আদি-মধ্যযুগে (৩০০-৭৫০ খ্রিস্টাব্দ) নারীদের অবস্থা কেমন ছিল তা বর্ণনা করো।
আদি-মধ্যযুগে নারীদের অবস্থা সম্পর্কে জানতে আমাদের হাতে প্রাথমিক ইতিহাস উপাদান স্বভাবতই কম। তবুও বিভিন্ন পৌরাণিক ও সমকালীন সাহিত্য এবং অন্যান্য উৎস থেকে যেটুকু পাওয়া যায় তা উল্লেখ্য। আদিকাল থেকেই কার্যক্রম, বেশভূষা, বিবাহ প্রভৃতি ক্ষেত্রে মানবজাতির দুই প্রধান শ্রেণির মধ্যে বিভাজন ও বৈষম্য লক্ষ করা যায়, যা আজও বর্তমান। এ যুগের সমাজে নারীর অবস্থান নিরূপণে আমরা বিবাহ, শিক্ষা, পর্দা ও সতীপ্রথা, গণিকা, স্ত্রী-র কর্তৃত্ব ও স্ত্রীধন এবং সামগ্রিকভাবে নারী সম্পর্কে সমাজের মনোভাব আলোচনা করতে মেয়েদের বিবাহ প্রসঙ্গে বিয়পরাণে বলা হয়েছে, পাত্রের বয়স হবে পাত্রীর বয়সের নন গুণ। যাজ্ঞবন্ধা, বাল্যবিবাহের কথা বললেও সুশ্রুতের ব্যাখ্যায় তার সমর্থন পাওয়া খানা। আবার অর্থশাস্ত্র ও মনুসংহিতায় যে আট প্রকার বিবাহের কথা আছে তার কিছু প্রথা আদি-মধ্যযুগে অচল হয়ে পড়ে। বাৎসায়ন বাল্যবিবাহ সমর্থক হলেও নারদ ও তারমিহির ছিলেন না। অবশ্য অসবর্ণ বিবাহের প্রমাণ মেলে। আবার 'অভিধান রত্নমালায়' প্রেমের মাধ্যমে বিবাহ সমর্থিত হয়েছে। আদি-মধ্যযুগেও স্বয়ম্বর প্রথা ছিল। পনবিবাহের কথাও আমরা বিভিন্ন শাস্ত্র ও স্মৃতিভাষ্যে পাই। সমষ্টিগতভাবে বলা যায় বিবাহ সম্পর্কে মিশ্র মতামত পাওয়া যাচ্ছে।
বৈদিকযুগ থেকেই বৃহত্তর পরিসরে ভারতে নারী শিক্ষার প্রচলন ছিল না। সংস্কৃত নাটকে দেখা যায় নায়ক সংস্কৃতে কথা বলছেন কিন্তু নায়িকা প্রাকৃত ভাষায় তার প্রত্যুত্তর দিচ্ছেন। এতে নারীদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণই প্রতিফলিত হয়েছে। সমকালীন কতিপয় লড়াকু মহিলার বদ্যাবত্তার সপ্রশংস উল্লেখ আছে বাৎসায়নের কামসূত্রে। রাজশেখরের কাব্য মীমাংসা থেকে জানা যায়, রাজকুমারীগণ, মহামাত্র বা উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের কন্যাগণ রোকোরাও কাব্যতত্ত্ব ও শাস্ত্র রচনায় দক্ষতা অর্জন করেছিলেন। আবার ধোয়ীর পবনদূত কাব্যে মেয়েদের প্রেমপত্র রচনার কিছু ইঙ্গিত পাওয়া যায়। তবে বৃহৎসংহিতায় সর্ববিদ্যাপারদর্শিনী এক ব্রহ্মবাদী নারীর উল্লেখ আছে।
পর্দাপ্রথার ব্যবহার অভিজ্ঞান শকুন্তলমে স্পষ্ট। মেয়েদের পর্দা ব্যবহার সম্পর্কে ফা-হিয়েন নীরব। এরানের স্তম্ভলেখ সতীদাহের প্রমাণ বহন করে। তাছাড়া স্মৃতিশাস্ত্র ও সংস্কৃত সাহিত্যে কঠোরতা ও সংযমের সঙ্গে বৈধব্য জীবনযাপনের ওপর গুরুত্ব আরোপিত হয়েছে। আবার মৃচ্ছকটিকে সতীপ্রথা নিন্দিত। বৃহৎসংহিতা ও কাত্যায়ন স্মৃতি বিধবা-বিবাহের সাক্ষ্য বহন করে। যদিও কৌটিল্য, নারদ ও অন্যান্য স্মৃতিশাস্ত্রকাররা নারীদের ব্যক্তিগত সম্পত্তিকে 'স্ত্রীধন' আখ্যা দিয়েছেন। যা সে পায় বিবাহকালে এবং বিবাহত্তোর জীবনে যদিও তা সামান্যই ছিল।
নারীর প্রকৃত অবস্থান ও মর্যাদা সম্পর্কে আলোচনা তখনই সম্পূর্ণ হবে যখন আমরা গণিকাদের আলোচনা করব। উল্লেখ্য পারিবারিক বন্ধনে বহির্ভূত নারী কর্তৃক অর্থ বিনিময়ে দেহদানের প্রথাকে বলে গণিকাবৃত্তি। মৎস্যপুরাণে গণিকাবৃত্তি আইনসম্মত ছিল। মৃচ্ছকটিকের বসন্তসেনা একজন উচ্চশ্রেণির গণিকা। 'কুটনীমতম্' গ্রন্থ অনুযায়ী কোনো কোনো গণিকা শিক্ষিতা ছিল।
সাধারণভাবে নারীর জীবনের প্রতিটি ধাপে পুরুষের অভিভাবকত্বে থাকায় প্রচলিত প্রথা থেকে আদি-মধ্যযুগের নারীরা সরে আসতে পারেননি। কতিপয় নারীর কথা বাদ দিলে বেশিরভাগজনই ছিল পুরুষ কর্তৃত্বাধীন। কারণ অধিকাংশক্ষেত্রেই মেয়েদের সাধিকার জীবন গ্রহণ বা ধর্মচর্চার বিষয়টি নিন্দনীয় বিবেচিত হত। মুষ্টিমেয় কিছু নারী তা করলেও অনেক এবার বায্যপ্রাপ্ত হয়েছে। এভাবে সমকালীন সাহিত্যের আলোকে দেখা যাচ্ছে যে, প্রাটীন ভারতের ন্যায় আদি-মধ্যযুগেও নারীসমাজ ছিল অবহেলিত। সকমারী ভট্টাচার্য মন্তব্য করেছেন খ্রিস্টীয় পঞ্চম থেকে একাদশ শতকের ভারতবর্ষ ছিল হিন্দ ভারতবর্ষ যেখানে শুদ্র ও নারী ছিল একেবারে নীচুতলার বাসিন্দা। তবে কিছু শাস্ত্রকার নারীদের পক্ষেও ভেবেছিলেন।