ব্রিটেন ও মহাদেশীয় ইউরোপের মধ্যে শিল্পায়ন প্রক্রিয়ার পার্থক্য

ব্রিটেন ও মহাদেশীয় ইউরোপের মধ্যে শিল্পায়ন প্রক্রিয়ার পার্থক্য

ব্রিটেন ও মহাদেশীয় ইউরোপের মধ্যে শিল্পায়ন প্রক্রিয়ার পার্থক্য

ব্রিটেন ও মহাদেশীয় ইউরোপের মধ্যে শিল্পায়ন প্রক্রিয়ার পার্থক্য

অষ্টাদশ শতকের শেষে এবং উনিশ শতকের গোড়ায় ব্রিটেনের শিল্পায়নে গতি সঞ্চারিত হয়েছিল এবং শিল্পোৎপাদনে ব্রিটেন স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে উঠেছিল । ১৮১৫ সালে নাগাদ মহাদেশীয় ইউরোপের দেশগুলি অর্থনৈতিক বিকাশের ক্ষেত্রে ব্রিটেনের চেয়ে অনেকটাই পিছিয়ে ছিল । যে বিষয়গুলি ব্রিটেনকে শিল্পায়ন প্রক্রিয়ায় এগিয়ে রেখেছিল, সেগুলি আমরা আলোচনা করেছি । মহাদেশীয় ইউরোপের বিস্তীর্ণ এলাকায় এই সুবিধাগুলি ছিল অনুপস্থিত । তাই মহাদেশীয় ইউরোপে শিল্পের বিকাশ ঘটেছিল বিলম্বিত লয়ে ।



বেশ কিছু ঐতিহাসিক মনে করেন, ফরাসি বিপ্লব ও নেপোলিয়নের যুদ্ধ (১৭৮৯-১৮১৫) ফ্রান্স সমেত মহাদেশীয় ইউরোপের বিভিন্ন স্থানে বিশৃঙ্খলার জন্ম দিয়েছিল । এই বিশৃঙ্খলার ফলে গোটা ইউরোপ জুড়ে এক অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হয়েছিল এবং শিল্প বিকাশের ক্ষেত্রে মহাদেশীয় ইউরোপ এক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছিল । এ কথা সত্যি যে, নেপোলিয়নিক যুদ্ধে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিল ব্রিটেন । কিন্তু ব্রিটেন তার অনুকূল ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে নিজেকে মহাদেশীয় বিশৃঙ্খলা থেকে অনেকটাই সুরক্ষিত রাখতে পেরেছিল । আপেক্ষিক স্থিতিশীলতা ব্রিটেনে শিল্পের অগ্রগতির সহায়ক হয়েছিল । কিন্তু এই যুদ্ধের ফলে কাঁচামালের মূল্য দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছিল, যা ইউরোপের রপ্তানি বাজারে সংকট তৈরি করেছিল । এই প্রক্রিয়া অবশ্যই মহাদেশীয় ইউরোপের শিল্পায়নে বিঘ্ন সৃষ্টি করেছিল ।



সপ্তদশ শতকের অন্তিম লগ্নে ব্রিটেন কিছুটা আর্থিক স্থিতিশীলতা অর্জন করেছিল । তারই পরিণতি ছিল ব্রিটিশ জনসংখ্যার দ্রুত বৃদ্ধি । তবে অষ্টাদশ শতকে ইউরোপের অন্যত্রও জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছিল । কিন্তু ব্রিটেনে জনস্ফীতির হার ছিল অনেক বেশি । জনসংখ্যার এই দ্রুত বৃদ্ধিকেই ঐতিহাসিকরা "জনসংখ্যার বিপ্লব” (Demographic Revolution) হিসাবে অভিহিত করেছেন । জনসংখ্যার এই দ্রুত বৃদ্ধি শিল্পায়নের ক্ষেত্রে ব্রিটেনকে দুভাবে সাহায্য করেছিল-প্রথমত, অভ্যন্তরীণ বাজারে চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছিল; দ্বিতীয়ত, ব্রিটেনের নবগঠিত কারখানাগুলিতে শ্রমিকের জোগান সহজ হয়েছিল। মহাদেশীয় ইউরোপের অন্যান্য দেশ এই সুবিধা পায়নি।



অষ্টাদশ শতকের ইংল্যান্ডে একটা কৃষি বিপ্লব ঘটেছিল। জমিকে গণ্ডিবাধন প্রক্রিয়ার আওতায় নিয়ে এসে এবং কৃষিতে উন্নতমানের প্রযুক্তি ব্যবহার করে ব্রিটেনের ভূস্বামীরা বিপুল হারে কৃষি উৎপাদন বাড়াতে পেরেছিলেন। কৃষিতে উৎপাদন বৃদ্ধি ব্রিটেনের বর্ধিত জনসংখ্যার প্রয়োজনীয় খাদ্য সরবরাহ সহজ করেছিল। একই সঙ্গে কৃষির অগ্রগতির ফলে শিল্পের জন্য কাঁচামালের জোগান স্থিতিশীল রাখা সম্ভব হয়েছিল। কৃষি থেকে আসা উদ্বৃত্ত পুঁজি শিল্পে বিনিয়োগ করা হয়েছিল। তদুপরি গণ্ডিবাঁধন প্রক্রিয়া বা এনক্লোজার ব্যবস্থা বহু গ্রামীণ মানুষকে উৎখাত করেছিল। এই উৎখাত হওয়া গ্রামীণ মানুষেরা দলে দলে শহরে এসেছিলেন শিল্প শ্রমিক হিসাবে কাজে যোগ দেবার জন্য। এ সমস্ত কিছুই ছিল ব্রিটেনের কৃষি বিপ্লবের পরিণতি। কিন্তু অষ্টাদশ শতকীয় মহাদেশীয় ইউরোপে ব্রিটেনের মতো কৃষি বিপ্লব ঘটেনি। ঐতিহাসিক ফিলিস ডীন (Phyllis Deane) মন্তব্য করেছেন-প্রবল জনস্ফীতি এবং কৃষির দ্রুত অগ্রগতি ব্রিটেনকে তার প্রাথমিক শিল্প গড়ে তুলতে সাহায্য করেছিল।



এরিখ হস্বম মনে করেন, বাণিজ্য ও ক্ষুদ্র শিল্পে মহাদেশীয় ইউরোপ ব্রিটেনের চেয়ে খুব বেশি পিছিয়ে ছিল না। পোর্তুগাল থেকে শুরু করে রাশিয়া পর্যন্ত, বিভিন্ন দেশের শাসকরা ও আমলারা অষ্টাদশ শতকের অর্থনৈতিক অগ্রগতির বিষয়ে সচেতন ছিলেন। কিন্তু মাথাপিছু উৎপাদন ও বহির্বাণিজ্যে ব্রিটেন অনেকটাই এগিয়ে ছিল। বহির্বাণিজ্যের সম্প্রসারণ ব্রিটেনকে বিপুল পরিমাণ পুঁজি সঞ্চয়ে সাহায্য করেছিল। এই পুঁজি ব্রিটেনের নতুন গড়ে ওঠা শিল্পে বিনিয়োগ করা হয়েছিল। পল মাস্তু (Paul Mantoux) ব্রিটিশ শিল্পায়নের ক্ষেত্রে বহির্দেশীয় বাজারে ব্রিটিশ পণ্যের বর্ধিত চাহিদার ওপর যথেষ্ট গুরুত্ব আরোপ করেছেন। ব্রিটেনে নগরায়ণের প্রক্রিয়া ছিল দ্রুত। ইংল্যান্ডের শহর ও নগরগুলি মধ্যযুগীয় বৈশিষ্ট্য ঝেড়ে ফেলে আধুনিক অর্থনীতির ওপর দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছিল। ১৮০০ সাল নাগাদ ইংল্যান্ডের মোট জনসংখ্যার ২৫ শতাংশ ছিলেন শহরবাসী। একই সময়ে ফ্রান্সে শহরে বসবাস করতেন মোট জনসংখ্যার ১০ শতাংশ। জার্মানিতে এই শতাংশের হার ছিল আরও কম। ইংল্যান্ডের নগর ভিত্তিক অর্থনীতি শিল্পায়নের অনুকূল পরিস্থিতি তৈরি করতে পেরেছিল। প্রযুক্তির উন্নতি মহাদেশীয় ইউরোপের তুলনায় ব্রিটেনে শুরু হয়েছিল অনেক আগে। উন্নত মানের প্রযুক্তির ব্যবহার ব্রিটেনে শিল্পের বিকাশের পথ প্রশস্ত করেছিল। উৎকৃষ্ট প্রযুক্তির অভাব মহাদেশীয় ইউরোপে শিল্পায়নের গতি শ্লথ করেছিল।



ঐতিহাসিক হস্বম কিন্তু প্রযুক্তির ওপর খুব বেশি গুরুত্ব আরোপ করতে নারাজ। তাঁর মতে প্রযুক্তির ক্ষেত্রে মহাদেশীয় ইউরোপ ব্রিটেনের তুলনায় খুব বেশি পিছিয়ে ছিল না। ইংল্যান্ডের পাওয়ার লুমের তুলনায় ফ্রান্সের জ্যাকার লুম ছিল অনেক বেশি উৎকৃষ্ট মানের। অষ্টাদশ শতকের জার্মানিতে অনেকগুলি প্রযুক্তি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ছিল। শিল্প বিপ্লবের সূচনাপর্বে ব্রিটেনের প্রযুক্তি ছিল অত্যন্ত সরল এবং প্রাথমিক স্তরে। হস্বমের মতে মূলত দু'টি বিষয়ের জন্য ব্রিটেন শিল্প বিকাশে মহাদেশীয় ইউরোপের অন্যান্য দেশকে ছাপিয়ে গিয়েছিল। প্রথমত, ব্রিটেন অন্যান্য দেশের রপ্তানি বাজারে নিজ আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিল। দ্বিতীয়ত, কিছু দেশের অভ্যন্তরীণ প্রতিযোগিতা ব্রিটেন ধ্বংস করেছিল। এই বিষয়গুলিতে ব্রিটেন সাফল্য পেয়েছিল রাজনৈতিক ও আধা রাজনৈতিক উপায় অবলম্বন করে যুদ্ধ ও উপনিবেশ স্থাপনের মাধ্যমে।



ইংল্যান্ড ছিল সমুদ্র বেষ্টিত একটি দেশ। ফলে ইংল্যান্ডের পক্ষে অন্যান্য দেশের সঙ্গে নৌযোগাযোগ অনেক সহজ হয়েছিল। তদুপরি ব্রিটেন একটি অখণ্ড বাজারের দ্বারা লাভবান হয়েছিল। মহাদেশীয় ইউরোপের অন্যান্য দেশ ছিল এই সুবিধা থেকে বঞ্চিত। অসংখ্য শুল্ক প্রতিবন্ধক ফ্রান্সের অভ্যন্তরে পণ্য সরবরাহ কঠিন করে তুলেছিল। ১৮১৫ সাল নাগাদ জার্মানির রাইন অঞ্চলে ১২৪ মাইল যাওয়ার জন্য একজনকে কমপক্ষে ১৯টি রাজনৈতিক সীমান্ত অতিক্রম করতে হত। পশ্চিম ইউরোপের নদী পরিবহন ব্যবস্থা আদৌ উন্নত ছিল না। কিন্তু ১৮০০ সালের মধ্যে ইংল্যান্ডের পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি ঘটেছিল। ফলে ইংল্যান্ডের শিল্পায়ন প্রক্রিয়া সক্রিয় ও গতিশীল হয়েছিল। 




ইংল্যান্ডের ইতিহাসের অন্যতম উল্লেখযোগ্য ঘটনা হল ষোড়শ শতকে জেন্ট্রি শ্রেণির উত্থান। এই জেস্ট্রিরা এক দিকে ঐতিহ্যশালী অভিজাত ভূস্বামীদের সামাজিক ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিলেন, অন্যদিকে ইংল্যান্ডের বিভিন্ন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয় অংশ নিয়েছিলেন। এই জেস্ট্রিরাই ইংল্যান্ডে যৌথ মূলধনী কোম্পানি ও সুদক্ষ আর্থিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার ক্ষেত্রে উদ্যোগ নিয়েছিলেন। অষ্টাদশ শতকের ব্রিটিশ শিল্পপতিরা এই অনুকূল পরিকাঠামোর সদ্ব্যবহার করেছিলেন। সুদক্ষ আর্থিক প্রতিষ্ঠান মহাদেশীয় ইউরোপে এসেছিল অনেক দেরিতে।



ব্রিটিশ সরকারের দীর্ঘদিনের স্বীকৃত নীতি ছিল শিল্প ও বাণিজ্যে কোনো রকম হস্তক্ষেপ না করা। সরকার বরং ব্যক্তিগত বেসরকারি উদ্যোগকে মদত দিত। ব্রিটেনের সরকার উন্নত মানের পরিকাঠামো গড়ে তোলা ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির জন্য বিনিয়োগ করেছিল। কিন্তু অর্থনৈতিক বিষয়ে কখনো সরাসরি হস্তক্ষেপ করেনি। মহাদেশীয় ইউরোপের বিভিন্ন দেশে কিন্তু শিল্পায়নের ক্ষেত্রে সক্রিয় রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ লক্ষ করা গিয়েছিল। ফরাসি বুর্জোয়া শ্রেণির স্বার্থে নেপোলিয়ন বোনাপার্ট একাধিক পদক্ষেপ করেছিলেন। শিল্পে বিনিয়োগে উৎসাহিত করার তাগিদে তিনি বেশ কিছু আইন প্রণয়ন করেন। পরবর্তীকালে জার্মানি ও রাশিয়ার রাষ্ট্র শিল্পের অগ্রগতির জন্য উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ নিয়েছিল।



-বেসরকারি উদ্যোগ ও রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের প্রশ্নটি ব্রিটেন ও মহাদেশীয় ইউরোপের শিল্পায়ন প্রক্রিয়ার মধ্যে একটা মৌলিক পার্থক্য তৈরি করে দিয়েছিল। ব্রিটেনের শিল্পায়ন হয়েছিল বিবর্তনের মাধ্যমে এবং এই প্রক্রিয়ায় বেসরকারি উদ্যোগের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল। কিন্তু মহাদেশীয় ইউরোপে আধুনিক শিল্পায়ন ছিল রাষ্ট্রের সচেতন হস্তক্ষেপের পরিণতি। ১৮৩০-র দশকে ফ্রান্সের শিল্পায়নে গতি এসেছিল। কয়েক বছর পর থেকে জার্মান রাজ্যগুলিতে শিল্পের দ্রুত বিকাশ লক্ষিত হয়েছিল। এই দুই দেশেই শিল্পের অগ্রগতি ছিল চমকপ্রদ। ১৮৩০ থেকে ১৮৭০ সালের মধ্যে ফ্রান্স হয়ে উঠেছিল ইউরোপের শ্রেষ্ঠ লৌহ উৎপাদনকারী দেশ। ১৮৫০ সালের মধ্যে প্রায় ৪৫ লক্ষ যন্ত্রচালিত টাকু ফরাসি কোম্পানিগুলির মালিকানাধীন ছিল, যে সংখ্যা ছিল গোটা ইউরোপে বস্ত্রশিল্পে ব্যবহৃত টাকুগুলির অর্ধেক। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে জার্মানি উৎকৃষ্ট মানের ইস্পাত তৈরির ক্ষেত্রে নতুন কৌশল আয়ত্ত করে দ্বিতীয় শিল্প বিপ্লবে নেতৃত্ব দিয়েছিল। 

About the author

Irisha Tania
"আমি সেই মেয়ে, যে শব্দে বাঁচে। কলম আমার অস্ত্র, আর কাগজ আমার স্বপ্নের আকাশ। প্রতিটি অনুভব, প্রতিটি চিন্তা আমি সাজিয়ে রাখি অক্ষরের গাঁথুনিতে। কখনো গল্পে, কখনো কবিতায়, আবার কখনো নিঃশব্দের ভেতরে। আমি লিখি, কারণ লেখার মাঝে আমি নিজেকে খুঁজে পাই। …

Post a Comment

🌟 Attention, Valued Community Members! 🌟