নব্য রাজতন্ত্র বা Neo-monarchy বলতে কী বোঝো
পঞ্চদশ শতক থেকে সপ্তদশ শতকের মধ্যে ইউরোপে মূলত পশ্চিম ইউরোপে এক নতুন ধরনের রাষ্ট্র ব্যবস্থা জন্ম লাভ করে ৷ এই রাষ্ট্র পুরাতন সামন্ততান্ত্রিক রাজ্যগুলি থেকে যেমন পৃথক প্রকৃতির ছিল তেমনি এই নতুন ব্যবস্থা রাজতন্ত্র বা শাসক শ্রেণী পুরাতন সামন্ততান্ত্রিক রাজ্যের অপেক্ষা অনেক বেশি শক্তি অর্জনের সমর্থ হয় । ক্ষমতার কেন্দ্রিকরণ বৃহৎ স্থায়ী সৈন্য বাহিনী গঠন একটি দক্ষ আমলাতন্ত্র রূপায়ণ ইত্যাদির মধ্য দিয়ে যে নতুন ধরনের রাষ্ট্র ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল তা নব্য রাজতন্ত্র বা Neo-monarchy নামে আখ্যায়িত হয়ে আছে ৷
আপনি চাইলে এগুলো পড়তে পারেন
এই নব্য রাজতান্তিক ব্যবস্থায় রাজ্যের রাষ্ট্রীয় উৎপাদনের এক বৃহৎ অংশ আত্মসাৎ করে শক্তিশালী রাষ্ট্রতন্ত্র গঠনে উদ্যোগী হয় ৷ এই নতুন ধরনের রাষ্ট্রতন্ত্র পূর্ববর্তী রাষ্ট্র তন্ত্রের থেকে বহু অংশে ছিল পৃথক ইংল্যান্ডের সপ্তদশ হেনরির হাত ধরে শক্তিশালী এই নব্য ব্যবস্থা বিকশিত হতে শুরু করে ৷ ঐতিহাসিক ব্রদেল বলেছেন এই নব্য রাজতান্ত্রিক শাসকরা এক বৃহৎ রাষ্ট্র ব্যবস্থা উপস্থিত করেছিলেন অধরা বিভক্ত সামন্ত আধিপত্য ক্ষুন্ন করে এই নতুন বৃহৎ রাষ্ট্র সম্প্রসারিত হতে শুরু হয় ৷" ব্রদেল আরো বলেন ইংল্যান্ডে হেনরি, ফ্রান্সের লুই এবং স্পেনে ফার্দিনান্দ যে নতুন রাষ্ট্রতান্তিক কাঠামো জন্ম দিয়েছিলেন তার মধ্য দিয়েই নবজাগরণ, ধনতন্ত্র এবং বিজ্ঞান বিপ্লবের পথ প্রস্তুত হয় ৷
নব্য রাজতন্ত্র বিকশিত হবার ক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায় ছিল সামন্ততান্ত্রিক রাজাদের বিরোধিতা ৷ কারণ সামন্ত প্রভুরা নিজ নিজ অঞ্চল তাদের কর্তৃত্ব এবং আধিপত্য বজায় রাখতে অতি উদ্রগী হয়ে ওঠেন । ফলে সামন্ত প্রভুদের সঙ্গে রাজাদের সংঘাত অনিবার্য হয়ে ওঠে ৷ তবে ব্রদেল ইউরোপের বহু নব্য রাজা সামন্ত রাজাদের সঙ্গে সরাসরি সংঘাতের পথে না গিয়ে সামন্ত প্রভুদের রাজসভার সোনালী খাঁচায় বন্দী করে রেখেছিলেন ৷ তবে সামন্ততন্ত্রকে অপসারিত করে নতুন রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় সহায়ক ভূমিকা পালন করেছিলেন তদানীন্তন উদীয়মান ও ব্যবসায়ী শ্রেনিরা ৷
ইউরোপ জুড়ে গড়ে ওঠা নব্য ব্যবস্থা কেবলমাত্র রাজনীতি এবং সামরিক ক্ষেত্রে এই নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখেনি ৷ বরং বৃহৎ রাষ্ট্র জুড়ে একই ধরনের আইন শাসন বিচার ব্যবস্থা গড়ে তুলে রাষ্ট্রের সামগ্রিক অর্থনীতির বিকাশে মনোনিবেশ করেন ৷ কারণ নব্য রাজারা বুঝেছিলেন সামন্ত প্রভুদের দমন করে বৃহৎ এবং শক্তিশালী রাষ্ট্র ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠাকাল্পে এক উন্নত আর্থিক পরিক কাঠামো একান্তই প্রয়োজনীয় ৷ আর এই উদ্দেশ্যেই বিশৃঙ্খলার পরিবর্তে শান্তি শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা ছিল একান্ত ভাবে প্রয়োজনীয় ৷ এই শান্তি শৃঙ্খলা পরিবেশ অর্থনীতির জন্য ছিল অপরিহার্য তা রাজনৈতিক স্থিতি প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বিভিন্ন বাধা অপ্রসারিত করে নতুন রাস্তা বা বাণিজ্য ও যোগাযোগের পথ নির্মাণ করা হয় । ওজন পরিমাপের ক্ষেত্রে সমনীতি প্রবর্তন করা হয়, মুদ্রা ব্যবস্থা সংস্কার সাধিত হয়, অব্যতরিন বাজারকে ঐক্যবদ্ধ করে রাজারা নতুন অর্থনৈতিক রাজকর্মকে উৎসাহিত করতে থাকে । বলা বাহুল্য এই সমস্ত ব্যবস্থাই ধনতান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থা বিকাশ ত্বরান্বিত হয় ৷
আপাতদৃষ্টিতে মনে রাখা স্বাভাবিক যে, রাষ্ট্রগুলি নতুন রাষ্ট্র ব্যবস্থা যথা আজ স্থায়ী সেনাবাহিনী ও আমলাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সঙ্গে আহুনানুক কর ব্যবস্থাকে সংহত করার, মুদ্রা ব্যবস্থা সংস্কার,অভ্যন্তরীণ বাজার কে ঐক্যবদ্ধ করা এবং পুঁজির বিকাশকে সাহায্য করা আবার অন্য দিক থেকে সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার অবক্ষয়ের ফলে ইউরোপের বৃহৎ অংশে বিশেষত পশ্চিম ইউরোপের ভূমিদান প্রথার বিলোপ ঘটে এবং সামন্ত অভিজাত দের প্রভাব প্রতিপন্ন কমে যায় । সুতরাং এই নতুন রাষ্ট্রকে এক বিশেষ ভারসাম্য রক্ষা করতে হয় ।
আপনি চাইলে এগুলো পড়তে পারেন
নতুন ধরনের রাষ্ট্র নির্মাণ প্রক্রিয়ার প্রথম দিকেই সংকট দেখা দিলেও পরবর্তীকালে একটা বোঝাপড়া রচিত হয়েছিল এবং পূর্ববর্তী প্রভাবশালী অভিজাত শ্রেণি নতুন রাষ্ট্র প্রক্রিয়ার ক্রমস্ত সম্প্রীতি হয়ে গিয়েছিল ৷ তবে নব্য রাজতন্ত্রের হাত ধরে রাষ্ট্রগুলির চরিত্র এবং শ্রেণীর প্রাধান্যর পরিবর্তন ঘটেছিল ৷ ফ্রান্স এবং ইংল্যান্ডের রাজতন্ত্র যে নতুন রূপ লাভ করেছিলেন তার মধ্যে দিয়ে এক ধরনের জাতীয় রাজতন্ত্র গড়ে উঠেছিল যা এক নতুন ধরনের সাংস্কৃতিক পরিকাঠামোর উদ্ভবের সহায়ক হয়েছিল ৷
