লর্ড উইলিয়াম বেন্টিং এর সংস্কার গুলি আলোচনা করো এতে হিতবাদী চিন্তাধারা কিভাবে উভয় ফেলেছিল অথবা উইলিয়াম বেন্টিং এর সংস্কারগুলির ক্ষেত্রে হিতবাদী চিন্তা কিভাবে প্রভাব ফেলেছিল
ঊনবিংশ শতকের প্রথমেই ইংরেজ সরকারের ভারত শাসন নীতিতে বিশেষ পরিবর্তন দেখা দেয় ৷ ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দের চ্যাটার আইন পাস হলে ইংরেজ শাসনের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হতে থাকে ৷ লর্ড উইলিয়াম বেন্টিং এর সংস্কারের মাধ্যমে ভারতের ব্রিটিশ শাসনের পরিবর্তন উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছতে থাকে ৷ এজন্যই বেন্টিং এর শাসনকাল ভারতে ব্রিটিশ শাসনের ইতিহাসে এক গৌরবময় অধ্যায় হিসেবে পরিচিত ৷ বেন্টিং এর হিতবাদী চিন্তার প্রভাবে বিভিন্ন সংস্কার প্রবর্তন করে ভারতবর্ষের একাধিক উন্নত সাধন করেছিলেন ৷ হিতবাদী সংস্কারের জন্য বেন্টিং এর শাসনকাল আধুনিক ভারতের ইতিহাসের এক সুবর্ণ যুগ হয়ে আছে ৷
আপনি চাইলে এগুলো পড়তে পারেন
ভূমি রাজস্ব সংস্কারের ক্ষেত্রে বেন্টিং এর পদক্ষেপগুলি ছিল গুরুত্বপূর্ণ ৷ চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে বাংলায় যে সকল জমিকে নিস্কর দেখানো হয়েছিল ৷ জমির খতিয়ানা পরিমাণ করে বেন্টিং সেই জমিকে রাজস্বের আওতায় এনে ছিলেন ৷ বেন্টিং এর সময় এই এলাহাবাদ বারানসি প্রভৃতি অঞ্চলে প্রথম একটি সুনিব্যস্ত ভূমি রাজত্ব ব্যবস্থা গড়ে ওঠে, স্বল্প মেয়াদের পরিবর্তে বেন্টিং 30 বছরের জন্য দীর্ঘমেয়াদী মহলওয়ারি বন্দোবস্ত মাধ্যমে জমি বন্দোবস্ত চালু করেন ৷ এতে গ্রাম্য কৃষক উন্নতিতে মননিবেশ করেন ৷ তালুকদার দের জমি থেকে ক্ষমতা চ্যুত করা হয় ৷ জমির জরিপ দ্বারা কৃষককে জমির অধিকার দেওয়া হয় । রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব জমিদারদের ওপর থাকে ৷ এইভাবে বেন্টিং হিতবাদী রাজস্ব সংস্কারের মাধ্যমে কোম্পানির অর্থনৈতিক অবস্থাকে সমৃদ্ধ করেন ৷ এই পদক্ষেপ নেওয়ার ফলে কোম্পানির আই বছরে 15 লক্ষ পাউন্ড বৃদ্ধি পেয়েছিল ৷ তবে বেন্টিং এর রাজস্ব সংস্কার দ্বারা কোম্পানির আয় বৃদ্ধি পেলেও কৃষকরা উপকৃত হয়নি । রেন্টিং এর রাজস্বের হাড় ছিল বেশি চড়া কৃষকদের ওপর রাজস্বের ভয়ানক চাপ বৃদ্ধি পায় ৷ বেন্টিং কৃষককে জমিতে দায়িত্ব দিলেও জমির রাজস্বের ভার কম করেনি ৷ তিনি ভূমি রাজস্ব বৃদ্ধি করে বাণিজ্য শুল্ক হ্রাস করেন ।
বেন্টিং প্রশাসনিক ও বিচার বিভাগের ক্ষেত্রে বিভিন্ন সংস্কার করেন ৷ তিনি সরকারি পদে ভারতীয়দের নিয়োগের নীতি গ্রহণ করেন ৷ বেন্টিং এর বিচার বিভাগের উচ্চপদে ভারতীয় বিচারক নিয়োগ করেন ৷ তিনি জানতেন যে ইউরোপীয় কর্মচারীদের তুলনায় অনেক কম বেতন দিয়ে ভারতীয় কর্মচারীদের নিয়োগ করা যাবে ৷ তবে হিতবাদী আদর্শের পরিবর্তে তিনি কোম্পানির ব্যয় হ্রাস করতে স্বল্প মহিনাভোগী ভারতীয়দের নিয়োগের ব্যবস্থা করেন ৷ তিনি তার বিচার বিভাগীয় সংস্কারে হিতবাদী ভাবধারাকে রূপ দেওয়ার চেষ্টা করেন ৷ তার উদ্যোগে ১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দে চ্যাটার একটে ৮৭ নম্বর ধারা সংশোধিত করা হয় ৷ জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে যোগ্যতা কে উপযুক্ত পদের মাপকাঠি হিসাবে ধার্য করেন ৷ কর্নওয়ালিশ প্রবর্তিত প্রাদেশিক আপিল আদালত ও ভ্রাম্যমান ফৌজদারি আদালত গুলিতে বিচারে আহত বিলম্ব হাওয়ায় বেন্টিং এই আদালত তুলে দেন ৷ জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের হাতে তিনি জেলার ফৌজদারী মামলার বিচারের দায়িত্ব দেন ৷ এই ভাবেই হিতবাদী সংস্কারের দ্বারা বেন্টিং সমগ্র শাসনব্যবস্থাকে সু-নিয়ন্ত্রিত করেন ৷
হিতবাদী দর্শনে অনুরাগী বেন্টিং ভারতীয় সমাজ সংস্কারক মূলক আন্দোলন কেউ সমর্থন করেন ৷ সামাজিক সংস্কারের ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন ভারতবাসীর কাছে শ্রদ্ধার পাত্র ৷ উইলিয়াম বেন্টিং-এর মাত্র ৭ বছরের শাসনকাল ছিল ঘটনা বহুল । সামাজিক সংস্কারের ক্ষেত্রে তার দুটি স্মরণীয় কৃতিত্ব হল -
প্রথমত, ভারতীয় জীবনযাত্রার অন্যতম কলঙ্ক ছিল সতীদাহ প্রথা ৷ এই প্রথা অনুযায়ী মৃত স্বামীর জ্বলন্ত চিতায় তার স্ত্রীকে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারা হতো এই নির্মম প্রথা নিবারণের জন্য এই প্রথা বন্ধ করতে তিনি ১৮২৯ খ্রিস্টাব্দে রেগুলেশন আইন দ্বারা এই প্রথাকে বেআইনি ঘোষণা করেন এবং ব্রিটিশ পার্লামেন্ট দ্বারা এই সতীদাহ প্রথা নিষিদ্ধ হয় ৷
দ্বিতীয়তঃ বেন্টিং এর সময় ঠগি দস্যুদের উপর বৃদ্ধি পেয়েছিল ৷ এই দস্যুরা নিজেদের মা কালীর শিষ্য বলে দাবি করত ৷ ঠগিরা উত্তর ও মধ্য ভারতের সক্রিয় হয়ে উঠেছিল এবং পথচারী ও বণিকদের সর্বস্ব লুঠ করেন বিস্তীর্ণ অঞ্চল ত্রাসের সঞ্চার করেছিল ৷ ১৮২৯ খ্রিস্টাব্দে বেন্টিং ঠগিদের দমন করার জন্য কর্নেল স্লিম্যাগের নেতৃত্বে এক বিশেষ বিভাগ হলেন এবং স্লিম্যাগ এই দায়িত্ব দক্ষতার সাথে পালন করেন এবং ১৮৩৭ সালে ইহা সম্পূর্ণ বন্ধ করা হয় ।
বেন্টিং এর শাসন অধিকাংশ ভারতীয়দের কতটা কল্যাণ সাধন করেছিল তা বলা খুব কঠিন | বেন্টিং সরকার ভারত বর্ষ থেকে প্রচুর রৌপ ও স্বর্ণ ইংল্যান্ডে পাঠিয়েছিল যা অনিবার্যভাবে কৃষি সংকট ডেকে এনেছিল ৷ ভারতবর্ষ পাশ্চাত্য শিক্ষার বিস্তারের ইতিহাসে বেন্টিং এর শাসনকাল চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে, ১৮১৩ সালে সনদ আইনে ভারতীয় শিক্ষার জন্য সরকারের তরফ থেকে এক লক্ষ টাকা ব্যয় করা হয় । তবে সেটা পাচ্য না পাশ্চাত্য শিক্ষায় ব্যয় করা হবে তা নিয়ে বিতর্ক চলে ৷ বেন্টিং তার হিতবাদী দর্শনের প্রভাবে পাশ্চাত্য শিক্ষা হিসাবে ইংরেজি ভাষা শিক্ষার প্রতি আগ্রহ প্রকাশ করেন ৷ আইন সচিব লর্ড মেকলে ইংরেজি ভাষার শিক্ষার পক্ষে যুক্তি দেখিয়ে এক চিঠি পেশ করলে ১৮৩৫ সালে বেন্টিং ঘোষণা করেন সরকারি শিক্ষা খাতে বরাদ্দ টাকা পাশ্চাত্য শিক্ষা ও ইংরেজি ভাষা শিক্ষার জন্য ব্যয় করা হবে ৷ ভারতীয়রা অল্প সময়ের মধ্যে ইউরোপীয় জ্ঞান বিজ্ঞানের সাথে পরিচিত হয় এবং উন্নত আধুনিক মনোভাব ও চিন্তাধারার অধিকারী হয়ে ওঠেন ৷ দেশের সামগ্রিক উন্নতি ও পরিবর্তনে বেন্টিং এর এই হিতবাদী সংস্কার বিপ্লব সৃষ্টি করেছিল তার চেষ্টায় ১৮৩৫ সালে কলকাতায় মেডিকেল কলেজ স্থাপিত হয় ৷
হিতবাদী সংস্কারের প্রবক্তা ছিলেন ইংরেজ দার্শনিক ও সমাজ সংস্কারক জেরিমি বেন্থাম তার প্রচারিত দার্শনিক মতবাদকে উপযোগীবাদ বা হিতবাদ বলা হয় ৷ তার মতে হিতবাদ এর মূল কথা হলো অধিকাংশ মানুষের বৃহত্তম হিতসাধন । বেন্থাম তার বৃদ্ধ বয়সে মন্তব্য করেছিলেন," মিল হবেন ব্রিটিশ ভারতের জীবিত শাসনতন্ত্র এবং আমি হব তার মৃত আইনসভা' ৷ জনগণের মঙ্গলের জন্য আইন রচনা করতে হবে । এই দর্শনের দ্বারা প্রভাবিত হিতবাদী প্রশাসক ছিলেন বেন্টিং ভারতের ইতিহাসে তার শাসনকাল শান্তি ও সংস্কারের যুগ হিসাবে পরিচিত । তিনি জাতি ধর্ম বর্ণের পার্থক্য দূর করে প্রশাসনিক পদের দরজা যোগ্য ভারতীয়দের জন্য খুলে দেন ৷ বেন্টিং তার এই জনকল্যাণগামী সংস্কারের দ্বারা ভারতবাসীর উন্নতি সাধন করার চেষ্টা করেছিলেন ৷