জ্ঞানদীপ্ত স্বৈরাচারীর বলতে কী বোঝ ও বৈশিষ্ট্য আলোচনা কর অথবা,অষ্টাদশ শতাব্দীর ইউরোপের জ্ঞানদীপ্ত স্বৈরাচারের বৈশিষ্ট্য আলোচনা কর।
ঞ্জানদীপ্ত স্বৈরাচার হল অষ্টাদশ শতাব্দীর সাথে যুক্ত একটি শব্দ । এই শতাব্দীতে বেশ কয়েকটি ইউরোপীয় দেশগুলিতে যুগ যুগ ধরে লালিত পালিত ধ্যান ধ্যারনার নীতি এবং অনুশীলনগুলিতে একটি উল্লেখযোগ্য আলোড়ন দেখা গেছে । এর মূল্যে ছিল বেশ কিছু দার্শনিক এবং পণ্ডিতদের যুক্তি নির্ভর মতবাদ । এই কারণে, এই শতাব্দীকে কখনও কখনও "আলোকিতা শতাব্দী" বা "ঞ্জানদীপ্তির যুগ" হিসাবে উল্লেখ করা হয় । দার্শনিক এবং মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবীরাই শুধুমাত্র আলোকিত আন্দোলন দ্বারা প্রভাবিত হননি । অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে আবির্ভূত হওয়ায় ইউরোপীয় রাজা ও অভিজাতদের প্রভাবিত হয়েছিল । মূলত এই নতুন রাজনৈতিক চেতনায় 'ঞ্জানদীপ্তির যুগ' নামে পরিচিত ৷
আপনি চাইলে এগুলো পড়তে পারেন
মধ্যযুগে রজতন্ত্র ছিল ধম্রাশয়ী, যারা নিজেদেরকে ঈশ্বরের সন্তান বলে বিবেচনা করত । জাতীয় জীবনে প্রতেক্যেই রাজশক্তি দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল । সপ্তদশ শতাব্দীতে ইউরোপীয় শাসকরা ঐশ্বরিক অধিকারে (Di
vine right) তাদের দেশ শাসন করতেন । তারা দাবি করেছিল যে তারা কোন পার্থিব কর্তৃপক্ষের কাছে দায়বদ্ধ নয় কারণ, তারা ঈশ্বরের দ্বারা প্রেরিত । কিন্ত অষ্টাদশ শতাব্দীতের মধ্যভাগে বা ফরাসী বিপ্লবের পূর্ববর্তী যুগে এইরুপ ধারণার পরিবর্তন ঘটে । অষ্টাদশ শতাব্দীর ইউরোপীয় শাসকরা যুক্তিবাদী বা আলোকিত মতাদর্শের জন্য তাদের ত্রুটিগুলি বুঝতে পেয়েছিলেন । দীর্ঘকাল ধরে তারা ঈশ্বরের দোহাই দিয়ে যে স্বৈরাচারী রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছিল তারা এই অন্যায় দিকটা বুঝতে পারে । এই কারণে, এই শতাব্দীর রাজারা জনসংখ্যা সংস্কারের মাধ্যমে তাদের একনায়কত্বকে আধুনিক করার চেষ্টা করেছিলেন ।জ্ঞানদীপ্ত স্বৈরাচারী সম্পর্কে বিভিন্ন শিক্ষাবিদদের ভিন্ন ভিন্ন মতামত রয়েছে । ইতিহাসবিদ লর্ড অ্যাক্টনের মতে জ্ঞান দীপ্ত স্বৈরাচারী ছিল 'রাজতন্ত্রের তপস্যা বা প্রায়শ্চিত্ত' বলে বিবেচিত করে । অধ্যাপক হেইজ জ্ঞানদীপ্ত স্বৈরাচারীকে," স্বৈরাচারী রাজতন্ত্রের সঙ্গে যুক্তিবাদের সমন্বয়ে বলে অভিহিত করেছেন ।" রেড্ডাওয়ের বলেন যে,"1763 সালের পর যে 25 বছর অতিবাহিত হয়েছে তাকে প্রধানত আলোকিত স্বৈরাচারের যুগ বলা যেতে পারে ৷"
জ্ঞানদীপ্ত স্বৈরাচারের বৈশিষ্ট্য
আধুনিক ইউরোপের রূপরেখা কেমন হবে তা সপ্তদশ শতকের শেষ দিকে অনেকটা স্পষ্ট হয়ে । স্থান, কাল, পাত্র ভেদে এর রুপ ছিল ভিন্ন ভিন্ন, প্রটেস্ট্যান্ট ধর্মমতের 'আধুনিকতা? পুঁজিবাদের প্রসার, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিদ্যার অগ্রগতি, ধর্মনির্ভর বিশ্বাষের পরিবর্ত যুক্তিবাদের বিকাশ অষ্টাদশ শতকের মানুষের মনোজগতে এবং দৈনন্দিন কাজকর্ম যে পরিবর্তন এনেছিল এক কথায় তাকে 'জ্ঞানদীপ্তি বা (Enlightenment')' বলা যেতে পারে, এর দ্বারা গভীর ভাবে প্রভাবিত হয়ে প্রাশিয়ার রাজা দ্বিতীয় ফ্রেডরিক, রাশিয়ার জার দ্বিতীয় ক্যাথারিন, অস্ট্রিয়ার রাজা দ্বিতীয় জোসেফ প্রমুখ ৷ এরা এক প্রজাকল্যানকামী শাসনব্যবস্থার মূল চরিত্র ছিল স্বৈরতান্ত্রিক, সেই জন্য তাদের শাসনব্যাবস্থা জ্ঞানদীপ্ত স্বৈরশাসন Enlightened Despotism)' নামে পরিচিত ৷
জ্ঞানদীপ্ত আলোক প্রাপ্ত মূল দর্শনের ভিত্তি ছিল বিজ্ঞান বিপ্লব । প্রচলিত ধর্ম ভিত্তিক বিশ্বাসের পরিবর্তে সমস্ত পরীক্ষা এবং পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে গঠিত যুক্তির দ্বারা ব্যাখ্যা করা শুরু হয় ।
জ্ঞানদীপ্ত নেতারা নিজেদেরকে রাষ্ট্রের প্রতিনিধি ভাবতেন । তারা রাজা এবং রাষ্ট্রের মধ্যে কোন পার্থক্য দেখেনি । তারা বলে যে, মন যেমন দেহকে নিয়ন্ত্রণ করে, তেমনি রাজ্য শাসিত হবে রাজার হাতে । আবারও বলেন, দেহ থেকে যেমন মস্তিষ্ককে পৃথক করা যায় না, তেমনি রাজা রাজ্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ ।
জ্ঞানদীপ্ত রাজাদের প্রজাদের কোনো মৌলিক অধিকার দেওয়া হয়নি । উপরন্তু, তারা প্রতিনিধিত্বমূলক সরকার গঠনকারী নির্বাচনী প্রক্রিয়া থেকে সরে এসেছে । স্বৈরাচারের অধীনে নাগরিকদের অংশগ্রহণ বা তাদের মতামত প্রকাশ করার অনুমতি দেওয়ার জন্য কোনও ব্যবস্থা ছিল না ।
জ্ঞানদীপ্ত শাসকরা মনে করত, রাষ্ট্র, সবকিছুর ঊর্ধ্বে এর জন্য রাজা প্রজা সবাইকে কাজ করতে হবে ৷ রাষ্ট্রের অস্তিত্ব ও ক্ষুন্ন থাকলে অস্তিত্ব বজায় হয়ে থাকবে, আর রাষ্ট্রের অস্তিত্ব বজায় থাকলে প্রজাদের নিরপত্তা এবং সুখ-সমৃদ্ধি, বটার থাকবে
জ্ঞানদীপ্তর রাজারা বিশ্বাস করেন যে রাজার ভূমিকা সাধারণ রাষ্ট্র পরিচালনা এবং কর আদায়ের বাইরেও প্রসারিত ৷ এর মধ্যে রয়েছে সংস্কার বাস্তবায়ন এবং জনগণের সুবিধার জন্য জনকল্যাণ মূলক উদ্যোগ গ্রহণ করা । তারা এভাবে নিজেদেরকে জনগণের ও রাষ্ট্রের সেবক হিসেবে মনে করত ।
শাসকরা তাদের নাগরিকদের পক্ষে যে পরিবর্তন বা উদ্যোগ বাস্তবায়ন করেছিল তা মোটেও রাজনীতি বা কর্তৃত্বের প্রতিকূল ছিল না । যেমন রাস্তা মেরামত করা, সেচ সরবরাহ করা, কৃষকদের বীজ দেওয়া, ফসলের ক্ষতি হলে কর কম করা ইত্যাদি ।