পরবর্তী বৈদিক যুগে আর্যদের রাজনৈতিক জীবন কেমন ছিল? উত্তর। পরবর্তী বৈদিক যুগে আর্যদের রাষ্ট্রনীতি, সমাজ, অর্থনীতি ও ধর্মীয় জীবন সম্পর্কে আলোচনা কর
অপরপ্রসারী ও উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন দেখা দেয়। এই যুগে আর্যরা উত্তর-পশ্চিম ভারত থেকে পূর্ব-দক্ষিণদিকে অগ্রসর হতে থাকে। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যের পাশাপাশি এই যুগে বৃহৎ জোর উৎপত্তি পরিলক্ষিত হয়। ঋকবৈদিক যুগে অনেক রাজ্য ও গোষ্ঠী গুরুত্ব হারিয়ে ফেলে এবং কুরু, পাঞ্চাল প্রভৃতি নতুন গোষ্ঠী উল্লেখযোগ্য হয়ে ওঠে। পুরাণে বর্ণিত উপজাত গোষ্ঠীগুলি ভেঙে নতুন করে সংমিশ্রিত হয়ে নতুনতর আর্যগোষ্ঠী বা উপজাতি গড়ে তোলে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় যে, ভরত ও কুরুর মিলনে কুরু উপজাতি গড়ে ওঠে।
বিভিন্ন আর্যগোষ্ঠীর মধ্যে যুদ্ধ বৃদ্ধি পায় এবং বৃহৎ রাজ্যের উন্মেষ হতে থাকে। সম্রাজ্যবাদী চিন্তাধারা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। রাজারা অশ্বমেধ যজ্ঞের অনুষ্ঠান করতে থাকে এবং সম্রাট বিরাট সার্বভৌম 'একরাট', 'বিশ্বজয়ী' প্রভৃতি উপাধি ধারণা করতে থাকেন। রজার ক্ষমতা ও মর্যাদা বৃদ্ধি পায় এবং তারা দৈবসত্ত্বের দাবি করতে থাকে। 'শতপথব্রাহ্মণে' বলা হয়েছে যে, রাজা হলেন প্রজাপতি বা ব্রহ্মার সাক্ষাৎ প্রতিনিধি। এই যুগে রাজাকে ইন্দ্র, বরুণ, অগ্নি, বায়ু প্রভৃতি দেবতার শক্তিতে বলবান বলা হত। ব্রাহ্মণ ছাড়া সবার উপরে রাজার সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা হয়েছিল তিনি ইচ্ছামতো মানুষের উপর অত্যাচার ও শূদ্রদের হত্যা করতে পারতেন। 'শতপথব্রাহ্মণে' বলা হয়েছে যে, রাজা হলেন অভ্রান্ত এবং সকল শাস্ত্রের ঊর্ধ্বে।
এই যুগে 'সভা', 'সমিতির' অস্তিত্ব বিদ্যমান ছিল। রাজাকে বিভিন্ন কাজে সভা-সমিতির অনুমোদন নিতে হত। অথর্ববেদে নির্বাচিত রাজতন্ত্রের উল্লেখ আছে। কিন্তু এসত্ত্বেও এই যুগে রাজার ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় এবং সভা-সমিতি তাদের পূর্ব গৌরব বহুলাংশে হারিয়ে ফেলে। ড. ব্যাসাম বলেন যে, পরবর্তী বৈদিক যুগে রাজার সৈন্যক্ষমতার ওপর বিশেষ কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না। ব্রাহ্মণের বিশেষ অধিকার ও জনমত রাজার ক্ষমতাকে কিছুটা নিয়ন্ত্রিত করত। অপরদিকে ডি. ডি. কৌশাম্বি ও অন্যান্য ঐতিহাসিকরা মনে করেন এই যুগে রাজারা স্বৈরাচারী ছিলেন না। কারণ-
(১) নির্বাচনের মাধ্যমে রাজন্যবর্গের নিয়োগের কথা তখনও কিছুটা প্রচলিত ছিল।
(২) রাজপদ তখনও সম্পূর্ণ বংশানুক্রমিক না হওয়ায় জনগণের মতামতের দাম ছিল এবং জনগণ স্বৈরাচারী রাজাকে বিতাড়িত করতে পারত।
(৩) সিংহাসন লাভের পূর্বে রাজাকে অঙ্গীকার করতে হত যে, তিনি প্রজা পালনেও রাজ্যের কল্যাণে জীবন উৎসর্গ করবেন।
(৪) ব্রাহ্মণরা রাজার অভিষেক সম্পাদন করত। সুতরাং, ব্রাহ্মণদের উপেক্ষা করা রাজাদের পক্ষে কখনই সম্ভব ছিল না।
(৫) 'সভা' 'সমিতিকে' একেবারে উপেক্ষা করা রাজার পক্ষে সম্ভব ছিল না।
(৬) পবিত্র বিধান অনুসারে রাজাকে দেশশাসন করতে হত-এগুলির ব্যাখ্যা করতেন। ঋষিরা।
এইসব কারণে রাজার পক্ষে স্বৈরাচারী হওয়া সম্ভব ছিল না। যদিও এযুগে রাজার। ক্ষমতা বহুল পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছিল।
রাজ্যের আয়তন বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে শাসনকার্যের জটিলতা বৃদ্ধি পায়। ঋবৈদিক যুগে কর্মচারীরা ছাড়াও নতুন পদ সৃষ্টি হয়। সেগুলি হল-সংগ্রাহীত্ব (কোষাধ্যক্ষ), ভাগদুৎ (কর আদায়কারী), সূত (রাজকীয় পোষক), গোণিবকর্তন (স্বীকারের রাজসঙ্গী) প্রভৃতি। এইযুগে প্রাদেশিক শাসনব্যবস্থার সূচনা হয়। স্থপতি ছিলেন সীমান্ত অঞ্চলের ভারপ্রাপ্ত কর্মচারী। শতপতি ছিলেন একশোটি গ্রামের ভারপ্রাপ্ত, গ্রামণী ছিলেন গ্রামের প্রধান।
এই যুগের কোষাধ্যক্ষ ও কর আদায়কারী নামে রাজস্ব আদায়ের জন্য দুজন কর্মচারী নিযুক্ত হয়। 'বলী' ও 'শুল্ক' নামে দু'ধরনের রাজস্ব আদায় করা হত। ব্রাহ্মণ ও রাজপরিবারের সদস্যদের কোনো রাজস্ব দিতে হত না। জনসাধারণই তা বহন করত। বিচারব্যবস্থায় রাজাই ছিলেন সর্বেসর্বা। যদিও তিনি সর্বদা বিচারকার্য পরিচালনা করতেন না। বিচারের দায়িত্ব ছিল অধ্যক্ষের উপর। অনেক সময় মুষ্টিমেয় সভাসদদের দ্বারা গঠিত বিচারকর বিচার করত। গ্রামে ছোটোখাটো বিচার করত গ্রাম্য বিচারক ও তার সভা। অনেক সময় মারাত্মক অপরাধীকে আগুনের মধ্যে দিয়ে যেতে হত। দেওয়ানি মামলা সাধারণত সালিসির মাধ্যমে মীমাংসা হত।