নিজোট আন্দোলনের বিকাশে জওহরলাল নেহরুর ভূমিকা আলোচনা কর বা, বান্দুং সম্মেলনের লক্ষ্য, তৃতীয় বিশ্বের রাজনীতির বিকাশে এর অবদান
উত্তর:- দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সোভিয়েত রাশিয়া ও আমেরিকার নেতৃত্বে গোটা বিশ্ব দুটি পরস্পর বিরোধী গোষ্ঠীতে বিভক্ত হয়ে পড়ে । স্বাধীনতার পর ভারত এই গোষ্ঠীর কোনোটিতেই যোগ না দিয়ে উভয়ের থেকে সমদূরত্ব বজায় রেখে সম্পূর্ণ স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে বৈদেশিক সম্পক পরিচালনার নীতি গ্রহণ করে। এই নীতি জোট নিরপেক্ষ নীতি নামে পরিচিত।
নেহরুর উদ্যোগ জোট নিরপেক্ষ আন্দেলনের প্রধান স্থপতি ও রূপকার হলেন জওহরলাল নেহরু ৷ ১৯৪৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে অন্তর্বর্তী সরকারের অন্যতম প্রধান হিসেবে নেহরু মনে করেন যে, ভারত সকল গোষ্ঠী ও রাজনৈতিক জোটের বাইরে থেকে সকল দেশের সঙ্গে পদ চলুন সম্পর্ক স্থাপন করবে ১৯৪৭ সালের মার্চ মাসে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত এশিয়া মহাদেশের ২২টি দেশের প্রতিনিধিদের সম্মেলনে নেহরু বিশ্ব শান্তি রক্ষা ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে এশিয়ার সকল দেশকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান। ১৯৪৯ সালে এশিয়া ও আফ্রিকার সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশগুলিকে নিয়ে তিনি জোট নিরপেক্ষ কূটনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে সচেষ্ট হন।
জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন নিছক একটি এশিয়া-আফ্রিকা মহাদেশের ব্যাপার ছিল না। ইউরোপীয় রাষ্ট্র যুগোশ্লাভিয়াও নির্জেটি আন্দোলনে যোগদান করে। ১৯৫৪ সালে জুলাই মাসে নেহরু যুগোশ্লাভিয়া যান এবং ঐ বছরের ডিসেম্বরে যুগোশ্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট টিটো ভারতে আসেন। নেহরু ও টিটো দিল্লিতে এক যৌথ বিবৃতি মারফৎ জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের প্রতি আস্থা জ্ঞাপন করেন।
বান্দুং সম্মেলন: ১৯৫৫ সালে ইন্দোনেশিয়ার বান্দুং শহরে এশিয়া-আফ্রিকার ২৯টি দেশের প্রতিনিধিরা এক সম্মেলনে মিলিত হন। এই সম্মেলনের মূল উদ্যোক্তা ও মধ্যমণি ছিলেন পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু এবং ইন্দোনেশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আলিশস্ত্রো মিদযোযোগ। এই সম্মেলন থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের সূচনা হয়।
দশশীল নীতি: বান্দুং সম্মেলনে ভারত তার লক্ষ্য পূরণে আংশিকভাবে সফল হয়েছিল। ভারতের পঞ্চশীল নীতি গৃহীত ছিল, তবে তার সঙ্গে আর পাঁচটি নীতি সংযোজিত হওয়ার পর। ফলে পঞ্চশীল নীতি দশশীল নীতিতে রূপান্তরিত হয়। এই দশটি নীতি হল-
- মৌলিক মানবাধিকার ও সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের সনদের উদ্দেশ্য ও লপোর প্রতি সম্মান প্রদর্শন।
- সকল রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক অখণ্ডতার স্বীকৃতি
- ছোট বড় সকল বর্ণ ও জাতির সমানাধিকার।
- অন্য দেশের অভ্যন্তরীন বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করা।
- একক বা যৌথভাবে সকল জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের প্রতি মর্যাদা
- কোনো বৃহৎ লক্তির প্রতিরক্ষার স্বার্থ রক্ষা করা থেকে এবং অন্য দেশের ওপর চাপ সৃষ্টি করা থেকে বিরত থাকা। .
- অন্য দেশের বিরুদ্ধে ভীতি প্রদর্শন এবং বলপ্রয়োগ থেকে বিরত থাকা।
- শান্তিপূর্ণ উপায়ে আপোষ, আলাপ আলোচনা সালিনি ও মধ্যস্থতার মাধ্যমে সকল বিরোধ ও মনোমালিন্যের মীমাংসা।
- পারস্পরিক স্বার্থ রক্ষা ও সহযোগিতা
- ন্যায় নীতি ও আন্তর্জাতিক ন্যায়লবদ্ধাতার প্রতি সম্মম্মান প্রদান |
কায়রো সম্মেলন: ১৯৬১ সালে ২১টি দেশর প্রতিনিধিবর্গ কায়রোতে সানকেও হন। এই সম্মেলনে নিজোট আন্দোলনের কিছু নীতি নির্ধারিত হয়। নীতিগুলি হল-(১) জোট নিয়পেক্ষতা (২) কোনো রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীন বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করা (৩) বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠা (৪) বর্ণবৈষম্য ও সাম্রাজ্যবাদী শোষণ প্রতিহত করা (৫) জাতীয় মুক্তি আন্দোলনকে সমর্থন।
বেলগ্রেড সম্মেলন: ১৯৬১ সালে সেপ্টেম্বর মাসে যুগোশ্লাভিয়ার রাজধানী বেলগ্রেডে জোট নিরপেক্ষ দেশগুলির প্রথম শীর্ষ সম্মেলন বসে। এই সম্মেলনে এশিয়া, আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকার মোট ২৫টি দেশ যোগদান করেছিল। এই সম্মেলনে যোগদানকারী উল্লেখযোগ্য নেতৃবৃন্দের মধ্যে ছিল নেহরু, নাসের, টিটো, সুকর্ণ প্রমুখ এই সম্মেলনে যুদ্ধের বিরুদ্ধে, বর্ণবৈসম্য, সাম্রাজ্যবাদ, নয়া সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়।
জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের ইতিহাসে পঞ্চাশের দশক ছিল সোনালী সময়। ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন অত্যন্ত বলিষ্ঠভাবে অগ্রসর হয়েছিল। কিন্তু ১৯৬৪ সালে নেহরুর মৃত্যুর পর নিজোট আন্দোলন ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ে। সমস্ত পৃথিবীতে নিম্রোট আন্দোলন দুর্বল হয়ে পড়লেও ভারত তার পররাষ্ট্র নীতির ভিত্তি হিসাবে জোট নিরপেক্ষতাকে ত্যাগ করেনি।