পলাশী থেকে বক্সার পর্যন্ত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আধিপত্য বিস্তারের ইতিহাস আলোচনা কর
১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে ২৩ শে জুন প্রবাহিত ভাগীরথীর তীরে পলাশীর প্রান্তরে ইংরেজ সেনাপতি রবার্ট ক্লাইভ এর নিকট বাংলার স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয় ও হত্যার মধ্যে দিয়ে ব্রিটিশদের যে বিজয় যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৭৬৪ খ্রিস্টাব্দে বক্সারের যুদ্ধের জয়লাভ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের প্রবাহকে আরো দীর্ঘতা প্রদান করে ৷ বক্সারের যুদ্ধের পর ১৭৬৫ তে দেওয়ানি লাভ বাংলার ইংরেজ কর্তৃত্বকে একটি বৈদ্যভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করেন ৷ যদিও অনেকে মনে করেন পলাশী বাংলার রাজনৈতিক স্বাধীনতা সম্পন্ন হরণ করেননি মির কাসিম একজন পুরোপুরি স্বাধীন সার্বভৌম নবাব হিসেবে শাসন পরিচালনায় আগ্রহী হয়েছিলেন ।
পলাশী যুদ্ধের পর থেকে ব্রিটিশগণ তাদের মনোনীত প্রার্থীকে তারা নিজ স্বার্থ সুরক্ষিত করার জন্য সিংহাসনে বসাত এবং নবাব সেই প্রয়োজন মেটাতে ব্যর্থ হলে তাকে সিংহাসন চ্যুত করা হত ৷ সিরাজের মৃত্যুর পর ব্রিটিশরা একই উদ্দেশ্যে মীরজাফরকে নবাব পদে নিযুক্ত করেন ৷ কিন্তু মীরজাফর ইংরেজদের দাবিদাওয়া পূরণে ব্যর্থ হলে ১৭৬০ এ তাকে পদচ্যুত করা হয় এবং ইংরেজরা তার জামাতা মীর কাসিমকে নবাবী পথে নিযুক্ত করেন ৷ পলাশী যুদ্ধের পর সম্পাদিত চুক্তির মাধ্যমে ইংরেজরা বাংলার বেশ কিছু অঞ্চল লাভ করেন ৷ ডঃ বিনয় কৃষ্ণ চৌধুরী দেখিয়েছেন যে, "মীরজাফর শাসন পরিচালিতর ক্ষেত্রে সম্পূর্ণভাবে ব্রিটিশদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিল , তিনি আরো বলেন মীরজাফরের পতন নিশ্চিত ছিল কেননা ইংরেজদের দাবি দিন-দিন বৃদ্ধি পেতে থাকে যা নবাবের পক্ষে সম্পূর্ণ পূরণ করা সম্ভব ছিল না ৷
পলাশীর পর ব্রিটিশদের হাতে নানা ভাবে প্রচুর পরিমাণ অর্থ সম্পদ সংগৃহীত হয় ৷ ব্রিটিশরা এই পর্যায়ে সরাসরি অর্থ লুন্ঠনের পথ গ্রহণ করেছিল ৷ ইরফান হাবিব বলেছেন যে," পলাশীর পর থেকে বাংলার সম্পদ নিসরণের প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যায় । দেশের ব্যাঙ্ক প্রতিষ্ঠা গুলির পতন শুরু হয় ব্রিটিশরা বিনিয়োগের কেন্দ্র গুলির পরিচালনা করতে শুরু করে এবং এই সময় এজেন্সি হাউসের কেন্দ্র গুলির কর্মকাণ্ডের সূত্রপাত ঘটে ৷ ডঃ সব্যসাচী ভট্টাচার্য দেখিয়েছেন বাংলার অর্থনীতি ইংরেজদের অর্থনীতি দ্বারা পরিচালিত হতে শুরু করে ৷ বস্ত্রশিল্প এবং বাণিজ্যের উপর একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ কায়েম করতে সক্ষম হয় এই প্রক্রিয়াকে তিনি বলেছেন "Domination effect".
গভর্নর ভ্যান্সিটার্ট মীর জাফরকে বিকল্প রূপে মীর কাসিম কে বাংলার সিংহাসনে বসান ৷ তিনি সিরাজ বা মীরজাফরের তুলনায় অনেক বেশি সুদক্ষ ও দূরদর্শী শাসক ছিলেন ৷ চুক্তি অনুযায়ী ইংরেজদের সমস্ত অর্থ মিটিয়ে দেন এবং বর্ধমান মেদিনীপুর এবং চট্টগ্রামের জমিদারি পান ব্রিটিশরা ৷ উপরন্ত ভ্যান্সিটার্ট ৭ জন ইংরেজ কর্মচারীকে ব্যক্তিগতভাবে আরো ৩২ লক্ষ্য ৭৮ হাজার টাকা দেন ৷ কিন্তু স্বল্পকালের মধ্যে ইংরেজদের সঙ্গে মীর কাসেমের বিরুদ্ধে দেখা যায় । ডঃ রজত কান্ত রায় তার একটি প্রবন্ধে বলেছেন যে," মীর কাসিমের সঙ্গে সংঘর্ষের মূল কারণ ছিল দস্তকের অপব্যবহার জনিত সমস্যা ৷" উভয় পক্ষের সংঘাতের পরিণতি ছিল ১৭৬৪ সালে বক্সারের যুদ্ধ ৷ এই যুদ্ধে মীর কাসেমের সঙ্গে যোগদান করেন দিল্লির বাদশা দ্বিতীয় শাহ আলম, অযোধ্যা নবাব সুজাউদ্দৌলা কিন্তু সম্মিলিত বাহিনী ইংরেজদের নিকট ২২শে মে অক্টোবর পরাজিত হয়।
বক্সার যুদ্ধ ইংরেজদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করে দেয় ৷ ভিন্সেন্ট স্মিথ বলেছেন পলাশী ছিল কামানের লড়াই কিন্তু বক্সার ছিল চূড়ান্ত যুদ্ধ ৷ বক্সারের সাফল্য ইংরেজ কোম্পানিকে ভারতের রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা ছাড়পত্র দিয়েছিলেন ৷ এই যুদ্ধের ফলে ১৭৬৫ সালে কোম্পানি বাৎসরিক ২৬ লক্ষ টাকার বিনিময়ে মুঘল সম্রাট শাহ আলমের কাছ থেকে বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার কাছ থেকে দেওয়ানি লাভ করেন ৷ কোম্পানির হাত ধরে রাজস্ব আদায়, দেওয়ানী মামলার বিচারের দায়িত্ব আর অন্যদিকে নবাব পান আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ও ফৌজদারী রক্ষার বিচারের হাত, রাজস্ব দপ্তর কোম্পানির হাতে থাকায় নবাবকে অর্থের জন্য নির্ভর হতে হয় কোম্পানির ওপর ৷ এর ফলে নবাবের হাতে থাকে ক্ষমতা হীন দায়িত্ব আর কোম্পানি পেলেও দায়িত্বহীন ক্ষমতা । যাকে পার্সিভাল স্পিয়ার "দ্বৈত শাসন ব্যবস্থা" বলে উল্লেখ করেছেন ৷
১৭৬৫ তে দেওয়ানি লাভ ব্রিটিশদের রাজনৈতিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা আর এক ধাপ এগিয়ে যাওয়া ছিল ৷ ক্লাইভ ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষকে পত্রমারফত জানাই যে এখন থেকে বাংলাতে ব্রিটিশরাই সমস্ত রাজনৈতিক ক্ষমতার উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছে ৷ ঐতিহাসিক পার্সিভাল স্পিয়ার ১৭৬৫ এর পরবর্তীকালে শাসন ব্যবস্থার চরিত্র বিশ্লেষণ করে বলেছেন দা ডুয়াল সিস্টেম বস্তুত দ্বৈত শাসন ছিল সংবিধানিক মুখোশ মাত্র নবাব কে শিখন্ডি খাড়া করে সব ক্ষমতা ভোগ করতে ইংরেজ কোম্পানি ৷ গড ওয়েল ঠিকই বলেছিলেন," এতকাল ধরে ইংরেজ ও ফরাসি যে স্বপ্নের বিভোর ছিল ক্লাইভের এই চুক্তি তার সমাপ্তি ঘটায় অবশ্য স্বপ্ন রাজকন্যার লাভ করে ইংরেজগণ ফরাসিগণ নয় ৷" তাই বলা হয়,"১৭৬৪ বক্সার যুদ্ধ এবং১৭৬৫ তে দেওয়ানি লাভ ছিল বাংলার ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির চূড়ান্ত রাজনৈতিক ক্ষমতা লাভের চাবিকাঠি স্বরূপ ৷"