১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে প্রবর্তিত ভারত শাসন আইন বা মন্টেগু চেমসফোর্ড সংস্কার আইনের বিভিন্ন শর্ত গুলি উল্লেখ কর? বা,১৯১৯ সালের মন্টেগু চেমসফোর্ড সংস্কার আইনের শর্তগুলি উল্লেখ কর? এই আইনের ত্রুটি গুলি কি ছিল? বা, মন্টেগু চেমসফোর্ড সংস্কার আইনের সমালোচনামূলক আলোচনা কর বা,মন্টেগু চেমসফোর্ড সংস্কারের বৈশিষ্ট্য লেখ? এই আইনের ত্রুটি গুলি কি ছিল ?
১৯১৯ খ্রীষ্টাব্দের মন্টেও-চেমসফোর্ড সংস্কার আইন:
মর্লে-মিন্টো সংস্কার ভারতীয়দের দাবি পূরণ করতে পারেনি এবং ভারতীয়দের বিক্ষোভের অবসানও ঘটাতে পারেনি । এদিকে কংগ্রেসের ভিতরে চরমপন্থী ও নরমপন্থীদের আদর্শগত বিরোধের নিষ্পত্তি হওয়ায় জাতীয় কংগ্রেস পুনরায় ঐক্যবদ্ধ ও প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে । ভারতীয় মুসলিম সমাজ প্রণাম বিশ্বযুদ্ধে ইংরেজদের মুসলিম দেশগুলির সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ায় ব্রিটিশ-বিরোধী হয়ে ওঠে এবং কংগ্রেসের সঙ্গে আপোস করে (১৯১৬ স্ত্রীঃ) । অন্যদিকে বিশ্বযুদ্ধে ভারতের সাহায্যের ওপর ব্রিটিশ সরকার নির্ভরশীল হয়ে পড়েন । যুদ্ধের সময় ভারতবাসীর সহযোগিতার পুরস্কারস্বরূপ এবং ভারতবাসীর দাবি উপেক্ষা করা অসম্ভব বিবেচনা করে ১৯১৭ খ্রীষ্টাব্দে ভারত-সচিব মন্টেও ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ঘোষণা করেন, 'ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক থেকেই ভারতবাসী যাতে প্রশাসনের প্রতিটি ক্ষেত্রে অংশগ্রহণের সুযোগ-সুবিধা লাভ করতে পারেন এবং ক্রমশ স্বায়ত্তশাসনের উপযুক্ত হয়ে উঠতে পারেন সরকার এইরূপ নীতি গ্রহণ করেছেন।" এই বছরেই ভারত-সচিব মন্টেগু এবং ভারতের বড়লাট চেমসফোর্ড একটি পরিকল্পনা প্রস্তুত করেন । তারই ভিত্তিতে ১৯১৯ খ্রীষ্টাব্দের সংস্কার আইন বা ১৯১৯ খ্রীষ্টাব্দের ভারত দরকার আইন পাস করা হয় ৷
আপনি চাইলে এগুলো পড়তে পারেন
এই আইন দ্বারা কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকারের কার্যাদি যথাসম্ভব সুস্পষ্টভাবে নির্দিষ্ট করা হয়। কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে দেশরক্ষা, পররাষ্ট্রবিষয়, ডাক ও রেল, মুদ্রা, বাণিজ্য প্রভৃতি সর্বভারতীয় বিষয়গুলি ন্যস্ত রাখা হয় । প্রাদেশিক সরকারের অধীনে থাকে অভ্যন্তরীণ শান্তি ও শৃঙ্খলার দায়িত্ব, বিচার, জেল, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সেচ, স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন প্রভৃতি প্রাদেশিক বিষয়গুলি । কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকারের মধ্যে আয়ও বণ্টন করে দেওয়া হয়।
কেন্দ্রীর ও প্রাদেশিক সরকারের মধ্যে ক্ষমতা বণ্টন করা হলেও সারা ভারতের জন্য আইন প্রণয়নের ক্ষমতা কেন্দ্রীয় আইনসভাকেই দেওয়া হয় । কোন কোন বিষয়ে আইন সংক্রান্ত প্রস্তাব উত্থাপন করার পূর্বে বড়লাটের আগাম অনুমতি নেওয়া আবশ্যিক করা হয় । বড়লাটিকে জরুরী আইন জারী করার ক্ষমতা দেওয়া হয় । পূর্বের মত ভারতের বড়লাট ভাবত-সচিব ও পার্লামেন্টের কাছে দায়ী থাকেন, জাতীয় আইনসভার কাছে নয় । কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহক পরিষদের সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি করা হয়।
কেন্দ্রীয় অহিনসভাকে পুনর্গঠন করে রাষ্ট্র-পরিষদ (Council of State) ও আইন-পরিষদ (Legislative Assembly) নামে দুইটি কক্ষে ভাগ করা হয় । রাষ্ট্র পরিষদ বা উচ্চকক্ষের কেন্দ্রীয় আইনসভার পুনগঠন মোট সদস্য-সংখ্যা ধার্য করা হয় ৬০, এদের মধ্যে ৩৪ জনকে নির্বাচিত করার ব্যবস্থা হয় । আইন-পরিষদ বা নিম্নকক্ষের সদস্য- সংখ্যা ধার্য করা হয় ১৪০ (পরে ১৪৫), এদের মধ্যে ১০৫ জনকে নির্বাচিত করার ব্যবস্থা হয় । উভয় পরিষদেই সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হয় এবং ভোটাধিকারও সীমাবদ্ধ রাখা হয় ।
১৯১৯ স্ট্রীষ্টাব্দের আইন অনুযায়ী প্রদেশগুলিতে দ্বৈতশাসন (Dyarchy) প্রবর্তন করা হয় । ব্রহ্মাদেশ ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশসহ মোট দশটি প্রদেশ গভর্নরশাসিত প্রদেশে পরিণয় হয় । প্রচুর ক্ষমতা ও সুযোগ-সুবিধার অধিকারী গভর্নর প্রদেশের যথার্থ কর্তৃত্বের অধিকারী হল । প্রাদেশিক শাসনকার্য 'সংরক্ষিত' (Reserved) ও '' হস্তান্তরিত " (Transferted) এই দুটি ভাগে বিভক্ত করা হয় । স-পরিষদ গভর্নরের হাতে সংরক্ষিত বিষয়গুলির (যথা-পুলিশ, বিচার, জেল, সেচ, ভূমি-রাজস্ব) দায়িত্ব রাখা হয় । প্রাদেশিক আইনসভার কাছে এঁদের কোন দায়িত্ব ছিল না । অন্যদিকে গভর্নর ও মন্ত্রিসভার হাতে হস্তান্তরিত বিষয়গুলির (যথা-শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, আবগারী, সমবায় সমিতি, স্থানীয় স্বায়ত্বশাসন) দায়িত্ব রাখা হয় । এই দায়িত্ব পালনের জন্য মন্ত্রিসভা আইনসভার কাছে দায়ী থাকেন । সংরক্ষিত ও হস্তান্তরিত উভয় বিষয়গুলির ওপর গভর্নরের অবাধ কর্তৃত্ব বহাল রাখা হয় । প্রাদেশিক আইনসভার সদস্যদের মধ্যে গভর্নর মন্ত্রী নিযুক্ত করার অধিকারী হন ।
একথা অনস্বীকার্য যে, মন্টেও-চেমসফোর্ড আইনের দ্বারা শাসনসংক্রান্ত ব্যাপারে জনসাধারণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সীমাবদ্ধ দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল । কিন্তু যথার্থ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা হিসাবে বিচার কবলে কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক প্রশাসনের ক্ষেত্রে এই আইনের দ্রুটি লক্ষ্য করা যায় । প্রথমত, কার্যনির্বাহক (Executive) পরিষদকে আইনসভার নিয়ন্ত্রণ থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত রাখা হয় । দ্বিতীয়ত, প্রাদেশিক শাসনকার্য সংরক্ষিত ও হস্তান্তরিত এই দুই ভাগে বিভক্ত করে একদিকে ক্ষমতাবিহীন দায়িত্ব ও অন্যদিকে দায়িত্ববিহীন ক্ষমতা অর্পণ করার ব্যবস্থা করা হয় । এর ফলে সুষ্ঠুভাবে শাসনকার্য পরিচালনার পক্ষে প্রতিবন্ধকের সৃষ্টি হয় এবং প্রশাসনিক সক্ষতা ক্ষুণ্ণ হয় ।
১৯১৯ খ্রীষ্টাব্দের প্রশাসনিক সংস্কারে প্রত্যক্ষ নির্বাচন-নীতি স্বীকৃত হলেও এবং কতকগুলি প্রাদেশিক বিভাগ 'হস্তান্তরিত' হওয়া সত্ত্বেও ভারতবাসীকে প্রকৃত স্বায়ত্বশাসনের অধিকার থেকে বঞ্চিত রাখা হয় । কেন্দ্রে সব ক্ষমতা বড়লাটের হস্তে কেন্দ্রীভূত রাখা হয় । প্রাদেশিক শাসনের ক্ষেত্রে গভর্নর বা ছোটলাটকে মন্ত্রীসভার সিদ্ধান্ত নাক্ত করার অধিকার দৈওয়া হয়। ফলে ভারতবাসীর আশা-আকাঙক্ষা অচরিতার্থ থেকে যায় । জাতীয় কংগ্রেস মান্টেও-চেমসফোর্ড সংস্কারকে অপর্যাপ্ত, অসন্তোষজনক ও নৈরাশ্যকর ("inadequate, unsatisfactory and disappotating") বলে অভিহিত করে । অন্যসিকে জাতীয় কংগ্রেসের নবমপন্থীরা এই সংস্কার আইনকে "একটি সঠিক ও বলিষ্ঠ পদক্ষেপ" বলে অভিহিত করেন এবং এর প্রতি সমর্থন জানান । প্রকৃতপক্ষে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের অনেকেই এই সংস্কার আইনকে ত্রুটিমুক্ত বলে মনে করেননি ।