সপ্তদশ শতকে ইউরোপে কোন কোন ক্ষেত্রে সংকট দেখা দিয়েছিল অথবা,ইউরোপীয় অর্থনীতিতে সপ্তদশ শতকের সংকট বলতে কী বোঝ?
সপ্তদশ শতক হল এক সংকটের কাল ৷ ভলতেয়ার মনে করেন যে সমগ্র সপ্তদশ শতক জুড়ে শুধু ইউরোপেই নয়, পৃথিবীর সর্বোচ্চ বিদ্রোহ ও অভ্যুত্থান ঘটেছিল । সপ্তদশ শতকের প্রথমার্ধে স্টুয়াট রাজাদের সঙ্গে পার্লামেন্টের বিরোধ চলেছিল ,স্পেনের সঙ্গে ফ্রান্সের যুদ্ধ, সুইডেন ও পোল্যান্ডের বিরুদ্ধে ও রাশিয়ার ক্ষতি করেছিল এই শতাব্দি ধরে ইউরোপের বহু দেশে কৃষক বিদ্রোহ ছিল অনেক শহরে অভ্যুত্থান ঘটেছিল ৷ এই সামগ্রিক সংকটের দুটি দিক হল রাজনৈতিক এবং আর্থসামাজিক ৷ জলবায়ুর পরিবর্তনের (ক্ষুদ্র তুষার যুগ) জনসংখ্যা বৃদ্ধি, খাদ্যাভাব মহামারী এবং যুদ্ধবিগ্রহ এই সংকট সৃষ্টি করেছিল ৷
অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন সপ্তদশ শতকের সংকর স্বতন্ত্র কোনো ঘটনা নয়, ইউরোপে বহুকাল ধরেই বহু ধরনের সংকট ছিল ৷ প্রাক আধুনিক যুগ কখনো সংকটমুক্ত ছিল না । এসব ঐতিহাসিকদের মধ্যে অন্যতম হলেন পিয়ের গুবার, রোনাল্ড মুসনিয়ে এবং জন ইলিয়ট সংকটের মধ্যে এরা ইংল্যান্ডের গৃহযুদ্ধ, ফ্রান্সের ধর্ম যুদ্ধ এবং হল্যান্ডের স্বাধীনতা যুদ্ধকে স্থান দিয়েছে । ইলিয়ট মনে করেন সংকটের ধার ষোড়শ শতক থেকে চলে এসেছিল , অষ্টাদশ শতকের বিপ্লবে তা পরিপূর্ণতা লাভ করেছিল ৷
সামগ্রিক সংকটকে বিভিন্নভাবে ভাগ করলে দেখা যায় (১). কিছুর সংকট (২) আবহাওয়ার পরিবর্তন যা উৎপাদন ব্যবস্থাকে বিশেষ আহত করে এবং যার ফলস্বরূপ রুটির দাঙ্গা, মহামারী প্রকট আকার ধারণ করে ৷ কিছু ব্যবস্থার ওপর এই সংকট বিশেষ আঘাত হয়ে দাঁড়ায় ৷ জনসংখ্যার সংকট সমগ্র ইউরোপ জুড়ে যুদ্ধবিগ্রহ রাজনৈতিক মহলকে জটিল করে তোলে ,অশান্তির জনজীবনের স্থিতিকে বাড়িয়ে দেয় যদিও কেন্দ্রীভূত রাজতান্ত্রিক সমাজ জীবনের স্বাভাবিক রূপই ছিল অশান্তি । বদেল লাদুড়ি, ক্রীড়া য়ান-ডে ব্রিজ প্রমুখ ও ঐতিহাসিকদের মতে ষোড়শ শতকের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার জন্য খাদ্যের যোগান দিতে গিয়ে ইউরোপীয় কৃষি ক্ষেত্রের উপর যে চাপ পড়ে তার দীর্ঘকালীন সমাধানের প্রচেষ্টা থেকে জন্ম নিয়েছিল ৷ ম্যালাথাসের তথ্য অনুযায়ী অর্থনীতি শুধুমাত্র কৃষিকে কেন্দ্র করে বৃদ্ধি পেলে উর্ধ্বমুখী জনসংখ্যার কাছে তার গতি একটি নির্দিষ্ট কেন্দ্রবিন্দুতে স্থির হয়ে ৷ যায় সপ্তদশ শতকের অর্থনীতি এই মতবাদের এক উল্লেখযোগ্য পটভূমি হয়ে উঠেছিল ৷
ম্যালাথাসের তত্বকে আলোচনা করে বলা যায় যে কৃষির বর্তমান সংকট যা সঠিকভাবে সংকটকে দৃঢ়বদ্ধ করে তোলে সেই বিচ ১৬ শতকের সীমাহীন প্রাচুর্য ও বিস্তারের মধ্যে নিহিত ছিল জমির উপর বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা বৈজ্ঞানিক অত্যাধুনিক কলা কৌশলের যৌথ প্রয়োগ জমির স্বাভাবিক উর্বরতা কে নষ্ট করে দেয়। খাদ্যশস্যের মূল্য বৃদ্ধির হার সর্বত্র সমান ছিল না, যা ১৬ শতকের সর্বোচ্চ এক ছিল এর ফলে জমির মূল্য অস্বাভাবিকভাবে হাঁস পেতে শুরু করে এবং জমিতে বিনিয়োগকারীদের ভাগ্যে ও পতন ঘনিয়ে আসে ৷
কৃষি বিপর্যয় বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন সময়ে ঘটেছিল নিবিড় কৃষিকাজে প্রবণতার পাশাপাশি ব্যাপক কৃষিকাজও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে প্রাধান্য লাভ করে ৷ কৃষির প্রয়োজনে জলাভূমিকে বন্ধ করে বোন পরিষ্কার করে উচ্চভূমিকে ঢাল হিসাবে ব্যবহার করে এই ভাবেই অতিরিক্ত সমতল আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ বাড়ানো হতো বিভিন্ন দেশে "স্টক ফার্মিং" বা যৌথ প্রথা ও চালু করা হয় ৷
সংকটের সার্বিক রূপ থাকা সত্বেও ইংল্যান্ড পরবর্তীতে এই পরিস্থিতির সঙ্গে নিজের অবস্থার ও পরিবর্তন ঘটিয়েছিল । তবে সপ্তদশ শতকের কৃষির পরিবর্তন ব্যবস্থা সমাজ জীবনে এক শ্রেণীর ভবঘুরে সম্প্রদায়ের সৃষ্টি করে গ্রামীন ইংল্যান্ডে পূর্বের নেয় ক্ষমতার বিন্যাস ব্যবস্থা সৃষ্টি হয় । যেখানে জন্মস্থান অবস্থার একমাত্র ধারক ও বাহক ৷
ফ্রান্সের ক্ষেত্রে পরিবর্তন আসে একটু অন্যভাবে ৷ যেহেতু ফ্রান্সের সামন্ততন্ত্রের খুঁটি প্রবল ও দৃঢ় আকার ধারণ করেছিল তাই সামন্ত প্রভুরা এই ক্ষেত্রে তাদের ক্ষমতার দীর্ঘকরণের কোনো স্মৃতিশীলতা দেখায়নি। ৷ বরং বিভিন্ন রাজস্ব বা জমির উপর ভাড়া পুরোপুরি ১৫% বৃদ্ধি করেছিল ক্রমাগত যুদ্ধ বিগ্রহের খরচ মেটানোর জন্য ভূমিদাসের ওপর গথিত মূল্যের কর আদায় করা হতো । এর ফলস্বরূপ গ্রামে জনশূন্যতা এবং ভূমিদাস দের পলায়ন নিয়মিত চিত্র হয়ে ওঠে, ৷ ফ্রান্স, ইতালি ,স্পেন ,জার্মানি ও পূর্ব ও মধ্য ইউরোপের ও ভূস্বামী এবং সামন্ত প্রভুরা নিজেদের ক্ষমতা পুনর্গঠন ও দীর্ঘকরণের মাধ্যমে কেন্দ্রীভূত করে ৷
ঐতিহাসিকরা সপ্তদশ শতকে ঠান্ডা বা কোল্ড স্পট বলে উল্লেখ করেন । যা ইউরোপ মহাদেশকে বরফের যুগে পরিণত করে ৷ সমসাময়িক মতামত অনুসারে বলা যায় যে সমগ্র শতক জুড়ে পর্যাপ্ত সূর্যকিরণের অভাবে পোল্যান্ড, হেডলিয়াস ,ফ্রান্সের ক্যাশিলি এবং ইংল্যান্ডের লক্ষ্য করা যায় ৷ সমসাময়িক নিদর্শন ও নির্ভরযোগ্য তথ্য ছাড়াও রেডিও কার্বনিক পরিমাপক সঞ্চয় প্রমান দেয় যে ১৭ শতকে মহাদেশের বিস্তীর্ণ পান্থরে সুযোগীকরণের অভাব ছিল ৷ এইভাবে পর্যাপ্ত সৌর শক্তির অভাব কৃষিকার্য ও ফলনের ওপর মারাত্মক তথা ধ্বংসাত্মক প্রভাব ফেলে ৷
কিছু নির্দিষ্ট স্থানীয় রোগব্যাধির উপদ্রব বৃদ্ধি পায় যা কালক্রমে এ মহামারী রূপ বা আকার ধারণ করে ৷ যা এই সপ্তদশ শতকের নিয়মে পরিণত হয় । টিউব্লেনিক প্লেগ ,টাইফয়েড, জলবসন্ত ,ইনফ্লুয়েঞ্জা ১৬০৫,১৬ ১৬২৫ এবং ১৬৩৯ সাল নাগাদ ঘটে ৷ স্পেনের অর্থনীতির কেন্দ্রবিন্দু ইতালির বিভিন্ন জায়গার রোগ আকাল ও মহামারীতে আক্রান্ত হয় ৷ ১৭ শতকের ত্রিশের দশকে ১৬২৩ থেকে ২৫ সাল নাগাদ লন্ডন এবং আমস্টারডাম বিপর্যয়ের কবলে পড়ে, ১৫৩৫ থেকে ১৫৩৬ এবং ১৫৫৫ থেকে ৬৪ সাল তার পুনরাবৃত্তি ঘটে ৷
আর্থিক উন্নতি ও জনসংখ্যার বৃদ্ধির সীমারেখা ১৭ শতকে হ্রাস পাই ৷ ক্রমাগত যুদ্ধবিগ্রহকে এই বিপর্যয়ের মূল ও অবধারিত কারণ বলে মনে করা হয় । জার্মানিতে ৩০ বছরের যুদ্ধ তার অর্ধেক জনসংখ্যার ঘাটটির জন্য দায়ী ছিল ৷ ১৬১১ সালের সুইডেন ও ডেনমার্কের যুদ্ধ, ১৬৬৪ থেকে ৬০ সাল নাগাদ সুইডেন ও পোল্যান্ডের যুদ্ধ, স্পেন ও হল্যান্ডের যুদ্ধ ইংল্যান্ড ও হল্যান্ডের যুদ্ধ, স্পেন ও ফ্রান্সের যুদ্ধ প্রকৃতপক্ষে জনসংখ্যার হ্রাসের ফলো বাহি যুদ্ধ ছিল ৷
১৬০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৬৫০ এর অর্ধ শতকের ইতালির জনসংখ্যা ১৩.৩ মিলিয়ন থেকে ১১.২ মিলিয়ন হাস পেয়েছিল । ১৫৯২ থেকে ১৬৫০ সালের মধ্যে স্পেনের জনসংখ্যা ৭.৭ মিলিয়নের নিচে নেমে এসেছিল । ফ্রান্সের জনসংখ্যা ও ২০ শতাংশ হ্রাস পেয়েছিল ৷ যুদ্ধবিগ্রহ বাদ দিলেও স্থানীয় বিপ্লব ও প্রতিবাদী আন্দোলন গৃহযুদ্ধ ও জনসংখ্যার হাঁসের অন্যতম কারণ বলে গণ্য হয় । তবে জনসংখ্যা হ্রাস ও বৃদ্ধির প্রবণতা ১৬ শতকের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সংকুচিত হয়েছিল ৷ এছাড়াও জনসংখ্যা রোধের জন্যই ইতিবাচক নিয়ন্ত্রণ যথা অবিদ বয়সে বিবাহ ইউরোপের বিভিন্ন প্রান্তে জনপ্রিয়তা লাভ করেন ৷ যা জাঁ-দা-ভ্রিজ এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন
১৬ শতকের ইউরোপের আর্থিক ব্যবস্থার বাস্তবিকই আন্তর্জাতিক মানের হয়ে উঠেছিল যার প্রধান ধারক ও বাহক ছিল এশিয়া ও আমেরিকার সঙ্গে বহিরবাণিজ্য ৷ মহাদেশের অভ্যন্তরীণ বালটিক ও ভূমধ্যসাগর কে কেন্দ্র করেও লাভজনক ব্যবসায়িক শাখা-প্রশাখা বিস্তার লাভ করে যা অন্তবর্তী রাজ্যগুলিকে এবং সাগর পাড়ের সাম্রাজ্যের কাছে সমান প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্বপূর্ণ ছিল । কিন্তু পরিসংখ্যানগত দিক থেকে বিচার করলে সতেরো শতকের বাণিজ্যের অবনতি ও ক্রমহ্রাসমান চিত্ত ফুটে ওঠে ১৬৪০ থেকে ৫০ সালের মধ্যে মোট স্পেনীয় বাণিজ্যের মূল্য ছিল ২২ হাজার ৫২৮ টন, কিন্তু ১৭০১ থেকে ১৭১০ সালের মধ্যে তা হাস পেয়ে দাঁড়ায় ৪৯৫০ টন ৷ পর্তুগাল এবং এশিয়ার বাণিজ্যের জন্য ৬৯ টি জাহাজ এশিয়ার উপকূল ও লিজবনের মধ্যে চলাচল করতো । ১৬০১ থেকে ১০ সালের মধ্যে ১৬৯০ সালের এর সংখ্যা হ্রাস পেয়ে দাঁড়ায় ২৫ ৷ পর্তুগাল স্পেনের উপনিবেশ ও সাম্রাজ্য বিস্তার এই শতকের ক্রমান্বয়ে পতনের দিকে যেতে শুরু করে ,যার কোনোভাবেই পরবর্তীকালে পুনরুত্থান ঘটেনি ৷ ইতালির ক্ষেত্রেও ভূমধ্যসাগর কেন্দ্রিক বাণিজ্যে যথেষ্ট অবনতি লক্ষ্য করা যায় ৷
১৭ শতকে ঋণ সরবরাহের ক্ষেত্রেও বিশেষ ঘাটতি বা সংকটের সময় বলে চিহ্নিত করা হয় । আমেরিকার সঙ্গে বাণিজ্যের ঘাটতি এবং যথাযথ রোপোতালের আমদানি বন্ধ হয়ে যাওয়াকেও অনেকে এর জন্য দায়ী করেন । সোনার উপর আমদানি ও প্রাধান্য ষোল শতকের ইউরোপের আর্থিক জ্বালানির কাজ করেছিল ৷ তামার মুদ্রার ব্যবহার ও তার অবক্ষয় কুড়ি সালের পর মুদ্রা সংকটের সূচক হয়ে ওঠে ৷ ক্রমাগত যুদ্ধ ও স্পেশাদারী সৈন্যের খরচ সরকারের ওপর অতিরিক্ত আর্থিক চাপ সৃষ্টি করে এবং আর্থিক পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তোলে ৷ মুদ্রা সরবরাহ যেমন স্পেনের সমস্যাকেও জটিল করে তুলেছিল অন্যদিকে আবার অর্থনৈতিক মহামানদা তীব্র আকার ধারণ করে মুদ্রা সরবরাহ প্রাচুর্য হ্রাস পায় ৷ কৃষির লাভ বংশ হ্রাস জমির মূল্যের হ্রাস বা মূল্যবান হ্রাস প্রাপ্ত হওয়া খাদ্যশস্যের দাম বেড়ে যাওয়া প্রভৃতির ঋণ অর্থনীতিকে অরাজকতার দিকে ঢেলে দেয় ৷
চরম রাজতন্ত্রের সূচনা ও বুর্জোয়া কেন্দ্রিক প্রজাতন্ত্র ছিল ১৭ শতকের রাজনৈতিক মানচিত্রের প্রকৃত ছবি ৷ প্রাগ আধুনিক যুগের রাষ্ট্রীয় মানচিত্রে চরম এককেন্দ্রিক রাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে হয় যার ব্যবহারে ছিল আজীবিক । জাঁকচমক আরম্ভন ও ক্রমাগত মুদ্রার সরবরাহ ছিল যার মূল বৈশিষ্ট্য ৷ আমলাতান্ত্রিক নিয়মিত সৈনিকদের ব্যবহার বহন ছিল জাতীয় সম্বন্ধে সুযোগ এই পটভূমিতে আর্থিক অবস্থা একসময় প্রচণ্ড চাপের সম্মুখীন হয় । সরকারের বা রাষ্ট্রের খরচের সিংহভাগে সৈন্য সামন্ত নির্বাহের জন্য নির্দিষ্ট থাকতো রাজস্বের অধিকাংশ যুদ্ধবিগ্রহের কাজে ব্যয় করা হতো সমগ্র শতাব্দী জুড়ে যুদ্ধের বিভিন্ন সময়সূচিতে শান্তির যুগের জন্য খুব স্বল্প পরিসর এনে দিয়েছিল।
তোমাকে অনেক ধন্যবাদ সপ্তদশ শতকে ইউরোপে কোন কোন ক্ষেত্রে সংকট দেখা দিয়েছিলঅথবা,ইউরোপীয় অর্থনীতিতে সপ্তদশ শতকের সংকট বলতে কী বোঝ? এই নোটটি পড়ার জন্য