তৃতীয় পানিপথের যুদ্ধের গুরুত্ব আলোচনা কর অথবা,তৃতীয় পানিপথের যুদ্ধের তাৎপর্য ব্যাখা করো।
তৃতীয় পানিপথের যুদ্ধের গুরুত্ব আলোচনা কর
ভারতবর্ষের ইতিহাসে পাণিপথের তৃতীয় যুদ্ধের (১৭৬১) গুরুত্ব অপরিসীম। ভারতের রাজনীতির ক্ষেত্রে মুঘল সাম্রাজ্যের ধ্বংসাবশেষের উপর মারাঠাদের সমগ্র ভারতবর্ষ ব্যাপী সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা যখন নিশ্চিত সম্ভবনারূপে দেখা দেয়, তখন তার বাধা হিসাবে উপস্থিত হয় আহম্মদশাহ আবদালীর নেতৃত্বে আফগানরা। এই আফগানদের সাথে মারাঠাদের চূড়ান্ত যুদ্ধ হয় তৃতীয় পাণিপথের যুদ্ধে (১৭৬১)।
■ এই যুদ্ধে হেরে গিয়ে মারাঠাদের ভারতে হিন্দু সাম্রাজ্য গড়ে তোলার স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। এই যুদ্ধ ধ্বংসোন্মুখ মুঘল সাম্রাজ্যের পতন এবং ভারতবর্ষে ইংরেজ প্রাধান্য বিস্তারের পথ সুগম করে দেয় । পলাশীর যুদ্ধে ভারতে ইংরেজ প্রাধান্যের যে বীজ বপন করা হয়েছিল, পাণিপথের তৃতীয় যুদ্ধ সেই বীজকে অঙ্কুরোদগমের সুযোগ করে দেয় । এই যুদ্ধে ভারতের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে যায় ।
তৃতীয় পাণিপথের যুদ্ধের গুরুত্বঃ
তৃতীয় পাণিপথের যুদ্ধ ছিল ভারতের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী ঘটনা ৷ এই যুদ্ধ ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ন ইঙ্গিত বহন করে । এর যেমন প্রত্যক্ষ ফল রয়েছে, তেমনি রয়েছে পরোক্ষ ফল।
প্রত্যক্ষ ফলঃ
মারাঠারা প্রথম দিকে সাফল্য অর্জন করলেও শেষ সময়ে ১৩০০০ সৈন্য নামিয়ে আহম্মদশাহ আবদালী যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দেন । মারাঠারা সম্পূর্নভাবে পরাজিত হয় । বিশ্বাস রাও এবং সদাশিব রাও যুদ্ধক্ষেত্রে প্রান দেন। অধিকাংশ মারাঠা নেতা নিহত হন। প্রত্যেকটি মারাঠা পরিবারকে আত্মীয়-স্বজনের দুঃখে কাঁদতে হয়। এক আঘাতে মহারাষ্ট্রের একটি যুগের সকল নেতৃ-বৃন্দ নিঃশেষ হয়ে যায়। ক্ষোভে ও ভগ্ন হৃদয়ে পেশোয়া প্রানত্যাগ করেন।
■ তৃতীয় পাণিপথের যুদ্ধে হাজার হাজার মারাঠা সেনা নিহত হয়। অনেক বংশের প্রধান চিরতরে বিলুপ্ত হয়ে যায়। শুরু হয় মারাঠাদের দৈনদশা। পেশোয়ার মৃত্যুতে মারাঠাদের মধ্যে আত্ম - কলহ আরও প্রকট হয়। এরপর পেশোয়া বংশ মহারাষ্ট্রে আর কর্তৃত্ব ফিরে পায় নি। পরবর্তীকালে নতুন মারাঠা নেতা গৌরব অর্জন করলেও পূর্বের গৌরব ফিরে পায় নি। এই যুদ্ধের ফলে ভারতে মারাঠাদের হিন্দু সাম্রাজ্য স্থাপনের আশা ধূলিসাৎ হয়ে যায়।
■ পাণিপথের এই তৃতীয় যুদ্ধে আফগান নেতা আহম্মদশাহ আবদালীও তেমন লাভবান হয় নি। এই যুদ্ধে জয়লাভ করে আহম্মদশাহ আবদালী লুণ্ঠন ছাড়া আর কিছুই করতে পারেন নি ৷ সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা তো দূরের কথা, এমনকি পাঞ্জাবও তিনি নিজের অধিকারে রাখতে পারেন নি। শিখদের দমন করতে না পেরে তিনি পাঞ্জাব ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হন।
পরোক্ষ ফলঃ
তৃতীয় পাণিপথের যুদ্ধের পরোক্ষ ফল ছিল সুদুর প্রসারী । ভারতীয় শক্তি হিসাবে মারাঠাদের গুরুত্ব হ্রাস পায় । তাদের সংহতি বিনষ্ট হওয়ায় অন্যান্য ভারতীয় শক্তিগুলি মারাঠাদের উপর আর আস্থা রাখতে পারে নি । এই যুদ্ধে রঘুনাথ রাওয়ের মতো অপদার্থ মারাঠা নায়ক প্রতিষ্ঠিত হবার সুযোগ পায়। মারাঠাদের দুর্বলতার সুযোগে ইংরেজরা বাংলা ও কর্ণাটক অঞ্চলে নিজেদের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত করার সুযোগ পায় । এই যুদ্ধের ফলে মুঘল সাম্রাজ্যের অবস্থাও শোচনীয় হয়ে ওঠে । মুঘল বাদশাহ ইংরেজদের নতুন প্রভু হিসাবে মনে করে। এই যুদ্ধ শিখদের পক্ষে ঈশ্বরের আশীর্বাদ স্বরূপ দেখা দেয় । তারা পাঞ্জাবে আধিপত্য স্থাপনের সুযোগ পায় ।
■ এই যুদ্ধে মারাঠা শক্তির বিপর্যয়ের ফলে হায়দার আলীর উত্থান ঘটে। কিন্তু পেশোয়া-র প্রতিপক্ষ ম্লান হয়ে যায় । মারাঠা শক্তি হ্রাসের ফলে ইংরেজরা রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠা লাভের সুযোগ পায় । পলাশীর যুদ্ধে ভারতে ইংরেজ আধিপত্যের যে বীজ বপন করা হয়, তৃতীয় পাণিপথের যুদ্ধে তা শেকড় হয়ে ছড়িয়ে পড়তে থাকে ।
এভাবে তৃতীয় পাণিপথের যুদ্ধ মারাঠা শক্তিকে যে আঘাত দেয় ৷ তার ফলে মুঘল ও মারাঠাদের পতন আসন্ন হয়ে ওঠে এবং ইংরেজদের প্রতিষ্ঠার পথকে প্রশস্ত করে দেয় ।