাহিলেন। কিন্তু এবিষয়ে দক্ষিণ-কোরিয়া ভিন্ন অপর কোন রাষ্ট্র কোন আগ্রহ প্রদর্শন না করিলে কুইরিনো বাধ্য হইয়া এই বৈঠকে কোনপ্রকার রাজনৈতিক বা সামরিক প্রশ্নের আলোচনা না করিয়া কেবলমাত্র অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আদান প্রদান সম্পর্কে আলোচনা করা হইবে বলিয়া ঘোষণা করিলেন। ফলে, অস্ট্রেলিয়া, ভারত, সিংহল, ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তান, থাইল্যান্ড ও ফিলিপাইনের প্রতিনিধিবর্গ বাগুইও (Baguio) নামক স্থানে সম্মিলিত হইলেন (১৯৫০)। কুয়ো-মিং-তাং নেতা চিয়াং-কাইশেক ও দক্ষিণ-কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট সিঙ্গম্যান রী (Syngman Rhee) এই সম্মেলনে কনিউনিস্ট বিরোধিতার কোন ব্যবস্থা করা হইবে না বলিয়া উহা বর্জন করিলেন। ফলে, এই সম্মেলনে কোন সিদ্ধান্তই গ্রহণ করা সম্ভব হইল না। ১৯৫২ খ্রীষ্টাব্দে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পৃথিবীর সর্বত্র কমিউনিস্ট-বিরোধী রাষ্ট্রজোট গঠনের নীতি অনুসরণের অপরিহার্য ব্যবস্থা হিসাবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় তৎপরতা শুরু করিল। পাকিস্তান মার্কিন
যুক্তরাষ্ট্রের নিকট হইতে সামরিক সাহায্য গ্রহণে স্বীকৃত হইলে ১৯৫৪ খ্রীষ্টাব্দে পাকিস্তানের মধ্যে এক সামরিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হইল। পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ অর্থ নৈতিক দুরবস্থা,বেকার সমস্যা তদুপরি ভারতের প্রতি পাকিস্তানের বিরূপ মনোভাব প্রভৃতির সুযোগ লইয়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় কমিউনিস্ট-বিরোধী রাষ্ট্রজোট গঠনের ভিত্তি হিসাবে গ্রহণ করিল) ব্রহ্মদেশ, ভারত, সিংহল, ইন্দোনেশিয়া প্রভৃতি দেশের সহিতও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবিষয়ে আলাপ-আলোচনা করিয়া এই সকল দেশকে সামরিক জোটে যোগদানে স্বীকৃত করাইতে পারে নাই। যাহা হউক, ঐ বৎসরই (১৯৫৪) ম্যানিলাতে ব্রিটেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, পাকিস্তান, ফিলিপাইন ও থাইল্যাণ্ড-এই আটটি দেশের প্রতিনিধি-বর্গ এক সম্মেলনে উপস্থিত হইয়া South-East Asian Collective Defence Treaty নামে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করিলেন। এই চুক্তির শর্তানুসারে স্বাক্ষরকারী দেশগুলি নিজেদের মধ্যে বিবাদ-বিসংবাদ শান্তিপূর্ণ উপায়ে মিটাইয়া লইতে, সম্মিলিতভাবে যে-কোন স্বাক্ষরকারী দেশের বিরুদ্ধে সশস্ত্র আক্রমণ রোধ করিতে, অর্থ নৈতিক, সাংস্কৃতিক প্রভৃতি সর্বপ্রকার পরস্পর সাহায্য-সহায়তা দান করিতে স্বীকৃত হইল। বিদেশী সশস্ত্র আক্রমণের কোন আশঙ্কা দেখা দিলে এই সকল রাষ্ট্র পরস্পর পরস্পরের সহিত আলাপ-আলোচনা করিবে বলিয়াও স্বীকৃত হইল।) এখানে উল্লেখ করা যাইতে পারে যে, SEATO চুক্তিটি অল্পকাল পূর্বে দক্ষিণ-পূর্ব আফ্রিকার নিরাপত্তা-সংক্রান্ত ANZUS (অর্থাৎ অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে স্বাক্ষরিত) চুক্তির অনুকরণেই রচিত হইয়াছিল। (এই চুক্তিটির প্রয়োগস্থল ছিল সমগ্র দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, এশিয়াস্থ যে সকল দেশ এই চুক্তিতে যোগদান করিয়াছে সেই সকল দেশ এবং দক্ষিণ-পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল। এই চুক্তির পরিপূরক হিসাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র স্বাক্ষরকারী দেশসমূহের যে-কোনটি কমিউনিস্ট দেশ কর্তৃক আক্রান্ত হইলে সামরিক ব্যবস্থা অবলম্বনে প্রতিশ্রুত হইয়াছিল। বলা বাহুল্য কমিউনিস্ট চীন ও রাশিয়ার বিরুদ্ধেই এই রাষ্ট্রজোট গঠন করা হইয়াছিল। NATO এবং ANZUS চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী দেশসমূহ এবং পাকিস্তান ভিন্ন অপর কোন দেশকে এই সামরিক জোটে সংযুক্ত করা সম্ভব হয় নাই।
ইহা হইতে একথাই প্রমাণিত হয় যে, এশিয়া তথা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলে সামরিক রাষ্ট্রজোটে যোগদানের মনোবৃত্তি বহু ভারত, সিংহল, দেশেরই ছিল না। (ভারতের সহিত বিরোধিতা হেতু পাকিস্তান এই সামরিক জোটে যোগদান করেছে । পাকিস্তানের এই চুক্তিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রী জাফরউল্লা খাঁ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিকট হইতে যোগদানে অস্বীকৃর্তি) এমন এক প্রতিশ্রুতি আদায় করিতে চাহিয়াছিলেন যাহাতে SEATO শক্তিজোটকে পাকিস্তানের সাহায্যার্থে ভারতের বিরুদ্ধেও ব্যবহার করা যায়। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কেবলমাত্র কমিউনিস্ট আক্রমণের বিরুদ্ধে SEATO শক্তিগুলিকে প্রত্যক্ষভাবে সামরিক সাহায্যদানে প্রস্তুত এই জাফরউল্লার উদ্দেশ্য ব্যর্থ শর্তের অধিক কিছু করিতে প্রতিশ্রুত না হওয়ায় জাফরউল্লা খাঁর উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয় নাই। তথাপি এই ধরনের সামরিক রাষ্ট্রজোটে পাকি-স্তানের যোগদানের ফলে ভারতকেও বাধ্য হইয়া সামরিক দিক দিয়া তৎপর হইতে হইয়াছে।
