মৌর্য পরবর্তী যুগের শিল্প স্থাপত্য বিষয়ে আলোচনা করো।Post-Mauryan period art and architecture

মৌর্য পরবর্তী যুগের শিল্প স্থাপত্য বিষয়ে আলোচনা করো।

 মৌর্য পরবর্তী যুগের শিল্প স্থাপত্য বিষয়ে আলোচনা করো।

মৌর্য পরবর্তী যুগের শিল্প স্থাপত্য বিষয়ে আলোচনা করো।


মৌর্যযুগের অব্যবহিত পরে ভারতের রাজনীতিতে বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয়েছিল। তবে সাংস্কৃতিক দিক থেকে সূচিত হয়েছিল এক নব অধ্যায়ের। যা তৎকালীন ভারতীয় কৃষ্টি, শিল্প সংস্কৃতিকে এক অনন্য পর্যায়ে নিয়ে যায়। ফলে প্রাচীন ভারতীয় শিল্প সংস্কৃতির ক্ষেত্রে এক নবযুগের সূচনা হয়। এই সময় ভিন্ন ভিন্ন জাতিগোষ্ঠী স্থানীয় জনসমষ্টির সঙ্গে মিশ্রিত হয়ে একটি অখণ্ড সমাজকাঠামো রচনা করেছিল। ভারতের এই নতুন সমাজ ও সংস্কৃতি শিল্পের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে আত্মপ্রকাশ করে। মৌর্যযুগের পরিচিত কাঠামোর বাইরে এসে নতুন নতুন রাজবংশগুলি যেমন-কাম্ব, শুষ্কা, কুষাণ, সাতবাহন প্রমুখরা শিল্প স্থাপত্যে এক নবধারার সূচনা করে। ফলত সৃষ্টি হয় এক নব অধ্যায়ের শিল্পধারা।


ভারতীয় স্থাপত্য ও ভাস্কর্যের ইতিহাসে শৃঙ্খল্প-কাম্ব যুগ এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়।


এই যুগে শিল্পীরা রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের বাইরে এসে নিজস্ব ধ্যানধারণা ও দৃষ্টিভঙ্গিকে স্বাধীনভাবে বিকশিত করে। ভারহুত স্তূপ নিঃসন্দেহে এ যুগের একটি শ্রেষ্ঠ স্থাপত্য কীর্তি। এই স্তুপটির বর্তমানে অনেকাংশ বিলপ্তির পথে। এই ভারহৃত, বুদ্ধগয়া এবং সাঁচীর তোরণের ওপর নির্মিত মূর্তিগুলিই এ যুগের ভাস্কর্যের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন। ভারসের মূর্তিগুলি তুলনামূলক অপরিণত। তাই এগুলিকে প্রথম পর্বের (খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শায়ার্থীর মাঝামাঝি মনে করা হয়) সাঁচীর মূর্তিগুলি পরিণত। বুদ্ধগয়ার মূর্তিগুলি (খ্রিস্টপূর্ব প্রশ্ন শতাব্দীর শেষ) হয়তো এই দুই প্রান্তসীমার মধ্যবর্তী। এই মূর্তিগুলি সাধারণ মানুষের তুলনায় বৃহৎ আকারের। এই যুগের মূর্তিগুলি দ্বিমাত্রিক। দৈর্ঘ্য, প্রস্থ আছে কিন্তু বেং নেই। ড. নীহাররঞ্জন রায় বলেন, এই শিল্পকে সমসাময়িক ভারতীয় জীবনের উজ্জ্বলগম বলেন।


শুঙ্গাদের শিল্পরীতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য বহুমান রৈখিক ছন্দ। শুধু মানুষের অন্ধ প্রত্যঙ্গই নয়, এখানে উচ্ছ্বসিত সমগ্র ভাসমান জগৎ সেই অপরূপ ছন্দবন্ধনে বাঁধ পড়েছে। তথাকথিত প্রসেনজিৎ স্তম্ভের নালিফগুলি সুধর্মা হলগৃহে চূড়াসহ উৎসবের দৃশ্য, চন্দ্রা প্রভৃতি যক্ষিণী মূর্তিগুলি প্রকৃষ্ট উদাহরণ। ভারহুতের শিল্পীগণ সকল স্তরে মানুষের মধ্যে শিল্পসত্তাকে পৌঁছানোর জন্য তারা সহজ সৃজনমূলক শিল্প শিল্পসত্তার বিকাশ ঘটান। অধ্যাপক সরস্বতী একে 'বর্ণনামূলক শিল্প' বলেছেন।


সাঁচীর স্তূপের ক্ষেত্রে বলা যায় যে, বৃহত্তম স্তূপটি যেটি অশোক ইট দিয়ে নির্মাণ করেছিলেন সেটিকে শৃঙ্গারা পাথর দিয়ে সজ্জিত করে আরো বৃহৎ আকারে গড়ে তোলেন।


শৃঙ্গযুগের শিল্পে ও স্থাপত্য মানুষের ধ্যান-ধারণা, আচার-আচরণ, ধর্মবিশ্বাস, দৈনন্দিন জীবনের এক শিলীভূত ভাষ্য রচনা করেছেন। শুঙ্গ-কাথ শিল্পের অবদান অনেক ব্যাপক, অনেক গভীর ও অনেক অর্থবাহ।


সাতবাহন রাজাদের রাজত্বকাল দক্ষিণ ভারতের ইতিহাসে অতি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এই যুগে রাজনৈতিক ঐক্য প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে স্থাপত্য, ভাস্কর্যেও গঠনমুখী সৃজনধর্মী কর্মকান্ডের অভিব্যক্তি দেখা গিয়েছিল।


অমরাবতী, ভট্টিপ্রোলু, ঘণ্টকশাল, নাগার্জুনীকোন্ডা প্রভৃতি স্থানে বেশ কিছু বৌশ স্তূপ নির্মিত হয়। কালের প্রভাবে এদের কোনোটি আজ আর অক্ষত নেই। তবে পাথরের ফলকে স্তূপের চিত্র থেকে এই অঞ্চলের স্তূপগুলির গঠনাকৃতি কিছুটা পরিচয় পাওয়া যায়। শুভঙ্গযুগের মতো এ যুগের স্তূপেও বেদি, অন্ত, হর্মিকা ও ছত্র-এই চারটি অঙ্গা। পশ্চিমঘাট পর্বতমালার গা কেটে সাতবাহন যুগে বেশ কয়েকটি চৈত্যগৃহ নির্মিত হায়। এদের মধ্যে ভাজা, নাসিক ও কার্লার চৈত্যগ্রহগুলি বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে। ২০ মিটার উচ্চতাবিশিষ্ট সাঁচীর বৃহত্তম স্তুপটির প্রস্তরবেষ্টনী ও তার সুদৃশ্য চারটি তোরণ এই যুগেই নির্মিত। পুণার নিকটবর্তী ভাডার চৈত্যগৃহটি যেন এক প্রলম্বিত কক্ষ। চৈত্যগহে আলো প্রবেশের জন্য তোরণে অশ্বক্ষুরাকৃতি গবাক্ষের সংযোজনা। এই যুগের স্থাপত্র কীর্তির শ্রেষ্ঠ নিদর্শন কার্লার সুন্দর চৈত্যগৃহ। চৈত্যগ্রহটি প্রায় ৩৭.৭৯ মিটার দীর্ঘ, ১৪.৩২ মিটার বিস্তৃত ও ১৩.৭১ মিটার উঁচু। কার্লাতে বিহার নির্মাণ করা হয় পাহাড় কেটে, এগালি একাধিক তলবিশিষ্ট। 



অমরাবতী ভাস্কর্যই এ যুগের নিম্নসাধনায় চরম অভিব্যক্তি ঘটেছে। ঈষৎ সবুজ চুনাপাথরে খোদিত অমরাবতীর ভাস্কর্যে আছে বিব্যয় বৈচিত্র্য। বৃন্দ ও জাতকের কাহিনি, পরিদৃশ্যমান প্রকৃতি ও চলমান জীবনপ্রবাহ এখানে উপস্থাপিত। বুদ্ধের জীবনের বিভিন্ন ঘটনা ও কাহিনি বর্ণিত হয়েছে এই শিল্পসত্তায়।


মৌর্য পরবর্তী পর্যায়ে কুষাণযুগে শিল্প স্থাপত্যের দিকে বিশেষ অগ্রণী ছিল। বর্তমান পেশোয়ারের কাছে শাহ-জী-কী চেরিতে বুদ্ধের দেহাবশেষের ওপর কণিষ্ক যে সুউচ্চ মিনার নির্মাণ করেছিলেন সেটিই নিঃসন্দেহে কুষাণযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ স্থাপত্য কীর্তি। মূলত কাঠের তৈরি ত্রয়োদশতলের মিনারটি উচ্চতায় ছিল ২০৩ মিটার। উত্তরপ্রদেশের মাহেট ও আফগানিস্তানের সূর্যকোটালে কুষাণযুগের দুটি দেবকুলের সন্ধান পাওয়া গেছে। দেবকুল দুটি আয়তাকার, একটি ইটের তৈরি এবং দ্বিতীয়টি ইট ও পাথরের। কণিতের রাজত্বকালে এগেসিলাস নামে জনৈক গ্রিক স্থপতি ছিলেন। তিনি তক্ষশিলার কাছে বৌদ্ধস্তূপ নির্মাণ করেন।


স্থাপত্যের তুলনায় কুষাণযুগের ভাস্কর্যের নিদর্শন প্রচুর। আফগানিস্তান ও পাঞ্জাব জুড়ে বৃহত্তর গান্ধার ও মথুরা অঞ্চলেই কুষাণ ভাস্কর্যের পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটে। গান্ধার ও মথুরায় উভয় শিল্পধারায় অনিবার্যভাবে বৌদ্ধধর্মের প্রভাব এসে পড়েছে। মূর্তি নির্মাণে প্রথমদিকে কালো রঙের ধূসর শ্লেটপাথর ও পরেরদিকে স্টাকো ব্যবহৃত হতে থাকে।


গান্ধার শিল্পরীতিতে অনেকক্ষেত্রেই গ্রিক শিল্পরীতির প্রভাব লক্ষিত হয়। তুলনায় মথুরার ভাস্কর্য দেশীয় শিল্পরীতির প্রাধান্য বেশি। কুষাণপর্বে রাজাদের মূর্তিগুলির মধ্যে কণিষ্কের মুণ্ডহীন মূর্তি বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে। পোড়ামাটি দিয়ে গ্রিক, পারসিক রোমক, শক প্রভৃতি নানা শ্রেণির মানুষের মূর্তি পাটনা ও মথুরা অঞ্চল থেকে প্রাপ্ত হয়েছে।


পরিশেষে বলা যায় যে, মৌর্য পরবর্তী যুগে যে শিল্প স্থাপত্যের ক্ষেত্রে এক নব ধারার সূচনা হয়েছিল, তা নানাভাবে নানাদিক দিয়ে আরো সুদৃশ্যভাবে বিকাশ লাভ করে এবং ভারতীয় শিল্পসংস্কৃতির ঘরানাকে অনেক সমৃদ্ধ করে।


About the author

Irisha Tania
"আমি সেই মেয়ে, যে শব্দে বাঁচে। কলম আমার অস্ত্র, আর কাগজ আমার স্বপ্নের আকাশ। প্রতিটি অনুভব, প্রতিটি চিন্তা আমি সাজিয়ে রাখি অক্ষরের গাঁথুনিতে। কখনো গল্পে, কখনো কবিতায়, আবার কখনো নিঃশব্দের ভেতরে। আমি লিখি, কারণ লেখার মাঝে আমি নিজেকে খুঁজে পাই। …

Post a Comment

🌟 Attention, Valued Community Members! 🌟