বিশ্ব রাজনীতিতে অন্যতম শক্তি হিসেবে ভারতের উত্থান।
উত্তর:- ভারত হল বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার পর থেকেই বিশ্বের অধিকাংশ রাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক আন্তরিক। ১৯৫০-এর দশকে ভারত আফ্রিকা ও এশিয়ার ইউরোপীয় উপনিবেশগুলির স্বাধীনতার স্বপক্ষে সওয়াল করে। শ্রীলঙ্কায় ভারতীয় শান্তিরক্ষী বাহিনী প্রেরণ ও মালদ্বীপে 'অপারেশন ক্যাকটাস' এই দুই ক্ষেত্রে ভারত ডার প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সামরিক মধ্যস্থতায় অংশ নেয়। কমনওয়েলথের এক সদস্য ভারত, জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনেরও প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। ভারত-চীন যুদ্ধ ও ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের পর সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক আন্তরিক হয়ে ওঠে। ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের অবনতি হয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর একমেরুকেন্দ্রিক বিশ্ব ব্যবস্থায় ভারতের বিদেশনীতি কোন্ পথে পরিচালিত হবে সে বিষয়ে একাধিক মত উঠে আসে।
জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে কাঠামোগত পরিবর্তনের প্রেক্ষিতে বাস্তবসম্মত বিদেশনীতির দিশা দেওয়া ছিল ৯০-এর দশকে নীড় নির্ধারণকারীদের কাছে একটা বড়ো সালেঞ্জ। এই প্রেক্ষাপটে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিবর্তনগুলিকে মাথার রেখে একটি বহুমুখী বিদেশনীতির অভিমুখ প্রস্তুত করা হয়েছিল। সোভিয়েত পতনের ফলে
ভারতীয় বাণিজ্যে বিরাট ঘাটতি দেখা দিয়েছিল। সেটা পূরণ করতে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলির সঙ্গে 'পূবে তাকাও নীতি' নেওয়া হয়। বহুমুখী বিদেশনীতির অভিমুখ। হিসাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বিশেষ সম্পকের উপর জোর দেওয়া, একইসঙ্গে। ব্রিটেন, ফ্রান্স এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্যান্য রাষ্ট্রগুলির সঙ্গে এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের উত্তরসূরী রাশিয়ার সঙ্গেও সম্পর্ক জোরদার করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করতে হয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দ্রকুমার গুজরালের প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলি সম্পর্কে 'গুজ্ঞ্যান্য ডকট্রিন' এবং পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ির 'সম্প্রসারিত প্রতিবেশী নীতির কথা। ভারতের বথমাত্রিক বিদেশনীতিতে রাষ্ট্রপুঞ্জের ভূমিকাকে সবসময় গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। তেমনি উদ্ভূত আন্তজাতিক ইস্যুগুলিকেও গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। যেমন সন্ত্রাসবাদ, পরিবেশ সংরক্ষণ, মানবাধিকার প্রভৃতি।
বিশ্বায়ন, উদারীকরণ ও বেসরকারীকরণের হাত ধরে ভারত আজ চতুর্থ বৃহৎ অর্থনীতিতে পরিণত হয়েছে। উৎপাদিত শিল্পের নিরিখে ভারতের স্থান নবম, মেধার বিচারে তৃতীয়। জি-সেভেন থেকে শুরু করে পৃথিবীর সমস্ত বড়ো আর্থিক গোষ্ঠিতে ভারত আজ অন্তর্ভুক্ত রাষ্ট্রসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে স্থায়ী সদস্য হওয়ার উল্লেখযোগ্য দাবিদার আজ ভারত। ভারতের বিপুল বাজার পৃথিবীর সমও প্রান্তের অর্থনৈতিক ভূমিকা পালনকারীদের আকর্ষণের দেদ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। সামরিক ক্ষেত্রে পরমানু শক্তিধর রাষ্ট্র হিসাবে বিশ্ব রাজনীতিতে ভারতের মর্যাদা বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রযুক্তিগত বিকাশে 'চন্দ্রযান-২' এর মতন অভিযান আন্তর্জাতিক মহলের কাছে ভারত সমীহ আদায় করে নিতে পেরেছে। এরই ফলস্বরূপ সম্প্রতি কাশ্মীর ইস্যুতে শত চেষ্টা করেও পাকিস্তান চীন ছাড়া অন্য কোনো দেশের সমর্থন ভারতের বিরুদ্ধে আদায় করতে পারেনি। কাশ্মীর ইস্যুতে আজ কেবল রাশিয়া-ফ্রান্স নয়, ইংল্যান্ড আমেরিকাও ভারতের সঙ্গে রয়েছে। এমনকি ইসলামিক রাষ্ট্রগুলিও পাকিস্তানের পঞ্চ নেয়নি।
আজকের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ভারতের বিদেশনীতি চারটি লক্ষ্য অর্জনের জন্য পরিচালিত হচ্ছে। এগুলি হল--(ক) আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নীতি নির্ধারণের স্বাধীনতা বজায় রাখা (খ) ভারতের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা (গ) আতি গঠন প্রক্রিয়ার অঙ্গ হিসাবে বিদেশনীতিকে পরিচালিত করা এবং (ঘ) বিশ্বের অগ্রগণ্য দেশগুলির সমান মর্যাদা ও অধিকারের স্বীকৃতি সুনিশ্চিত করা।
পরাধীন ভারতে নেহরুর যে আদর্শবাদী চিন্তার উপর ভারতের বিদেশনীতি একদিন গড়ে উঠেছিল, আজ সেটা দৃঢ় বাস্তববাদী ভাবনার উপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের একশো বছর চর্চাকালের মধ্যে আমরা লক্ষ করছি একদা যে ভারত একটি প্রান্তিক রাষ্ট্র ছিল, সেই ভারত আজ আন্তর্জাতিক আঙিনায় উঠে এসেছে প্রথম দশটি শক্তিশালী রাষ্ট্রের মধ্যে একটি হিসেবে। এই সাফল্য যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের পরবর্তী ৫০ বছর ভারতের লড়াই চলবে প্রথম স্থান অর্জনের জনা। প্রত্যাশা থাকল আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ১৫০ বছর পূর্তির চর্চায় ভারতই থাকবে কেন্দ্রবিন্দুতে।