ফা-হিয়েন সম্পর্কে আলোচনা কর
ভারতের সঙ্গে চিনের সাংস্কৃতিক আদান-প্রদানের সম্পর্ক অনেক সুপ্রাচীন। এই সাংস্কৃতিক সংযোগ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে চৈনিক পরিব্রাজকদের অবদান ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভারতবর্ষে বিভিন্ন সময়ে বহু সংখ্যক চৈনিক পরিব্রাজক এসে উপস্থিত হন। যাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন ফা-হিয়েন, হিউয়েন সাঙ, ইজিং প্রমুখ। এঁদের মধ্যে ফা-হিয়েন খ্রিস্টীয় প্রথম সহস্রাব্দে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের রাজত্বকালে ভারতবর্ষ পরিদর্শনে আসেন। তিনি ৩৯৯ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন চিনের রাজধানী চান থেকে ভারতবর্ষের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন এবং নানাবিধ অভিজ্ঞতা অর্জনের মাধ্যমে ১৪ বছর পর স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। তিনি ভারতবর্ষের যে সকল অঞ্চলগুলি পরিদর্শন করেন সেগুলি হল-পেশোয়ার, মথুরা, কনৌজ, শ্রাবস্তী, কপিলাবস্তু, বোধগয়া, রাজগৃহ, পাউলিপুর ইত্যাদি।
ভারতবর্ষ সম্পর্কে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা তিনি একটি ভ্রমণ বৃত্তান্তমূলক প্রশ্নে লিপিবল করে গেছেন। গ্রন্থটির নাম হল 'ফো-কো-কি'। এই গ্রন্থটি থেকে তৎকালীন ভারতের বৌদ্ধসংঘগুলির অস্তিত্ব, সেগুলির সঙ্গে জড়িত কিংবদন্তী এবং ভারতবর্ষে বৌদ্ধধর্ম সম্প্রদায়ের বিরাজমানতার প্রমাণ পাওয়া যায়। তবে তাঁর গ্রন্থে ভারতবর্ষের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিষয় গৌণ স্থান অধিকার করেছে। যদিও কোন কোনখানে ভারতীয়দের চরিত্র, অর্থাৎ খাদ্যাভাস, ভাষা এবং ধনসম্পদের কিছু বর্ণনা পাওয়া যায়।
আপনি চাইলে এগুলো পড়তে পারেন
ফা-হিয়েন ভারতবর্ষে থাকাকালীন তিন বছর পাটলিপুত্র নগরীতে অতিবাহিত করেন। তিনি সেখানকার সংস্কৃত ভাষা, দর্শন, সাহিত্য ও ধর্ম অধ্যয়ন করেন। তিনি এই নগরীতে বৌদ্ধমঠের উপস্থিতি দেখেছিলেন। যেখানে হীনযান ও মহাযান সম্প্রদায়ের উপস্থিতি ছিল। তিনি তাঁর গ্রন্থে লিখেছিলেন, এখানকার মানুষরা ছিল ধনী ও সমৃদ্ধশালী। তাদের পরস্পরের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় ছিল। সমাজের সমৃদ্ধশালী মানুষজনেরা বিশেষত ব্যবসায়ীগোষ্ঠী অন্যদের সাহায্যদানের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গঠন করত। তিনি এখানে একটি চিকিৎসালয়ের অস্তিত্বের কথা জানিয়েছেন, যেখানে দুঃস্থদের বিনামূল্যে চিকিৎসা করা হত।
ফা-হিয়েন মধ্য এশিয়ার বিভিন্ন ধরনের সামাজিক ব্যবস্থার কথা উল্লেখ করেছেন। যেমন-লৌলান অঞ্চলের মানুষজন চিনাদের মতো পোশাক পরিধান করত, কিন্তু তারা ভারতীয় রীতিনীতিও অনুসরণ করত। ফা-হিয়েন 'মধ্যদেশ' নামে অভিহিত করেছেন মথুরার দক্ষিণাংশকে। তাঁর মতে, এখানকার মানুষজন খুব সুখে জীবনযাপন করত এবং তাদের করভার ছিল খুব সামান্য। মধ্যদেশের বেশিরভাগ মানুষজন ছিল নিরামিশাষী । দেশের সর্বত্র শান্তিশৃঙ্খলা বিরাজ করত।
উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে ভারতবর্ষ সম্পর্কে ফা-হিয়েনের বিবরণ থেকে একটি পরিশীলিত ধারণা পাওয়া যায়। ফা-হিয়েন তাঁর ভ্রমণ কাহিনি ইতিবৃত্তাকারের জবানিতে জানিয়েছেন। ফা-হিয়েনের ভ্রমণবৃত্তান্তে রাজনৈতিক বিষয় অপেক্ষা সমকালীন সামাজিক ব্যবস্থার পরিচয় বেশি পাওয়া যায়। তাঁর এই রচনার মাধ্যমে চৈনিকদের কাছে ভারতবর্ষ সম্পর্কে একটি সুস্পষ্ট ধারণা জন্মলাভ করে। তাই ইতিহাসের পাতায় ফা-হিয়েন চিরকাল একটি উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো বিরাজমান হয়ে থাকবেন ৷