শেরশাহের ভূমি রাজস্ব নীতি সম্পর্কে আলোচনার কর অথবা,শেরশাহ প্রবর্তিত ভূমি রাজস্ব নীতি বিশ্লেষণ কর।
শেরসাহ মাত্র ৫ বছর রাজত্ব করেন কিন্তু এই স্বল্পকালের মধ্যে তার ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা সংস্কারের কাজে তিনি বিশেষ আন্তরিক ও কৃতিত্ব দেখান ৷ সারারামের পৈত্রিক জাইগীরের পরিচালক হিসেবে তিনি ভূমি রাজস্ব প্রশাসন ও কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থার সমস্যা ও সমাধানের বিষয়ে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন এবং ভারতের শাসক হিসেবে সেই অভিজ্ঞতা কে বৃহত্তর ক্ষেত্রে প্রয়োগ করেন ৷ আব্বাস খান শেরওয়ানির তুজুক-ই-শেরশাহী গ্রন্থের একটি ভাষ্য থেকে কৃষি উৎপাদন ও কৃষকদের গুরুত্ব সম্পর্কে শেরশাহের উপলব্ধি অনুমান করেছেন শের-শাহ জানতেন যে কৃষকদের প্রচেষ্টার ওপর চাষাবাদ নির্ভরশীল, তাই কিছুটা সহর্মীতার দ্বারা ভূমি রাজস্ব নীতি নির্ধারণ করেছিলেন ৷
আপনি চাইলে এগুলো পড়তে পারেন
তিনটি মূল লক্ষ্য সামনে রেখে শেরশাহ ভূমি রাজস্ব কর্মসূচি গড়ে তোলেন ৷ এই তিনটি লক্ষ্য হলো (১). কৃষি উৎপাদনে আই বৃদ্ধির (২). কৃষকদের অবস্থা সচ্ছল করা (৩). ভূমি রাজস্ব খাতে সরকারি আই বৃদ্ধি করা ৷ এই জন্য প্রথমে তিনি আবাদ যোগ্য সমস্ত জমি জরিপ করার সিদ্ধান্ত নেন ৷ এই কাজে সিকান্দার লোদী কর্তৃক ব্যবহৃত ম্যাপ অনুসরণ করেন অতঃপর জমিগুলোকে উৎপাদিকা শক্তি হিসেবে উৎকৃষ্ট, মাঝারি ও নিকৃষ্ট এই তিন ভাগে বিভক্ত করেন ৷ প্রতি বিঘা জমির বার্ষিক উৎপাদন গড় হিসাবে তার গড় উৎপাদনকে এক তৃতীয়াংশ রাজস্ব হিসেবে সরকারি রাজকোষে জমা দেওয়ার নির্দেশ দেন ৷
শেরশাহ কৃষকদের চাষ করা জমির উপর তার অধিকার সুনিশ্চিত করা এবং সরকারের ভূমি রাজস্ব প্রধান সম্পর্কে কৃষকদের দায়বদ্ধতা স্পষ্ট করার বিষয়ে ভাবনা চিন্তা শুরু করেন ৷ এইজন্য তিনি পাট্টা ও কবুলিয়াতের প্রচলন করেন ৷ জমিতে কৃষকের অধিকার সুনিশ্চিত করার লক্ষ্যে সরকার জমি জরিপের ভিত্তিতে কৃষকদের অধীনে জমির পরিমাণ ইত্যাদি নথিবদ্ধ করে এবং নির্দিষ্ট জমিতে কৃষকদের অধিকারের স্বীকার করে নিয়ে চাষীকে একটি পাট্টা প্রদানের ব্যবস্থা করা হয় ৷ পরবর্তীতে কৃষক ও উক্ত জমিতে চাষাবাদ করায় এবং সরকারের ধার্য রাজস্ব প্রধান করার কবুল করে একটি অঙ্গীকার পত্র বা কবুলিয়াত প্রদান করেন ৷ এর ফলে সরকারের সাথে কৃষকের সম্পর্কের উন্নতি ঘটে ৷
শেরশাহের ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল মধ্যস্বত্ব ভোগী শ্রেণীর বিলোপ ৷ শেরশাহ ভুমি রাজস্ব সংগ্রহের দায়িত্ব থেকে জমিদার ও ইজারাদারদের কেড়ে নেন এবং সরকারি কর্মচারীগণ দ্বারা সরকারি কৃষকদের কাছ থেকে রাজস্ব সংগ্রহের ব্যবস্থা করেন ৷ এইজন্য শেরশাহকে ভারতে রায়তওয়ারি বন্দোবস্ত ব্যবস্থার পথিকৃত বলা হয় ৷ অবশ্য গোটা রাজ্যে তিনি এই ব্যবস্থার প্রয়োগ করেননি ৷
আব্বাস খান শেরওয়ানি 'তারিক-ই-শেরশাহী' গ্রন্থের ভাষ্য থেকে জানা যায় যে শেরশাহ সরকারি কর্মীদের মাঝেমধ্যেই সতর্ক করে দিতেন ৷ যদি কোন সরকারি কর্মচারী অতিরিক্ত রাজস্ব সংগ্রহ করতেন তাহলে সংশ্লিষ্ট কর্মচারীর শাস্তি দানের ব্যবস্থাও ছিল ৷ তিনি আমিন,কানুনগো প্রমুখকে কঠোর নির্দেশ দেন যে, ভূমি রাজস্ব নির্ধারণের যথেষ্ট যুক্তিবাদী উদারতা হওয়া আবশ্যক ৷ রাজস্ব আদায়ের সময় কোনরকম স্থিতিলতা সহ করা হবে না ৷ অবশ্য অনাবৃষ্টি, , অতিবৃষ্টি,যুদ্ধকালে সেনাবাহিনীর যাতায়াত ইত্যাদির কারণে উৎপাদন ব্যাহত হলে শেরশাহ খাজনা মুখুব করে দিতেন এবং কৃষকদের যথাযথ ঋণদানের ব্যবস্থাও করতেন ৷
শেরশাহের ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থার কয়েকটি ত্রুটির প্রতি ডক্টর আর.পি.ত্রিপার্টি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন ৷ যেমন তিন শ্রেণীর জমির উৎপন্ন ফসলের রাজস্ব নির্ধারণের জন্য প্রথম শ্রেণীর জমির কৃষকরা লাভবান হয়েছিলেন কিন্তু দ্বিতীয়-তৃতীয় শ্রেণীর বিশেষত জমি মালিকেরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল ৷ তাছাড়া নগদ মূল্যের রাজস্ব আদায়ের জন্য ফসলের বাৎসরিক মূল্য নির্ধারণের যে দীর্ঘসূচি ব্যবস্থা ছিল তাতে উৎপাদক ও রাজস্ব আদায়কারী উভয়ই সমস্যার সম্মুখীন হত ।
কিছু ত্রুটি সীমাবদ্ধতা সত্বেও শেরশাহের ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থাকে কোন ভাবে অস্বীকার করা যায় না ৷ শেরশাহ ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থার ক্ষেত্রে যে নতুনত্ব ও মৌলিক তথ্য প্রদান করেছিল তা মধ্যযুগের ভারতবর্ষের ইতিহাসের অত্যন্ত বিরল ৷ শের শাহের ভূমি রাজস্বের মৌলিকত্ব থাকলেও তার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ে ৷ তাই ডক্টর, ত্রিপার্টি বলেছেন, "As a consequence of his policy the structure of the central and provincial government become woefully week."