ভারতীয় জাতীয় আন্দোলনে আজাদ হিন্দ ফৌজ এর ভূমিকা মূল্যায়ন করো।

ভারতীয় জাতীয় আন্দোলনে আজাদ হিন্দ ফৌজ এর ভূমিকা মূল্যায়ন করো।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় (১৯৩৯-৪৫) ভারতের মুক্তি আন্দোলনের প্ররে কেবলমাত্র ভারতেই সীমাবদ্ধ ছিল না, ভারতের বাইরেও তা সক্রিয় হয়ে ওঠে ৷ ভারতের অভ্যন্তরে 'ভারতছাড়ো' আন্দোলন যেমন পরিচালিত হয়েছিল তেমনি ভারাতের বাইরে সুভাষচন্দ্র বসুর নেতৃত্বে আজাদহিন্দ ফৌজের স্বাধীনতা সংগ্রাম সংঘটিত হয়। দেশে ভারতছাড়ো আন্দোলন যেমন পরিচালিত হয়েছিল তেমনি ভারতের বাইরে সুভাষচন্দ্র বসুর নেতৃত্বে আজাদহিন্দ বাহিনীর স্বাধীনতা সংগ্রাম ব্রিটিশ শাসকদের যেমন বিচলিত করেছিল তেমনি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভিত্তিমূল নাড়িয়ে দিয়েছিল।
সুভাষচন্দ্রের দেশত্যাগ ও আজাদহিন্দ বাহিনীর গঠনঃ ১৯৪১ খ্রিঃ ১৬ জানুয়ারী সুভাষচন্দ্র স্বগৃহে অন্তরীণ অবস্থা থেকে ছদ্মবেশে দেশত্যাগ করেন এবং কাবুল হয়ে তিনি বার্লিনে উপস্থিত হন। সেখানে পৌঁছে সুভাষচন্দ্র জার্মান বিদেশমন্ত্রী বিবেন ট্রপের সাথে দেখা করে তাঁর পরিকল্পনার কথা জানান। তাঁর পরিকল্পনাটি হল বহিঃশক্তির সহযোগিতায় সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে ভারতকে স্বাধীন করা। এই উদ্দেশ্যে ব্রিটিশের শত্রু জার্মান সরকারের কাছে একটি অস্থায়ী জাতীয় সরকার গঠনের প্রস্তাব, একটি - মুক্তিবাহিনী গঠনের অনুমতি, নিজস্ব বেতারকেন্দ্র ও সচিবালয় স্থাপন এবং এসব কাজের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ মঞ্জুরের আবেদন উপস্থিত করলে জার্মান সরকার তাতে সম্মত হয়।
এই বোঝাপড়ার পরিপ্রেক্ষিতে সুভাষচন্দ্র জার্মানির হাতে বন্দি ভারতীয়দের সংগঠিত করে একটি সেনাবাহিনী গঠন করেন এবং বার্লিনে স্থাপিত আজাদহিন্দ বেতারকেন্দ্র থেকে ভারতবাসীর উদ্দেশ্যে প্রথম বেতার ভাষণ দেন। -ভাষণ শেষ ধুনিত হয় 'জয় হিন্দ'। সুভাষচন্দ্রের এই ভাষণ ভারতবাসীকে বিশেষ করে তরুণ ছাত্র ও যুব সমাজকে স্বাধীনতার জন্য উদ্বেল করে তুলেছিল। সুভাষচন্দ্রের দেশপ্রেমের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে হিন্দু, মুসলমান ও শিখ সমস্ত ভেদাভেদ ভুলে সুভাষচন্দ্রের গড়ে তোলা মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিতে শুরু করল।
ভারতীয় যুদ্ধ বন্দিদের একত্রিত করে মালয়ের যুদ্ধবন্দি ক্যাপ্টেন মোহন সিং ও ভারতের জাপানবাসী বিপ্লবী রাসবিহারী বসু জাপান সরকারের অনুমোদনক্রমে ভারতের স্বাধীনতার লক্ষে একবাহিনী গঠন করেন। এর নামকরণ করা হল 'ইন্ডিয়ান ন্যাশানাল আমি' বা 'আজাদ হিন্দ বাহিনী'। ১৯৪৩ সালে ২জুলাই সুভাষচন্দ্রকে আজাদহিন্দ ফৌজ বিপুলভাবে সম্বর্ধনা জ্ঞাপন করেন। ৪ঠা জুলাই সুভাষচন্দ্র 'ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেনডেন্স লীগ' বা ভারতীয় স্বাধীনতা সংঘের এবং আজাদহিন্দ ফৌজের যথাক্রমে সভাপতি ও সর্বাধিনায়ক নির্বাচিত হন। উপস্থিত ভারতীয়গণ সানন্দে তাঁর নেতৃত্ব স্বীকার করেন এবং তাঁকে 'নেতাজী' আখ্যায় ভূষিত করেন।
সুভাষচন্দ্র ভারতে অভিযান পরিচালনার জন্য সামরিক বাহিনী পুনর্গঠন ও অস্থায়ী জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য উদ্যোগী হন। তিনি আজাদহিন্দ ফৌজকে চারটি পৃথক সেনাবাহিনীতে বিভক্ত করেন। এগুলি হল- গান্ধী, আজাদ, নেজরু ও বাঁসীর রাণী লক্ষ্মীবাঈ-এর নামে পরিচিত। জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকল সম্প্রদায়ের মানুষ এসে এই বাহিনীতে যোগ দেন। তাঁর সুদক্ষ নেতৃত্বে অল্পদিনের মধ্যেই এই বাহিনীর সদস্য সংখ্যা তেরো হাজার থেকে পঞ্চাশ হাজারে পৌঁছায়। আজাদহিন্দ ফৌজের শ্লোগান ছিল 'দিল্লী চলো' এবং 'জয়হিন্দ'।
সেনাবাহিনী পুনর্গঠিত করার পর আজাদহিন্দ সরকার গঠনের প্রস্তার সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। পূর্ব-এশিয়বাসীদের প্রতিনিধিবর্গ এবং জনগণের উপস্থিতিয়ে সর্বসম্মতিক্রমের অস্থায়ী আজাদহিন্দ সরকারের প্রধানরূপে শপথবাক্য পাঠ করেন এক এই সরকারের লক্ষ্য হল, ভারতের মাটিতে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটানো।
আজাদহিন্দ বাহিনীর যুদ্ধযাত্রা ও প্রাথমিক সাফল্যঃ ১৯৪৪ সালে ৪ঠা ফেব্রুয়ারি আজাদহিন্দ বাহিনী মার্চ শুরু করে। রেঙ্গুন থেকে যুদ্ধযাত্রার প্রাক্কালে ফৌজের সর্বাধিনায়ক নেতাজী তাঁর বাহিনীর উদ্দেশ্যে এমন ভাষণ দেন যে, যা তাঁর বাহিনীর সেনাবাহিনীদের আমৃত্যু সংগ্রামে অনুপ্রাণিত করেছিল। আজাদহিন্দ ফৌজের পক্ষে তাই একটির পর একটি খণ্ডযুদ্ধে জয়লাভ করে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়েছিল। দেড়মাসের মধ্যে আরাকান, মিয়ামিয়াৎ, কালাদিন, পেনাকট দখল করে আজাদহিন্দ বাহিনী মূল ভারত ভূখন্ডে পৌছায়। এরপর এক রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম করে ব্রিটিশদের হারিয়ে দিয়ে আজাদহিন্দ বাহিনী নাগাল্যান্ডের রাজধানী কোহিমা অধিকার করে নেয়। এবং স্বাধীন ভারতের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন।
মণিপুরের রাজধানী ইম্ফল রক্ষায় ব্রিটিশ বাহিনী যখন মরিয়া তখন আজাদহিন্দ বাহিনী ব্রিটিশ ভারতীয় বাহিনীকে অবরুদ্ধ অবস্থায় দিন কাটাতে বাধা করে। এরূপ পরিস্থিতিতে আজাদহিন্দ বাহিনীর কাছে ব্রিটিশ ভারতীয় বাহিনী যখন আত্মসমর্পনের জন্য বাধ্য করার ক্ষেত্র প্রস্তুত তখন জাপানের কাছ থেকে প্রত্যাশিত বিমান বাহিনী না আসায় বাধ্য হয়ে আজাদহিন্দ ফৌজকে পিছু হঠতে হয়। যুদ্ধের গতি হঠাৎ পরিবর্তিত হওয়ায় সন্তাবা জাপানি সাহায্য এসে পৌঁছায়নি। এশিয়ায় জাপান জমে পিছু হটতে থাকে এবং ১৯৪৫ খ্রিঃ ১৫ আগস্ট জাপান সরকারী ভাবে আত্মসমর্পন করলে আজাদহিন্দ বাহিনীর পক্ষে এককভাবে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি।
এরূপ চরম সংকটে নেতাজী কর্তব্য স্থি করার জন্য মন্ত্রীসভার সাথে পরামর্শ করেন। আজাদহিন্দ ফৌজের আত্মত্মসমর্পণ এবং নেতাজীর নিরাপদ স্থানে যাত্রার সিদ্ধন্ত নেওয়া হয়। ১৭ আগস্ট ১৯৪৫ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে নেতাজী কর্নেল হবিবুর রহমান সহ টোকিওগামী এক জাপানি বোমারু বিমানে যাত্রা করেন। কথিত আছে, এই বিমান দুর্ঘটনায় তিনি মারা যান। তবে এটি বিতর্কিত বিষয়।
আজাদহিন্দ ফৌজের সংগ্রামের প্রভাবঃ
প্রথমতঃ আজাদহিন্দ ফৌজ একটি সামরিক বাহিনীমাত্র ছিল না, এটি ছিল একটি গণ-অভ্যত্থান। ভারতের বাইরে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে একটি স্বতঃস্ফূর্ত রাজনৈতিক আন্দোলন।
দ্বিতীয়তঃ নেতাজীর 'দিল্লী চলো' অভিযান ব্যাহত হলেও ব্যর্থ হয়নি। ভাবতো জনসাধারণ আজাদহিন্দ বাহিনীর কার্যকলাপে মুগ্ধ হয়ে পড়ে। আজাদহিন্দ ফৌজ নিরটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীর মনে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটিয়ে দেয়। শুরু হয় নৌবাহিনীর বিদ্রোহ (১৯৪৬)।
তৃতীয়তঃ আজাদহিন্দ ফৌজ তথা নেতাজীর আত্মত্যাগ যে ভারতবাসীর মনোবল ও আত্মবিশ্বাস বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছিল তার প্রমাণ হল, আজাদহিন্দ ফৌজের বন্দি সেনানীদের বিচারের বিরুদ্ধে দেশবাসীর ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদ। ভারতের সমস্ত রাজনৈতিক দল বন্দি সেনানির নিঃশর্ত মুক্তি দাবি করেন।
চতুর্থতঃ আজাদ হিন্দ ফৌজ ও আজাদহিন্দ সরকার গঠনের মাধ্যমে সুভাষচন্দ্রের লক্ষ্য পূরণ না হলেও সমগ্র এশিয়াবাসীর গণ-চেতনার সম্প্রসারণে এবং প্রাচ্য রাষ্ট্রগুলির মধ্যে ঘনিষ্ঠতার সম্পর্ক রচনায় আজাদহিন্দ আন্দোলনের প্রভাব অনস্বীকার্য।
পঞ্চমতঃ একথা নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে, নেতাজীর নেতৃত্বে আজাদহিন্দ বাহিনীর দুঃসাহসিক প্রচেষ্টা ব্রিটিশ সরকারের নৈতিক পতন ঘটাতে সমর্থ হয়েছিল। আজাদ সেনাদের সমর্থনে উত্তাল ভারতের ভয়ঙ্কর রূপ দেখে ব্রিটিশ সরকার ভারত থেকে প্রস্থান করাই উচিত বলে বিবেচনা করে।
আজাদহিন্দ ফৌজের ব্যর্থতা সত্ত্বেও ভারতের জাতীয় সংগ্রামের ইতিহাসে তার অভিযানের গুরুত্ব অপরিসীম। ভারতের স্বাধীনতা অর্জনে এই বাহিনীর যে পরোক্ষভাবে সাহায্য সক্রিয় ছিল তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। ব্রিটিশ সরকার এই সময় থেকেই স্পষ্টভাবে উপলব্ধি করে যে ভারতের উপর তাদের আধিপত্য বেশি দিন বজায় রাখা সম্ভব নয়। উপরোক্ত প্রভাবগুলি আজাদহিন্দ আন্দোলনের বৈশিষ্ট্যরূপে চিহ্নিত করাও চলে। এরপর থেকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী মনোভাবের পরিবর্তন দেখা দেয় এবং ব্রিটিশ সরকার আগ্রাসী মনোভাব পরিবর্তনে বাধ্য হয়। অর্থাৎ সতর্কতার সাথে চলার নীতি অনুসরণ করে।
তোমাকে অনেক ধন্যবাদ ভারতীয় জাতীয় আন্দোলনে আজাদ হিন্দ ফৌজ এর ভূমিকা মূল্যায়ন করো। Evaluate the role of Azad Hind Fauj in the Indian national movement. এই নোটটি পড়ার জন্য