আদি-মধ্যযুগের ভারতকে একটি পৃথক পর্যায় হিসেবে দেখা কী যুক্তিযুক্ত Is it reasonable to view early medieval India as a separate phase?

আদি-মধ্যযুগের ভারতকে একটি পৃথক পর্যায় হিসেবে দেখা কী যুক্তিযুক্ত

 আদি-মধ্যযুগের ভারতকে একটি পৃথক পর্যায় হিসেবে দেখা কী যুক্তিযুক্ত

আদি-মধ্যযুগের ভারতকে একটি পৃথক পর্যায় হিসেবে দেখা কী যুক্তিযুক্ত

মানবসভ্যতার ধারা অবিচ্ছিন্নভাবে বহমান। তথাপি পন্ডিতেরা গভীরভাবে আর্থ-সামাজিক পরিবর্তনের প্রেক্ষিতে সাধারণভাবে প্রাচীন থেকে আদি-মধ্যযুগের উত্তরণের ধারা ব্যাখ্যা করেছেন। ভারত ইতিহাসের কালবিভাজন কতটা যুক্তিযুক্ত এবং কালপর্য নিরুপণের ভিত্তি কী হবে এ বিষয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে বিতর্ক আছে। ঐতিহাসিকরা মনে করেন সাধারণভাবে ৬৫০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ভারত ইতিহাসে আদি-মধ্যযুগের সূচনা হয়েছে। উত্তর ভারতে মুসলিম শক্তি প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে আদি-মধ্যযুগের অবসান ঘটে। এবং ভারত ইতিহাসে মধ্যযুগের সূচনা হয়। প্রখ্যাত পণ্ডিত যদুনাথ সরকার তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ "History of Bengal' (Vol-II)-তে মন্তব্য করেছেন এই যুগের অবসান ঘটে ১৭৫৭খ্রিস্টাব্দে পলাশীর যুদ্ধের পর।


প্রাচীনত্ব থেকে মধ্যযুগ অথবা আদি ঐতিহাসিক থেকে আদি-মধ্যযুগে রূপান্তরের ঘটনাকে ঐতিহাসিকগণ Civilization Matrix অবক্ষয়ের নিরিখে বিশ্লেষণ করেছেন। এর পরিপ্রেক্ষিত হিসেবে ঐতিহাসিকগণ সামাজিক সংকট সৃষ্টির বিভিন্ন কারণের আপেক্ষির গুরুত্ব তুলে ধরেছেন। ভারতীয় ইতিহাসের নাগপুর কংগ্রেসের অধিবেশনে ঐতিহাসিক পর্ব হিসেবে আদি-মধ্যযুগের ধারণা ও প্রয়োগ বিশেষভাবে গুরুত্ব পায়। 'আদি-মধ্যযুগ' নামের মধ্য দিয়ে ভারতের ইতিহাসের প্রাক্ পর্যায়ের একটি নিরবচ্ছিন্ন ও পরিবর্তনশীল ধারার ইঙ্গিত পাওয়া যায়। এই সময়কালের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক নতুন নতুন বিকাশমান শক্তিগুলিকে ব্যাখ্যা করে মধ্যযুগের প্রথম বা আদি মধ্যযুগ বা প্রাক্ মধ্যযুগ নামে অভিহিত করা হয়েছে। ড. ব্রজদুলাল চট্টোপাধ্যায় তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ 'The Making of Early Medieval India' গ্রন্থে এ যুগের কয়েকটি পরিবর্তনকে বিশ্লেষণ করেছেন। মধ্যস্বত্বভোগী জমিদার শ্রেণির আবির্ভাব, কৃষকশ্রেণির দুর্দশা, মুদ্রাব্যবস্থার অবনতি, বাণিজ্য ও নগরের অবক্ষয় ইত্যাদি বৈশিষ্ট্যের পরিপ্রেক্ষিতে আদি-মধ্যযুগের আবির্ভাবের বিষয়টি অনুধাবন করা সম্ভব।


সামন্ততন্ত্রের উদ্ভব আদি-মধ্যযুগের সূচনার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। ড. চট্টোপাধ্যায় মনে করেন যে, আদি-মধ্যযুগীয় পরিস্থিতি অনুধাবন করার জন্য সামন্ততন্ত্রের বৈশিষ্ট্যগুলোর ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। অর্থনৈতিক দিক থেকে সামন্ততন্ত্রের মূল কথাই হল মধ্যস্বত্বভোগী জমিদার শ্রেণির আবির্ভাব। অপরদিকে ড. সরকার সামন্ততন্ত্রকে চিরাচরিত ভারতীয় জমিদারপ্রথার সঙ্গে তুলনা করেছেন। তবে কৃষকদের করভার বৃদ্ধি পেয়েছিল এবং ভূম্যাধিকারীগণ জমির মালিকানা কুক্ষিগত করেছিল।


ড. রামশরণ শর্মার মতে, কেন্দ্রীকরণের অভাব আঞ্চলিকতাবাদের প্রসারের কারণে সপ্তম শতকে আদি-মধ্যযুগের সূচনা ঘটে। অধ্যাপক শর্মার মতে, ভূমিদান ব্যবস্থাই ছিল প্রাচীন থেকে মধ্যযুগে রূপান্তরের মূল কারণ। ভূমিব্যবস্থায় ব্যক্তিগত মালিকানা বৃদ্ধির ফলে রাষ্ট্রের ক্ষমতা শিথিল হয়ে পড়ে। যদিও ইউরোপীয় সামন্ততান্ত্রিক মডেলের সঙ্গে ভারতের সামন্ততন্ত্রের মিল ছিল না। এ যুগের বৈশিষ্ট্যই ছিল আর্থ-সামাজিক সংকট সামাজিক বিবর্তনের পাশাপাশি স্থাপত্য, ভাস্কর্য, ভাষা ও সাহিত্যের ক্ষেত্রেও আঞ্চলিক যুগ পরিবর্তনের পূর্বাভাস পাওয়া যায়। সপ্তম শতকের ভারতীয় অর্থনীতি, রাজনীতি, সামাজিক পরিবর্তনের প্রেক্ষিতে এই পর্যায়কে আদি-মধ্যযুগ নামাঙ্কিত করা সম্ভব।


আদি-মধ্যযুগের বৈশিষ্ট্য হিসেবে অধ্যাপক শর্মা ও বি. এন. এস. যাদব ব্যবসা-বাণিজ্য পতন ও নগরের অবক্ষয়ের কারণকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। এছাড়া আঞ্চলিক শক্তিগুলি উথান ও বিকাশকে আদি-মধ্যযুগে সূচনার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হিসেবে গণ্য করা হয়। জ ব্রতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় এই যুগকে মধ্যযুগের প্রস্তুতি পর্ব বলার কারণ হিসেবে বিকাশমান শক্তিগুলির বিকাশকে দায়ী করেছেন। গুপ্ত পরবর্তী যুগে বিভিন্ন আঞ্চলিক মরিচগুলির বিকাশ ঘটে। গুপ্ত পরবর্তী যুগে জাতি ব্যবস্থার ব্যাপকতা আদি-মধ্যযুগের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হিসেবে গ্রহণ করা যায়।


আরব-তুর্কি বিজয়ের কালকে আদি-মধ্যযুগ হিসেবে চিহ্নিত করা হলেও প্রকৃতপক্ষে এটি ছিল রেনেসাঁস যুগ। আরব-তুর্কি সংস্পর্শে ভারতের চিন্তা-মননে চেতনায় পরিবর্তন ঘটে, ভক্তিবাদী চেতনার উদ্ভব ঘটে। তুর্কিদের আগমনের পরবর্তী সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যগুলি আদি-মধ্যযুগের সাংস্কৃতিক সূচনা হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে।


ভারত ইতিহাসে যুগ বিভাজনের কাল নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে যথেষ্ট বিতর্ক আছে। ইতিহাসচর্চা পরিপ্রেক্ষিতে ৭০০-১২০০ খ্রিস্টাব্দ সময়কালকে আদি-মধ্যযুগ বা প্রাক মধ্যযুগ বলাই যুক্তিযুক্ত। ড. নীহাররঞ্জন রায় এই যুগকে মধ্যযুগের প্রথম পর্ব বলে উল্লেখ করেছেন। ইউরোপে যেমন পশ্চিম রোম সাম্রাজ্যের পর সামন্ততান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থার প্রচলন, নতুন সামাজিক সম্পর্ক ইত্যাদি যেমন মধ্যযুগের সূচনা করেছিল তেমনি ভারতীয় ইতিহাসে ষষ্ঠ শতকের পর থেকে অর্থনীতি, রাজনীতি ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে কতকগুলি সুদূরপ্রসারী পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। এই পরিবর্তনই গুপ্ত পরবর্তী সময়কে একটি পৃথক পর্যায় হিসেবে ইতিহাসে স্থান করে দিয়েছে। প্রাচীন ও মধ্যযুগে মধ্যবর্তী সময়কে একটি আদি-মধ্যযুগ তথা একটি পৃথক পর্যায় হিসেবে দেখা যথার্থ ৷

About the author

Irisha Tania
"আমি সেই মেয়ে, যে শব্দে বাঁচে। কলম আমার অস্ত্র, আর কাগজ আমার স্বপ্নের আকাশ। প্রতিটি অনুভব, প্রতিটি চিন্তা আমি সাজিয়ে রাখি অক্ষরের গাঁথুনিতে। কখনো গল্পে, কখনো কবিতায়, আবার কখনো নিঃশব্দের ভেতরে। আমি লিখি, কারণ লেখার মাঝে আমি নিজেকে খুঁজে পাই। …

Post a Comment

🌟 Attention, Valued Community Members! 🌟