কেন কিভাবে ক্রিপস মিশন ভারতে পেরিত হয় এর ফলে ভারতের রাজনৈতিক সমস্যা কি কি সমাধান হয়েছিল ? বা, ক্রিপস মিশনের প্রস্তাব গুলি আলোচনা করো? বা, ক্রিপস মিশনের ব্যর্থতার কারণগুলি ব্যাখ্যা কর কোন পরিস্থিতিতে ক্রিপস ভারতে আসে চিপসের প্রস্তাবকে কেন্দ্র করে ভারতীয়দের মধ্যে কি প্রতিক্রিয়া হয়
১৯৩৯ খ্রীষ্টাব্দের ৩রা সেপ্টেম্বর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে ব্রিটিশ সরকার ভারতীয় জনগণের মতামত উপেক্ষা করে ভারতকে কংগ্রেস মন্ত্রিসভার পদত্যাগ 'যুদ্ধরত দেশ' বলে ঘোষণা করেন। অর্থাৎ বিশ্বযুদ্ধের সঙ্গে ভারতবাসীকে জড়িয়ে ফেলা হল। সরকারের এই আচরণে কংগ্রেসের নেতারা ক্ষুব্ধ হন। তাঁরা সরকারের কাছে যুদ্ধের আদর্শ কি এবং যুদ্ধের অবসানে ভারত সম্পর্কে সরকারের নীতি কি হবে জানতে চান। কিন্তু সরকার প্রশ্নগুলি এড়িয়ে যান। এর প্রতিবাদে বিভিন্ন প্রদেশের কংগ্রেসী-মন্ত্রিসভাগুলি পদত্যাগ করেন। সেই সুযোগে মুসলিম লীগ কয়েকটি প্রদেশে মন্ত্রিসভা গঠন করে।
আপনি চাইলে এগুলো পড়তে পারেন
কংগ্রেস ফ্যাসিবাদী শক্তিগুলির (যেমন-জার্মানী, ইটালী প্রভৃতি) বিরুদ্ধে মিত্রশক্তির লড়াই-এর প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানায় ঠিকই, কিন্তু সেই সঙ্গে কংগ্রেস ঘোষণা করে যে এই যুদ্ধ যদি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যকে রক্ষা করার জন্যই চালিত হয়- তাহলে সেক্ষেত্রে ভারতবাসী যুদ্ধে যোগ দেবে না। রামগড় অধিবেশনে কংগ্রেস প্রস্তাব নেয় যে স্বাধীনতাই ভারতের একমাত্র ও চূড়ান্ত দাবি। এছাড়া কংগ্রেস যুদ্ধ চলাকালীন একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের ও একটি সংবিধানসভা গঠনের প্রতিশ্রুতি দাবি করে। এই যাবিগুলি মানা হলেই কংগ্রেস যুদ্ধে সহযোগিতা করার আশ্বাস দেয়।
এদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের গতি দ্রুত পরিবর্তিত হতে থাকে। ১৯৪৩ সালের মধ্যভাগে মিত্রপক্ষের দারুণ বিপর্যয় ঘটে। জর্মানীর উত্তরোত্তর সাফল্য, জার্মানীর কাছে ডেনমার্ক, হল্যান্ড, বেলজিয়াম ও ফ্রান্সের পতন এবং জার্মানীর প্রচণ্ড আক্রমণে ব্রিটিশের বিপর্যয়ের সম্ভাবনা ভারতে এক গভীর উত্তেজনার সৃষ্টি করে। ভারতের জনগণ স্বাধীনতার জন্য অধৈর্য হয়ে ওঠে এবং গান্ধীজী জনগণকে ধৈর্য ধারণ করার পরামর্শ দিয়ে বলেন: "আমরা ব্রিটিশের ধ্বংস সাধন করিয়া স্বাধীনতা চাই না"। তিনি কংগ্রেসের দাবি সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
ভারত সরকার কংগ্রেসের এই দাবিতে অসম্মত হওয়ায় ভারতে রাজনৈতিক অচলাবস্থার উদ্ভব হয়। এই অবস্থার অবসানের উদ্দেশ্যে ১৯৪০ খ্রীষ্টাব্দের আগস্ট মাসে বড়লাট লিলিখগো ঘোষণা করেন যে, (১) যুদ্ধাবসানে ভারতকে ডোমিনিয়নের মর্যাদা দেওয়া হবে, (২) ভারতীয় প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি সংবিধানসভা গঠন করা হবে এবং তাকে নূতন সংবিধান রচনার ক্ষমতা দেওয়া হবে: (৩) বড়লাটের কার্যনির্বাহক পরিষদে কিছুসংখ্যক ভারতীয় প্রতিনিধি গ্রহণ করা হবে। (৪) ভাবতের বিভিন্ন জাতি ও গোষ্ঠীর প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি যুদ্ধ-উপদেষ্টা কমিটি (War Advisory Committee) গঠন করা হবে। এই ঘোষণায় ভারতীয়দের পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়ার কোন প্রতিশ্রুতি ছিল না, শুধুমাত্র ভারতকে ব্রিটিশ কমনওয়েলথ-এর মধ্যে ডোমিনিয়নের মর্যাদা দেওয়ার আশ্বাস ছিল। দ্বিতীয়ত, সংবিধানসভার গঠনের ব্যাপারে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের স্বার্থ সুরক্ষিত করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। ভারতের গণতান্ত্রিক ও জাতীয়তাবাদী আশা-আকাঙক্ষা চরিতার্থ করার কোন ইঙ্গিত এই ঘোষণায় না থাকায় কংগ্রেস বড়লাটের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। অন্যদিকে সাম্প্রদায়িক স্বার্থের প্রতি প্রতিশ্রুতি থাকায় মহম্মদ আলি জিন্না খুশী হন। তবে প্রস্তাবিত সংবিধানসভার দল হিসাবে মুসলিম লীগের সংখ্যালঘুতে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা থাকায় লীগও শেষ পর্যন্ত বড়লাটের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন।
ইতিমধ্যে জাপান মিত্রপক্ষের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যোগদান করলে মিত্রপক্ষের পরিস্থিতি অত্যন্ত জটিল হয়ে ওঠে। অল্প সময়ের মধ্যে ফিলিপাইন দ্বীপপুঞ্জ, ইন্দোনেশিয়া, ইন্দোচীন, মালয়, সিঙ্গাপুর ও ব্রহ্মাদেশ জাপানের দখলে চলে যায়। জাপানের ভারত আক্রমণের সম্ভাবনাও দেখা যায়। ভারতের প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ছিল অত্যন্ত শোচনীয়। উপরন্ত শাসনতান্ত্রিক অচলাবস্থা ও ভারতে যুদ্ধ পরিচালনার ব্যাপারে অসুবিধার সৃষ্টি করেছিল। ভারতের পূর্ণ সহযোগিতা ছাড়া জাপানের আক্রমণ প্রতিহত করা ব্রিটিশ সরকারের পক্ষে সম্ভব ছিল না। ব্রিটেনের মিত্রপক্ষের মধ্যেও এই ধারণা বলবতী হয়ে উঠছিল যে, ব্রিটেনের সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থই ভারত-সমস্যার সমাধানের প্রধান অন্তরায়। এই সময় আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি ভারতের রাজনৈতিক অচলাবস্থার নিরসনের অনুকুল হয়ে উঠেছিল। আতলান্তিক চার্টার বা সনদে (১৯৪১ খ্রীঃ) পরাধীন জাতিগুলিকে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। চীনের রাষ্ট্রপতি চিয়াং কাইশেক ব্যক্তিগতভাবে ভারতের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন। তিনি ভারতে এসে (১৯৪২ খ্রীঃ) গান্ধীজী, নেহরু প্রমুখ নেতাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট ভারতকে অবিলম্বে স্বায়ত্তশাসনের অধিকার দেওয়ার জন্য ব্রিটেনের ওপর চাপ সৃষ্টি করেন। এমনকি ব্রিটেনেও শ্রমিকদলের নেতা ক্লিমেন্ট এট্লী ভারতের রাজনৈতিক অচলাবস্থার অবসানের জন্য নূতন উদ্যোগের দাবি তোলেন। সুতরাং ভারতে শাসমতান্ত্রিক অচল অবস্থা দূর করার এবং জাপানী আক্রমণের বিরুদ্ধে ভারতবাসীর সহযোগিত। লাভ করার উদ্দেশ্যেই ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিল ব্রিটিশ মন্ত্রিসভার সদস্য স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রীপ্রমকে ভারতে পাঠান (মার্চ, ১৯৪২ খ্রীঃ)। ক্রীপস্ ছিলেন অত্যন্ত ধীর প্রকৃতির ও-সমাজতন্ত্রবাদী মানুষ ও অভিজ্ঞ রাজনীতিক।
ক্রীপস্ ভারতীয় নেতৃবৃন্দের সহিত আলাপ-আলোচনা সম্পন্ন করে প্রড়ার করেন যে, (১) আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার অর্জনের জন্য শীঘ্রই ভারতীয় ইউনিয়ন গঠন করা হবে এবং ডোমিনিয়নের মর্যাদা দেওয়া হবে। এই ডোমিনিয়ন ব্রিটিশ ডোমিনিয়নের সম-মর্যাদা লাভ করবে। (২) যুদ্ধাবসানে ভারতীয় প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি সংবিধানসভা গঠন করা হবে এবং তার ওপর নূতন শাসনতন্ত্র বচনার দায়িত্ব দেওয়া হবে। ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে এই সংবিধান সভা চুক্তিবদ্ধ হবে এবং এই চুক্তি অনুসারে ভারতীয়দের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হবে। এতদ্ভিন্ন এই চুক্তিতে সংখ্যালঘুদের ধর্মীয় ও অন্যান্য বিষয়ের সংরক্ষণের প্রতিশ্রুতি থাকবে। (৩) ভারতের কোন প্রদেশ বা দেশীয় রাজ্য নূতন শাসনতন্ত্র গ্রহণে অসম্মত হলে, সেই প্রদেশ বা দেশীয় রাজ্য নিজস্ব শাসনতন্ত্র রচনা করবে। (৪) সংবিধান সভার সদস্যরা প্রাদেশিক আইনসভা কর্তৃক নির্বাচিত হবেন। (৫) ভারতের প্রতিরক্ষার দায়িত্ব ব্রিটিশ সরকারের হাতে থাকবে এবং (৬) বড়লাটের কার্যনির্বাহক কাউন্সিলের সংখ্যাগরিষ্ঠের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে রড়লাটের 'ভিটো' ক্ষমতা প্রয়োগের অধিকার থাকবে।
ক্রীপস্ প্রস্তাবের প্রতিক্রিয়া: প্রকৃতপক্ষে ক্রীপসের প্রস্তাবে ভারতকে স্বাধীনতা দানের কোন উল্লেখ ছিল না। দ্বিতীয়ত, ভারতের প্রতিরক্ষার পূর্ণ দায়িত্ব ভারতীয়দের হাতে দেওয়ার কোন ইচ্ছাই ব্রিটিশ সরকারের ছিল না। তৃতীয়ত, প্রস্তাবিত জাতীয় সরকারকে ক্যাবিনেটের সম-মর্যাদা ও ক্ষমতাদানের কোন প্রতিশ্রুতি ছিল না। চতুর্থত, প্রস্তাবে মুসলিম লীগের পাকিস্তান দাবিকে পরোক্ষভাবে সমর্থন করা হয়। পঞ্চমত, দেশীয় রাজ্যগুলিকেও ভারতীয় রাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার অধিকার দেওয়া হয়। শুধুমাত্র ভবিষ্যতের প্রতিশ্রুতিতে কংগ্রেসের কোন আগ্রহ ছিল না। এই কারণে জাতীয় কংগ্রেস ভাপস প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। মহাত্মা গান্ধী এই প্রস্তাবকে "একটি ফেলপড়া ব্যাঙ্কের ওপর আদাম তারিখের চেক্" ("A post-dated cheque on crushing bank") বলে অভিহিত করেন। অন্যদিকে প্রস্তাবে পাকিস্তান রাষ্ট্রের এবং দুইটি পৃথক সংবিধানসভা গঠনের সুস্পষ্ট উল্লেখ না থাকায় মুসলিম লীগও তা প্রত্যাখ্যান করে।
মুসলিম লীগ ঘোষণা করে যে, দেশবিভাগ ভিন্ন ভারতের রাজনৈতিক সমস্যার কোন স্থায়ী সমাধান সম্ভব নয়। অন্যান্য দলগুলির কাছেও ক্রীপসের প্রস্তাব গ্রহণযোগ্য হল না। ক্রীপসের প্রস্তাবে ভারত-বিভাগের সম্ভাবনা থাকায়, হিন্দুমহাসভা তা সরাসরি বাতিল করে দেয়। শিখ, সম্প্রদায়ের কাছেও ক্রীপসের প্রস্তাব গ্রহণযোগ্য হল না। কারণ প্রস্তাবিত ভারত-রাষ্ট্র থেকে পাজাবের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান চলে গেলে শিখদের স্বার্থ বিপন্ন হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। অনুন্নত সম্প্রদায়ের নেতা ডাঃ আম্বেদকরও খুশী হতে পারলেন না। কারণ এই প্রস্তাব কার্যকর হলে বর্ণ-হিন্দুদের নিরঙ্কুশ আধিপত্যের সম্ভাবনা ছিল। সুতরাং দেখা যায় যে, ক্রীপদের প্রস্তাব ভারতের রাজনৈতিক দলগুলির কাছে গ্রহণযোগ্য হল না।
ক্রীপসের দৌত্যের ব্যর্থতার জন্য ক্রীপস্ নিজেই গান্ধীজী ও কংগ্রেসের নেতাদের অনমনীয়তাকেই প্রধানত দায়ী করেছিলেন।